ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কর্নেল মোঃ কাউছার আলী সরকার

বজ্রকণ্ঠের স্বরূপ সন্ধান- একটি সমীক্ষা

প্রকাশিত: ২১:১৭, ১ সেপ্টেম্বর ২০২০

বজ্রকণ্ঠের স্বরূপ সন্ধান- একটি সমীক্ষা

(৩০ আগস্টের পর) অযোগ্য পাঞ্জাবী শাসক স্বাধীনতাকামী বাঙালী আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রাখে। বস্তুত বাঙালী শাসনের যোগ্যতা পাঞ্জাবী শাসকদের ছিল না; কারণ বাঙালী বীরের জাতি, যেন তেন শাসন তারা মানবে না। এরা কোন পশতু সিন্ধি মাকরানী বা বেলুচি নয় যে, পাঞ্জাবীদের স্বেচ্ছাচারী শাসন দিনের পর দিন মুখ বন্ধ করে সহ্য করবে। যে কারণে চব্বিশ বছরের শাসনামলে তারা যতই কঠোর হতে চেয়েছে বাঙালী তাদের সে কঠোরতা বার বার ভেঙে দিয়ে অস্থির করে তুলেছে। স্বৈরশাসনকে ভোগলিপ্সু ও সহজ¯্রােতে প্রবাহিত হতে না দিয়ে নিরাপদ ও নির্ঝঞ্ঝাটে থাকতে দেয়নি। এ লক্ষ্যে যে-ই দমন নিপীড়নের আশ্রয় নিয়েছে তাকেই কলঙ্কজনকভাবে বিদায় নিতে হয়েছে, যেমন: প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর আততায়ীর বুলেট রাজপথে অস্বাভাবিক মৃত্যু, ইস্কান্দার মির্জার বেদনাদায়ক শাসনাবসান ও বিদেশে মর্মান্তিক জীবনাবসান এমনকি মৃতদেহও পাকিস্তানে আনায় নিষেধাজ্ঞা. আইয়ুব খানের অসহায় তার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ, ইয়াহিয়ার কলঙ্কজনক আত্মসমর্পণ ও ভুট্টোর ফাঁসি ইত্যাদি করুণ পরিণতির সৃষ্টি করেছে। এভাবেই বাঙালীকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য করা হয়েছে। এ যুদ্ধে পরাজয় বরণের গ্লানি নিয়ে ইয়াহিয়া খানকে মাথা নিচু করে মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে, যে কারণে তাকে ‘পাকিস্তানের শৃগাল’ বলা হয়। এছাড়াও আইয়ুব মদদে সৃষ্ট ‘বেলুচ কসাই’ বিশেষণটি খোদ পাকিস্তানিরাই টিক্কা খানকে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পঞ্চান্ন বছরের আয়ুষ্কালের ৩৪ বছরই ছিল সংগ্রামমুখর। দেশ গঠনে তার ভূমিকার ব্যাপকতা বাংলাদেশ পাকিস্তান ও ভারতসহ সমগ্র বিশে^ বিশেষভাবে প্রশংসিত। ১৯৪৬ সালের গণভোট, পাকিস্তান সৃষ্টিলগ্নে সিলেটের অন্তর্ভুক্তি, ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ৬ দফা সৃষ্টি, ১৯৬৯ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ঘটনাসমূহ দুটি দেশ সৃজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাঙালী জাতিকে পাকিস্তানের সংবিধানে উল্লিখিত ‘সংখ্যালঘু’ বিশেষণ হতে অব্যাহতি দেয়া, খাদ্য সঙ্কটে দুর্বার আন্দোলনে খাদ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করা, প্রধানমন্ত্রী আই আই চুন্দ্রীগড়কে পদত্যাগ করানো, ফিরোজ খান নুনের প্রধানমন্ত্রিত্ব প্রাপ্তির একক কৃতিত্বের দাবিদার তিনি। ছেলেবেলা হতেই তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ঠ কর্মী ও নেতা, গণতন্ত্রের চর্চা ও প্রয়োগের মানসপুরুষ। যে কারণে সামরিক শক্তিধর পাকশাসকদের সঙ্গে তার বিরোধ চিরদিন। এ মৌলিক গুণাবলীতে মোহিত বাঙালী মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁকে অনুসরণ করত বলে তিনি পাক শাসকদের সামনে ছিলেন অকুতোভয়। চব্বিশ বছরকাল পরিসরে পাক শাসকগণ শেখ মুজিবের মতো অন্য কোন নেতাকে নিয়ে এতটা শঙ্কিত ছিলেন না। মৌলানা ভাসানী, এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জুলফিকার আলী ভুট্টো, আতাউর রহমান, কাইয়ুম খানসহ অন্য যাঁরা তৎকালীন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন কাউকেই এতটা ভয় করতেন না। কারণ তারা জানতেন যে, শেখ মুজিব এতটা জনপ্রিয় যে, যে কোন সময় সে জনবিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। অপারেশন সার্চ-লাইটের প্রতিবন্ধক বিবেচনায় ২৫ মার্চ কালরাতে তাঁকে বন্দী করার বার্তাটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ। বস্তুত বঙ্গবন্ধু তাঁর সম্মোহনী নেতৃত্ব গুণে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর অনির্বাণ প্রত্যাশাকে একীভূত করেছিলেন। বয়োঃজ্যেষ্ঠদের সম্মান ও কনিষ্ঠদের স্নেহ করার সামাজিক গুণগুলো তিনি পরিবার হতে শিখেছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে মতদ্বৈততার সংকটকালেও স্বার্থ ত্যাগ করে বড়দের সম্মান করা, তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া, মন্ত্রিত্ব ত্যাগ, জনকল্যাণে নিজ জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ, কারাবরণ ইত্যাদি ইতিহাস- সাক্ষ্যবহ। সম্পূর্ণ প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশেও একজন তরুণ কর্মী ও বিচক্ষণ নেতাকে দুই দুইবার মন্ত্রিত্ব প্রদান তাঁর কর্মমূল্যায়নের স্বাক্ষর বিবেচ্য। কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অসহযোগিতায় জনকল্যাণে ভূমিকা রাখার সুযোগ না পেয়ে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে স্বাধীনভাবে জনপাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই তাঁর জনপ্রিয়তা এত ঈর্ষণীয়। তিনি পাকবিভাজক ছিলেন না, বিভাজক ছিলেন ইয়াহিয়া ও ভুট্টো। তিনি ৬ দফা বাস্তবায়নে অবিভক্ত পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনপূর্ণ প্রদেশ হিসেবে একীভূত থাকতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত শেখ মুজিব স্বায়ত্তশাসনই চেয়েছেন। কিন্তু ইয়াহিয়ার জনবিরোধী কর্মকা- ও অনমনীয় মনোভাব এবং ভুট্টোর দুই পার্লামেন্ট বিশিষ্ট দুই প্রধানমন্ত্রী পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রমাণ। অবশেষে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নির্বিচারে নিরীহ বাঙালী গণহত্যার প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিব একদফা এক দাবি বাঙালী জাতির মুক্তি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। আর কোটি কোটি স্ফুটনোন্মুখ জনতা স্বনিত কণ্ঠে এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে তাদের করণীয় নির্ধারণ করেছিলেন। বাঙালী বীরের জাতি, স্বাধীনচেতা এবং গণতন্ত্রমনা বলেই পাকস্বৈরতন্ত্র ঋজু পথে এগোয়নি। ব্রিটিশ শাসন কবলিত অসহায় বাঙালী এবং পাক সেনাতন্ত্রের স্বৈরমূলে কুঠারাঘাত এবং নিজের জীবন বিপন্ন করে অস্ত্রের সম্মুখ হতে বাঙালীকে স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিয়েছিলেন বলে তিনি ‘স্বাধীনতার প্রতীক’। আজীবন স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে করতে যে মনোবল ও জনআস্থা তিনি সঞ্চয় করেছিলেন সে মানসিক শক্তিতেই স্বাধীনতা তার মুষ্টিবদ্ধ হয়, সৃষ্টি হয় বাংলাদেশের। এ কারণে জাতি চিরদিন তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে এবং একজন দেশ¯্রষ্টা হিসেবে তিনি ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। (সমাপ্ত) লেখক : অধ্যক্ষ, সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ
×