ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সি আর দত্তের চিরবিদায়

প্রকাশিত: ২২:৪৩, ২ সেপ্টেম্বর ২০২০

শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সি আর দত্তের চিরবিদায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় চিরবিদায় নিলেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, বীরউত্তম চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সি আর দত্ত)। মঙ্গলবার শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের পক্ষ থেকে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দেশের জাতীয় পতাকা জড়ানো কফিনে শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায় রাজধানী সবুজবাগের বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দিরে নেয়া হয় সি আর দত্তের মরদেহ। সেখানে তাঁর জীবনবৃত্তান্ত পাঠ ও নীরবতা পালনের পর জানানো হয় গানস্যালুট। এরপর রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের পক্ষ থেকে তাঁর কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এর আগে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে জাতীয় পতাকায় মুড়ে সি আর দত্তের কফিন নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত সি আর দত্তের মরদেহ রাখা হয় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। সেখানে অসাম্প্রদায়িক চেতনার যোদ্ধা বীর উত্তম সিআর দত্তকে শেষ বিদায় জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে ঢাকা জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে এই মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়। এ সময় ঢাকার জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম উপস্থিতি ছিলেন। গার্ড অব অনার দেয়ার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের এই সেক্টর কমান্ডারের কফিনে ফুলেল শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে জাতীয় পতাকায় মোড়া সি আর দত্তের কফিনে শ্রদ্ধা জানাতে যেমন রণাঙ্গনের সহযোদ্ধারা এসেছিলেন, তেমনি এসেছিলেন সর্বস্তরের মানুষ। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে মিলন কান্তি দত্তের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ আর শৈলেন নাথ মজুমদারের নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি সি আর দত্তের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। এ ছাড়া বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদ, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট ও বাংলাদেশ শিক্ষক ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে সি আর দত্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আসার আগে বনানী ডিওএইচের বাসার সামনের মাঠে কিছুক্ষণের জন্য রাখা এই এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ। সি আর দত্তের ছেলে চিরঞ্জিত দত্ত ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সাংবাদিকদের কাছে বলেন, বাবাকে আমরা ভিন্নভাবে দেখেছি নানা সময়ে। এ দেশ নিয়ে তিনি সব সময় স্বপ্ন দেখতেন। কত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তিনি দেশের জন্য লড়াই করেছেন। বাবার স্বপ্ন ছিল এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। তিনি সারাজীবন সে লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। কোন কিছু নিয়ে তার কখনও কোন আক্ষেপ ছিল না। দেশকে তিনি হান্ড্রেড পারসেন্ট ভালবাসতেন। সি আর দত্তের মেজ মেয়ে চয়নিকা দত্ত বলেন, বাবার স্বপ্ন ছিল দেশকে নিয়ে। সোনার বাংলার উন্নতি হবে কীভাবে তাই নিয়ে ভাবতেন তিনি। সেখানে বড় মেয়ে মহুয়া দত্ত এবং ছোট মেয়ে কবিতা দাসগুপ্তও বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন। সি আর দত্তের কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে হিন্দু-বৌদ্ধ- খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, সি আর দত্তের উপর যখন যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, তা তিনি কর্তব্যনিষ্ঠ থেকে সততার সঙ্গে পালন করেছেন। তাঁর দেশপ্রেম ছিল অতুলনীয়। জেনারেল এরশাদ যখন তার সামরিক ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে দেশের মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করতে চেয়েছিলেন তখন সি আর দত্ত সেখানে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সকাল ১০টায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সি আর দত্তের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, সি আর দত্ত একজন মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না, মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক ছিলেন। দেশের যে কোন ক্রান্তিকালে জাতিকে সঠিক পথনির্দেশক হিসেবে সব সময় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন। রণাঙ্গনে সি আর দত্তের সাহসী ভূমিকা জাতি চিরদিন স্মরণ রাখবে। তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ গড়ার ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে স্বপ্ন ছিল, সে ক্ষেত্রে সি আর দত্তের অনন্য ভূমিকার কথা জাতি চিরদিন স্মরণ রাখবে। সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সি আর দত্তের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সভাপতি কে এম শফিউল্লাহ বলেন, স্বাধীন দেশ পাওয়ার পেছনে মেজর জেনারেল (অব) সি আর দত্তের অনেক ভূমিকা রয়েছে। রণাঙ্গনে আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করে পাকিস্তানিদের পরাজিত করেছি। অনেক স্মৃতি এখনও মনে পড়ে। সি আর দত্তের মৃত্যুতে জাতি দেশপ্রেমিক একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারাল। তার মৃত্যুতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। এর আগে বনানী ডিওএইচএসের মাঠে বিএনপির পক্ষ থেকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সি আর দত্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ সি আর দত্তের ছেলের হাতে দলের শোকবাণী তুলে দেন। এর পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, সি আর দত্তের মৃত্যুতে দেশ ও জাতি মহান সন্তানকে হারাল। আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে, আমাদের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছি। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির পল্লী উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক গৌতম চক্রবর্তী, মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাৎ, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য সুশীল বড়ুয়া প্রমুখ। মেজর জেনারেল সি আর দত্ত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। তিনি ছিলেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সিনিয়র সহ সভাপতি এবং বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। স্ত্রীবিয়োগের পর গত কয়েক বছর ধরে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রেই ছিলেন সি আর দত্ত। ২৫ আগস্ট বাংলাদেশ সময় সকাল ৯টায় ফ্লোরিডার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় ৯৩ বছর বয়সী এই মুক্তিযোদ্ধার। সোমবার তাঁর মরদেহ যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে পৌঁছানোর পর রাখা হয় ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালের হিমঘরে। মঙ্গলবার সকালে পরিবার ও স্বজনদের শেষ দেখার জন্য কফিন নেয়া হয় তার বনানী ডিওএইচএসের বাসায়। বিজিবি ॥ মঙ্গলবার রাজধানীর রাজারবাগ কালীমন্দির, সবুজবাগের শ্রী শ্রী বরদেশ্বরী মহাশ্মশানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সি আর দত্ত, বীর উত্তম এর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোঃ সাফিনুল ইসলাম, বিজিবিএম (বার), এনডিসি, পিএসসি উক্ত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান করেন। বিজিবির এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মেজর জেনারেল সি আর দত্তের মরদেহ রাজারবাগ কালীমন্দির মহাশ্মশানে পৌঁছলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এরপর বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোঃ সাফিনুল ইসলাম, বিজিবিএম (বার), এনডিসি, পিএসসি মেজর জেনারেল সি আর দত্তের মরদেহে পুষ্পস্তবক ও শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন।
×