ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ২ সেপ্টেম্বর ২০২০

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’

বঙ্গবন্ধু সবকিছু উৎসর্গ করেছিলেন মানুষের জন্য, দেশের জন্য। বাংলার মানুষের ধমনিতে রয়েছে তাঁর অস্তিত্ব। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শিকার হন বর্বরোচিত ও পৈশাচিক হত্যাকা-ের। রাতের শেষ প্রহরে সংঘটিত হয় এই মহাদুর্যোগ। বঙ্গবন্ধু মানুষের হৃদয়ে আছেন। গণতন্ত্রের আজীবন সাধক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর মতো তাঁর কন্যাও গণতন্ত্রের সাধক। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন বিদেশে ছিলেন বলেই প্রাণে রক্ষা পান। বঙ্গবন্ধু মানুষের ভালবাসার দুর্লভ সম্মানে অভিসিক্ত হয়েছেন। কিন্তু সেই নেতাকে ঘাতকরা বাঁচতে দিল না। এই শোকের মাস আগস্টেই বিএনপি সরকারের তত্ত্বাবধানে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও হত্যার চেষ্টা করা হয়। ‘স্পট ডেড’ করা হয় ২৩ জনকে। সেই হামলায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান ভয়ঙ্করভাবে আহত হন এবং পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ২৪ আগস্ট। হামলায় গুরুতর আহত হওয়া তিন শ’ জন চিকিৎসা নেন। এখনও ৮০ জন নেতা-কর্মী স্পিøন্টারের আঘাত নিয়ে পঙ্গু জীবন যাপন করছেন। আর এই হামলার পর মামলা করতে দেয়া হয়নি আওয়ামী লীগ নেতা বা ক্ষতিগ্রস্তদের স্বজনকে। জনগণের রায়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর ওপর পরিচালিত গ্রেনেড হামলার বিচার প্রচলিত আইনে ও প্রচলিত আদালতেই করেছেন। বিশেষ ক্ষমতায় এসবের বিচার করার জন্য তাঁকে পরামর্শ দেয়া হলেও তিনি সাধারণ মানুষ যেভাবে আদালতে গিয়ে বিচার পায়, সেভাবেই ব্যবস্থা করেন। এরপরের ইতিহাস তো সবার জানা। ২০০৭-এ দেশে এলো জরুরী আইন। দেশের ইতিহাসে ভয়ঙ্কর সেসব দিনে নিরীহ মানুষকে জেল খাটতে হয়েছে। দুর্নীতির ‘তকমা’ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে ভাল মানুষকেও। ‘ব্যালেন্স’ করার নামে খ্যাতিমান ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ, পত্রিকার মালিক-কেউই বাদ যাননি। বিএনপি পুনরায় দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করল। দেখলাম, ২০১৩ সালে বিএনপি তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে হরতালের নামে পেট্রল বোমা ছুড়ে শত শত নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছিল। বিএনপি কিভাবে মানুষ মেরেছিল তা গুগলে সার্চ দিলেই পাওয়া যায়। ২০১৪ সালের পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার হুঙ্কার দিয়ে বিএনপি প্রায় আড়াই শ’ নিরীহ ও শ্রমজীবী মানুষ হত্যা করেছিল। বিএনপির রাজনীতি নিয়ে তাই মানুষের আগ্রহও নেই। তবে সাম্প্রতিকালে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে প্রশাসন। কতিপয় ব্যক্তির অপকর্মের দায় অন্যের ঘাড়ে পড়তে পারে না। দায়ী ব্যক্তিকে কঠিন ও কঠোর আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে। অর্থাৎ, দোষীকে ছাড় দেয়া যায় না। করোনাকালে এটাই হোক সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ। শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৬-এ। এরপর টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায়। মোট চারবারের প্রধানমন্ত্রী তিনি। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ১২ জানুয়ারি তৃতীয়বারের মতো এবং ২০১৯ এর জানুয়ারিতে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের পরপরই মুক্তিযুদ্ধোত্তর সঙ্কটের কঠিন দিনগুলোতে বাঙালী জাতীয়তাবোধের গভীরতা থেকেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন। ২০০৯-এ ক্ষমতায় এসে সেই বিএনপি-জামায়াতের সহ¯্র জঞ্জাল পেয়েছেন। আমরা যদি পিছনে যাই দেখতে পাই, এদেশের সকল শ্রেণীর মানুষের প্রিয় ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯ আগস্ট, ১৯৭২-এ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণে এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘যতদিন এদেশে দুঃখী মানুষ পেট ভরে খেতে না পারবে, যতদিন অত্যাচার ও অবিচারের হাত থেকে তারা না বাঁচবে, যতদিন- না শোষণমুক্ত সমাজ হবে, ততদিন সত্যিকারের স্বাধীনতা আসতে পারে না। রাজনৈতিক স্বাধীনতা আনতে যে ত্যাগের প্রয়োজন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আনতে তার চেয়ে বেশি কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন। রাতারাতি হয় না। কোনদিন হয়নি। বস্তুত এর কোন সোজা পথ নেই। ধীর পদক্ষেপে এগোতে হবে। এজন্য অনেক ত্যাগ প্রয়োজন। অনেক ধৈর্যের প্রয়োজন। একদিনে হয় না। আমার রাজনৈতিক জীবনে আমি এ সত্য বহুবার উপলব্ধি করেছি।’.. .. .. ‘জীবনভর আমি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। যার মনের মধ্যে আছে সাম্প্রদায়িকতা সে হলো বন্যজীবের সমতুল্য। .. ..আমি বাঙালী, বাংলা আমার ভাষা। বাংলার কৃষ্টি, বাংলার সভ্যতা, বাংলার ইতিহাস, বাংলার মাটি, বাংলার আকাশ, বাংলার আবহাওয়া তাই নিয়ে বাংলার জাতীয়তাবাদ, যা তোমরা বিশ^াস করো।’ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ একুশ বছর বাংলাদেশ ও বাঙালীকে চরম দুঃসময় অতিবাহিত করতে হয়। নানান ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত পাড়ি দিয়ে এবং পদে পদে নানান জটিলতা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশ চালাচ্ছেন। এখন উচ্চকণ্ঠে একটি আওয়াজ উঠছে যে, ‘দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে’ বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, এটা অবশ্যই সময়ের দাবি। গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে জনগণের কাছে মনে হয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার, ‘দুর্নীতির প্রতি জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হবে।’ মানুষের এখন প্রথম কথাই হচ্ছে, দুর্নীতিবাজদের বর্জন করতে হবে। তবে দুর্নীতি করে কেউ রেহাই পেয়ে যাচ্ছে না। কথিত ব্যবসার কাজে বিভিন্ন দেশে ওড়াউড়ি করছেন কিছু বিতর্কিত ও চিহ্নিত লোক। তারা সরকারী দলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ বিদেশেও পলাতক। আমরা জানি, স্বজনপ্রীতি মানুষের সদিচ্ছাকে নষ্ট করে এবং রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর কাজকে কিংবা নীতিকেও নষ্ট করে দেয়ার অপচেষ্টা করছে চক্রান্তকারীরা। কোন ক্ষেত্রেই যাতে দুর্নীতিবাজরা অপকর্ম করে রক্ষা না পায়, এই চেষ্টা চলছে। এর ভূরি ভূরি প্রমাণ দেয়া যাবে। দুদকের পরিচালক কিভাবে ঘুষের বিনিময়ে ডিআইজিকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন তা শুনে অনেকেই এখন বিস্মিত। দুর্নীতি করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালক এনামুল বাছিরের জেল। পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমান কারাবন্দী। ডিআইজি প্রিজন বজলুর রশীদ সীমাহীন ঘুষবাণিজ্যে নিমগ্ন থাকায় এখন কারাগারে। তারা বিচারের মুখে। অবশ্য, সমালোচকরাও স্বীকার করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের কারণে দুর্নীবাজদের এখন গ্রেফতার করা হচ্ছে, জেল খাটছে, বিচার চলছে। এই রীতি-পদ্ধতি দীর্ঘদিন এদেশে ছিল না। এখন অন্যায়কারী ধরা পড়লে তিনি যত উচ্চতম ব্যক্তি বা সমাজের যে স্ট্যাটাসেরই হোন না কেন, তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। শেখ হাসিনার সরকার আমলে নিজ দলের (সাবেক) মন্ত্রী, এমপি, নেতা, জনপ্রতিনিধি জেলে গেছেন। এটা প্রমাণিত সত্য যে, রাজনীতির কঠিন ময়দানে জাতির জনকের এই কন্যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সময়ের প্রধানমন্ত্রী। কারণ, বঙ্গবন্ধু কন্যা এদেশের মানুষের কাছে পরীক্ষিত। তাঁর কারণেই আজ টেকসই উন্নয়নের মহাসড়কে দেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বারো বছর ধরে দুঃসাহসী নেতৃত্ব দিয়ে দেশের জনগণকে যেমন আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছেন, ঠিক তেমনি স্বয়ংসম্পূর্ণ-স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তুলতে এক বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করতেও সমর্থ হয়েছেন। লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
×