ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

মহামৃত্যুর মিছিলে যারা চলে গেলেন

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ২ সেপ্টেম্বর ২০২০

মহামৃত্যুর মিছিলে যারা চলে গেলেন

দু’হাজার কুড়ি সালকে সম্ভবত মৃত্যুর মিছিলের বছর বলা যায়। পৃথিবীজুড়ে এই মিছিল চলছে। প্রকৃতি প্রমাণ করে দিল একটি মহাযুদ্ধ যত মানুষ হত্যা করতে পারে না, করোনাভাইরাস তা পারে। শেষ পর্যন্ত এই মৃত্যুদূত হরণ করেছে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর প্রাণও। গতকাল (সোমবার) যখন খবরটা শুনেছি তখন শোকে হতবাক হয়ে গেছি। প্রণব মুখার্জী তো শুধু ভারতের একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, ছিলেন বাংলাদেশের মানুষেরও একজন অকৃত্রিম বন্ধু। শেখ হাসিনার কাছে ছিলেন অভিভাবকতুল্য। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতার কাছে ছিলেন প্রণবদা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সহায়তা ছিল অতুলনীয়। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদিও তাকে প্রণবদা ডাকতেন। প্রণব মুখার্জী তো মারা গেলেন এখন। তার আগে দু’মাস থেকে প্রতিদিন কেবল মৃত্যুর খবর। বেশির ভাগই করোনায় মৃত্যু। কোন কোনটি স্বাভাবিক। করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে রোজ একটা না একটা মৃত্যু খবর শুনতে পাই। বাংলাদেশকে একবার বুদ্ধিজীবী শূন্য করেছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। এবার বুদ্ধিজীবী শূন্য করতে চলেছে করোনাভাইরাস। এই ভাইরাস ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের ওপর হামলা চালিয়েছিল। তিনি মরতে মরতে বেঁচে গেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের অনেক বুদ্ধিজীবী তার হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। সম্প্রতি চলে গেলেন শিল্পী মুর্তজা বশীর, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক রাহাত খান, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক ফেরদৌস কোরেশী। তার আগে একে এক চলে গেছেনÑ ড. আনিসুজ্জামান, ড. বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, জামিলুর রেজা চৌধুরী, কামাল লোহানি। তারা সকলেই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কেউ করোনায়, কেউ স্বাভাবিক রোগ-ব্যাধিতে মারা গেছেন। কিন্তু করোনার যুগে এক সঙ্গে এত মৃত্যু আমাকে যেন বন্ধুশূন্য এবং দেশটাকে যেন বুদ্ধিজীবী শূন্য করে গেছে। এক সঙ্গে এত মৃত্যুর শোক, বিশেষ করে বন্ধু-বিয়োগের শোক আর কখনও বহন করিনি। করোনা আর কত মানুষের প্রাণ হরণ করবে জানি না। বাংলাদেশে তো বটেই, বিশ্বে তার এখনও দাপট চলছে। নিজের কয়েকজন বন্ধুর কথাই আগে বলি। ড. অনিসুজ্জামান ও ড. বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর দু’জনেই ছিলেন কলেজ জীবনে আমার সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কামাল লোহানী ছিলেন সাংবাদিক সহকর্মী। পঞ্চাশের দশকে শিল্পী মুর্তজা বশীরের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। রাহাত খান ছিলেন আমার ছোট ভাইয়ের মতো। ১৯৬৯ সালে মানিক ভাই যখন মারা যান, তখন ‘ইত্তেফাকের’ সম্পাদকীয় বিভাগে আমি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক শহীদ সিরাজউদ্দীন হোসেন রাহাত খানের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটান। তখন ইত্তেফাকের সম্পাদক ছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। তার অনুমতি নিয়ে রাহাত খানকে আমি ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় বিভাগে গ্রহণ করি। রাহাত খান তখন সাপ্তাহিক ললনা পত্রিকায় কাজ করতেন। রাহাত খান নিজের যোগ্যতার গুণেই ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকও হয়েছিলেন। সাংবাদিকতার সঙ্গে তিনি সাহিত্যচর্চাও করতেন। কিছুকাল কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘সেবা’ প্রকাশনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সম্ভবত মাসুদ রানা সিরিজের দু’একটি বইও লিখেছেন। তবে তার প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল উপন্যাস লেখায়। তিনি কয়েকটি উন্নত মানের উপন্যাস লিখেছেন। তাতে স্বাধীতা পরবর্তী বাংলাদেশের যুগ-সন্ধির চমৎকার ছবি পাওয়া যায়। ফেরদৌস কোরেশীর সঙ্গে আমার পরিচয় ছাত্রনেতা হিসেবে। পরে ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দেন। রাজনীতিতে দক্ষতা থাকলেও বার বার দল বদলের ফলে এবং এক এগারোর সময় একটি বিতর্কিত রাজনৈতিক দল গঠন করতে তিনি ‘হোন্ডা পার্টির নেতা’ হিসেবে পরিচিত হন এবং নিজের ভাবমূর্তি নষ্ট করেন। তিনি একজন বুদ্ধিজীবীও ছিলেন, এ কথা বলতে আমার দ্বিধা নেই। ভারতে প্রণব মুখার্জীর মৃত্যু যদিও পরিণত বয়সে হয়েছে, তবু এই মৃত্যু দেশটির রাজনৈতিক আকাশে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করেছে, এ কথা বলা চলে। তার শ্বশুরবাড়ি নড়াইলে (যশোর), এজন্য তাকে ‘নড়াইলের জামাই’ বলা হতো এবং ‘আমাদের দেশের জামাই’ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষই তাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে ছিল তার নাড়ির টান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। এই সময় তিনি আওয়ামী লীগের অধিকাংশÑ বিশেষ করে তরুণ নেতাদের কাছে দাদা হয়ে ওঠেন। পরে তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে সর্বজনীনভাবে প্রণবদা হয়ে ওঠেন। আমার সঙ্গেও তার পরিচয় ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়। আমিও তাকে প্রণবদা ডাকতে শুরু করি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা যখন জার্মানি থেকে ভারতে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন, তখন ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে প্রণব মুখার্জী দিল্লীতে তাদের দেখাশোনার ভার গ্রহণ করেন বলে শুনেছি। সেই থেকে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার কাছে প্রণব মুখার্জী অভিভাবক তুল্য হয়ে ওঠেন। এই সম্পর্ক প্রণব মুখার্জীর মৃত্যুদিন পর্যন্ত অক্ষুণœ ছিল। আমার ধারণা, তার প্রয়াণে পরিজন পরিবার যতটা শোকান্বিত হয়েছেন, ততটাই শোকান্বিত হয়েছেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তাদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা বড় ধরনের নেপথ্য ভূমিকা ছিল প্রণব মুখার্জীর, এক এগারোর সময় এবং দিল্লীতে বিজেপি ক্ষমতায় বসার সময়। এক এগারোর সময় বাংলাদেশে জেনারেল মইন একটি আধাসামরিক সরকারের আড়ালে নিজে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রণব মুখার্জীর (তখন তিনি কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রী) কূটনীতিতেই ভারত সরকার জেনারেল মইনকে ভারতে আমন্ত্রণ জানান। তাকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেয়া হয়। হেলিকপ্টারে চড়িয়ে তাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়া হয়। গান শোনানো হয়। ফলে মইন-ফখরুদ্দীন সরকারের ভারত বিরোধিতা অনেকটা দূর হয় এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হয়। এটা আমার ধারণা। কংগ্রেসকে পরাজিত করে বিজেপি যখন ভারতে ক্ষমতায় বসে, তখনও প্রণব মুখার্জী যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেন, তার কোন দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। প্রণব মুখার্জী ছিলেন কংগ্রেস মনোনীত রাষ্ট্রপতি। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপতি পদে তার অবস্থান দুর্বল হওয়ার কথা। তা হয়নি। তিনি অল্পদিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন জয় করেন এবং নরেন্দ্র মোদি তাকে প্রণবদা ডেকে তার পরামর্শ নিতে শুরু করেন। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ও বন্ধুত্ব রক্ষা করাতেই ভারতের স্বার্থ রক্ষিত হবেÑ এই সত্যটা নরেন্দ্র মোদিকে প্রণব মুখার্জীই বোঝান। তার ফলে বিজেপি সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্বের জোরে বাংলাদেশে হাসিনার অসাম্প্রদায়িক সরকারকে ক্ষমতা থেকে হঠানোর যে ষড়যন্ত্র বিএনপি পাকিয়ে ছিল, তা ব্যর্থ হয়ে যায়। এ জন্যেই প্রণব মুখার্জী যখন ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য যেতে অস্বীকার করেন। এটাকে বিজেপি সরকারও ভারতের প্রতি অবমাননা গণ্য করে বিএনপির কাছ থেকে আরও দূরে সরে যায়। বাংলাদেশে গণতন্ত্র উদ্ধার ও রক্ষার কাজে ‘নড়াইলের জামাইয়ের’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সে জন্যে বাংলাদেশের মানুষ চিরকাল তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। আগেই বলেছি, প্রণব মুখার্জী আমার কাছে ছিলেন প্রণবদা এবং ’৭১ সাল থেকেই তার সঙ্গে ছিল আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তা সত্ত্বেও শেষদিকে সম্পর্কটি অম্লমধুর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কি কারণে জানি না, তিনি তার জীবনের শেষ দিকে আমার প্রতি রুষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। তিনি যখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তখন আমি একবার কলকাতায় যাই। প্রণবদাও তখন কলকাতায়। স্বাভাবিকভাবেই তাকে টেলিফোন করে দেখা করতে চাই। তিনি বললেন, এসো। পরদিন সকালে তার বাসায় গেলাম, তিনি আমাকে সাক্ষাত দান করলেন। কিন্তু চেয়ারটা ঘুরিয়ে আমার দিকে পেছন ফিরে বসেছিলেন। আমি বললাম, প্রণবদা, আমি এসেছি। তিনি তেমনি বসে রইলেন। কোন জবাব দিলেন না। কিছুক্ষণ পর বললেন, কী খবর? তার মুড দেখে আমি আর কোন কথা বলার উৎসাহ পাইনি। বললাম, আমি আসি। বলেই নমস্কার জানিয়ে চলে আসি। আমার প্রতি তার রুষ্ট হওয়ার কোন কারণ আমি খুঁজে পাইনি। আমি কলকাতায় থাকার সময় মমতা ব্যানার্জী আমাকে তার কালিঘাটের বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি যেতে পারিনি, কিন্তু তাকে সমর্থন জানিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলাম (এই সমর্থন এখন আমার নেই) এবং সেটি কলকাতার একটি দৈনিকের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল। পরে ভেবেছি, এই কবিতা কি প্রণবদার চোখে পড়েছে এবং সেজন্যেই তিনি আমার প্রতি রুষ্ট হয়েছেন? তখন মমতার সঙ্গে তার ভাল সম্পর্ক ছিল না। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তিনি আমাকে দিল্লীতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি অসুস্থতার জন্য যেতে পারিনি। কিন্তু রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়ার পর তিনি সকলের আপত্তি উপেক্ষা করে যখন ঘোর সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের অধিবেশনে যোগ দেন, তখন তার কঠোর সমালোচনা করে কলকাতর দৈনিকে নিবন্ধ লিখেছিলাম। তাতে বলেছিলাম, প্রণবদার রাজনৈতিক জীবনে একনিষ্ঠতা ছিল না। তিনি কংগ্রেস ছেড়ে একবার বাংলা কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। বাংলা কংগ্রেস ছেড়ে নিজে কংগ্রেসের পাল্টা রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করেছেন। তারপর আবার কংগ্রেসে ফিরে এসেছেন। এই বার বার দল বদলের স্বভাবের জন্য সোনিয়া-রাজীবের কাছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা তেমন ছিল না। এই বিশ্বাসযোগ্যতা থাকলে তিনি ড. মনমোহন সিংয়ের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতেন। তিনি তা হতে পারেননি। পরে তাকে রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়ে সান্ত¦না পুরস্কার দেয়া হয়েছে। নইলে পশ্চিমবঙ্গের নেতা থেকে তিনি যেভাবে সর্বভারতীয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন, তাতে বহু আগে তার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের (জুনিয়র) সঙ্গে বৈঠক করেন। বর্তমান ভারত-আমেরিকা উন্নত সম্পর্কের ভিত্তি তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। প্রণবদা চলে গেলেন, তাও চলে গেলেন করোনার হামলায়। এটা আমার মনে দারুণ আঘাত হেনেছে। তিনি যাই হোন, ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। তার মৃত্যুতে আমরা এমন একজন মিত্র হারালাম, বিপদের দিনে যিনি আমাদের তার ছাতার তলে আশ্রয় দিতেন। শেখ হাসিনাও হারালেন তার এক অভিভাবককে, বিপদের দিনের মিত্রকে। শুধু ভারতের ইতিহাসে নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসেও প্রণবদার নামটি অমর হয়ে থাকবে। জানি না ২০২০ সাল আরও কত মহাজীবনের অবসান ঘটাবে। আমি নিজেও আশি উর্ধ বয়সে এখনও বেঁচে আছি, এটা আমার কাছে বিস্ময়! [লন্ডন, ১ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার, ২০২০]
×