ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তিন নদী ও সাগরের গ্রাসে বাড়ছে উদ্বাস্তু

প্রকাশিত: ২১:০১, ২ সেপ্টেম্বর ২০২০

তিন নদী ও সাগরের গ্রাসে বাড়ছে উদ্বাস্তু

স্টাফ রিপোর্টার, গলাচিপা ॥ তিন দিকে নদী। একদিকে সাগর। চারদিক থেকে অব্যাহত ভাঙ্গন গিলে খাচ্ছে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চালিতাবুনিয়া ইউনিয়ন। চলতি বর্ষা মওসুমে ভাঙ্গন আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। ভাঙ্গনের কারণে আয়তনে যেমন কমছে ইউনিয়নটি। তেমনি কমছে জনসংখ্যা। বিপরীতে বাড়ছে উদ্বাস্তু। কর্মসংস্থানের অভাবে বাস্তুহারারা হচ্ছে শহরমুখী। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারাও ইউনিয়নটি রক্ষায় নদীভাঙ্গন প্রতিরোধ ও বন্যানিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ নির্মণের ওপর জোর দিতে চাইছেন। কিন্তু অর্থ বরাদ্দের অভাবে কার্যক্রম এগোচ্ছে না। আয়তন ও জনসংখ্যায় এমনিতেই পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চালিতাবুনিয়া ইউনিয়ন সবচেয়ে ছোট। তার ওপরে গত চার-পাঁচ দশক ধরে চলছে অব্যাহত নদীভাঙ্গন। ইউনিয়নটির দক্ষিণে বিস্তীর্ণ সাগর এবং অপর তিন দিক নদী দ্বারা বেষ্টিত। এরমধ্যে প্রমত্তা ডিগ্রী ও দারচিড়া নদী ক্রমে গিলে খাচ্ছে গোটা ইউনিয়নটিকে। আরেক প্রমত্তা নদী আগুনমুখার তীব্র স্রোত কোড়ালিয়ার চরে বাধা পেয়ে ডিগ্রী ও দারচিড়া নদীকে সর্বগ্রাসী করে তুলছে। আটটি গ্রাম নিয়ে গঠিত চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের চারটি গ্রামই পড়েছে ভয়াবহ ভাঙ্গনের কবলে। ভাঙ্গনের কবলে পড়া গ্রামগুলো হচ্ছে- উত্তর চালিতাবুনিয়া, বিবিরহাওলা, মরাজাঙ্গি ও গোলবুনিয়া গ্রাম। সরেজমিনে দেখা গেছে, গত কয়েকদিনে ভাঙ্গন আরও তীব্র হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা জানিয়েছেন, গত এক মাসে অন্তত ৫০টি বাড়িঘর ও বিপুল পরিমাণ জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। গত তিন বছরে বিলীন হয়েছে আড়াই শ’য়েরও বেশি বাড়িঘর। নতুন করে আরও অন্তত এক হাজার বাড়িঘর ও প্রতিষ্ঠান এখন ভয়াবহ হুমকির মুখে রয়েছে। বাড়িঘর বিলীন হওয়া লোকজনের একটি অংশ বেড়িবাঁধসহ রাস্তার ওপর পলিথিন টানিয়ে উদ্বাস্তু জীবন যাপন করছে। অপর একটি অংশ শহরমুখী হচ্ছে। এছাড়া ভাঙ্গনে বিলীন হয়েছে কয়েক হাজার একর ধানীজমিসহ বহু সরকারী-বেসরকারী স্থাপনা। সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, ইউনিয়নের পূর্ব দিকের বিবিরহাওলা, চালিতাবুনিয়া ও গোলাবুনিয়া গ্রামের চার কিলোমিটারেরও বেশি বন্যানিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এতে করে ১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় ৭৫ ভাগ, ২ নম্বর ওয়ার্ডের ৫০ ভাগ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ৬০ ভাগ জমি ও বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে গেছে। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা মধ্য চালিতাবুনিয়া গ্রামের অসিম মীর (৩৫) জানান, তার ভিটেমাটি ডিগ্রী নদী গিলে খেয়েছে। তিন সন্তান আর স্ত্রী নিয়ে এখন বেড়িবাঁধের ওপর পলিথিন টানিয়ে বাস করছেন। তিনি বলেন, ‘ভাঙ্গনের হাত থাইক্কা আমাগো নিস্তার নাই। নদী আমাগো সব শ্যাষ কইর‌্যা দেছে। এ্যাহন আমি সরকারী জাগায় থাহি। নদী এ্যাহন এহানেও আইছে।’ অসিমের প্রতিবেশী এরশাদ খান (৪০) বলেন, ‘এ্যাক বছর আগেও নিজের ঘরে থাকতাম বউ পোলা মাইয়া লইয়া। এ্যাহন নিজের কিছু নাই। আমাগো এই দুঃখ কষ্ট কেউ দ্যাহে না। সরকার মোগো দিগে একটু হির‌্যা (ফিরে) চাইলে বাঁচতাম।’ শুধু অসিম বা এরশাদ নন, এ অবস্থা আরও বহু মানুষের। ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, এলাকার একাধিক শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ মাত্র দুই বছর আগে নির্মিত একটি সাইক্লোন শেল্টার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন পুরো ইউনিয়নটিই প্রায় বিলীনের পথে। চালিতাবুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুঃ জাহিদুর রহমান জানান, নদীভাঙ্গনে চারটি গ্রামের বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। অনেক ধনী পরিবার জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। আগুনমুখা ও ডিগ্রী নদীতে বালু উত্তোলন এবং চর ড্রেজিং না করায় ভাঙ্গনের তীব্রতা দিন দিন বাড়ছে। অনেক জায়গায় এখন আর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অবস্থা এমন পর্যায়ে এসেছে, নদীভাঙ্গন প্রতিরোধ করা না হলে মানচিত্র থেকে চালিতাবুনিয়া পুরোপুরি হারিয়ে যাবে। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন কর্মকর্তা হতাশা প্রকাশ করে জানান, জরুরী ভিত্তিতে ভাঙ্গন প্রতিরোধসহ বন্যানিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করা প্রয়োজন। অন্যথায় গোটা এলাকার অস্তিত্ব সঙ্কট দেখা দেবে।
×