পরপারে চলে গেলেন সাংবাদিকদের অভিভাবক এবং সাংবাদিকতার দিকপাল রাহাত খান। দীর্ঘদিন দৈনিক ইত্তেফাকে কাজ করা রাহাত খান সর্বশেষ দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। রাহাত খান ১৯৪০ সালের ১৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার পূর্ব জাওয়ার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ষাটের দশকে তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন শিক্ষক হিসেবে। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন তিনি। শিক্ষাজীবন শেষ করে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে যোগদান করেন। এরপর জগন্নাথ কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারী কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৯ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা জীবনের হাতেখড়ি রাহাত খানের। পরে তিনি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় যোগদান করেন। তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক এবং সর্বশেষ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দৈনিক বর্তমান পত্রিকা। তিনি রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসসের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে পালন করেন।
রাহাত ভাইয়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ১৯৯৭ সালে। তখন আমি সাপ্তাহিক মুক্তিবার্তায় কাজ করি। মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের এই ম্যাগাজিনটিতে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব ছিল আমার। পরে শেখ রেহানা প্রকাশিত ও সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করতে গিয়ে বেবী আপার মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগের পরিধি আরও বিস্তৃত হয়। তার অধীনে আমার পেশাগত কাজের দায়িত্বের সময় ছিল মাত্র ছয় মাস। সময়টা ২০১৩ সাল। ওই বছরের আগস্টে আমি দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদকীয় বিভাগ ছেড়ে দৈনিক বর্তমানে একই বিভাগে যোগ দিই। রাহাত ভাই তখন পত্রিকাটির উপদেষ্টা সম্পাদক। সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করার কারণে প্রতিদিনই তার সঙ্গে আমার দেখা হতো। নিয়মিত সম্পাদকীয় মিটিংয়ে দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি-ইতিহাসসহ নানা বিষয়ে কথা হতো। প্রতিদিন আমাদের দুটি করে সম্পাদকীয় লেখা হতো। সম্পাদকীয়গুলো তোশারফ ভাই দেখার পর রাহাত ভাই দেখতেন। রাহাত ভাই আমাকে রাজনীতিবিষয়ক সম্পাদকীয়গুলো বেশি দিতেন। বলতেন তুমি এটা লিখবে, আমাকে দেখিয়ে নিও। মাঝেমধ্যে বলেও দিতেন কী দিয়ে শুরু এবং শেষ করব। একদিনের ঘটনা খুব মনে পড়ছে- তখন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এতই প্রকট ছিল যে, প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো ঘটনা ঘটত। একদিকে সরকার হটানোর আন্দোলন, অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার- সব মিলিয়ে এক অস্থির পরিস্থিতি। সেসময় এক সম্পাদকীয়তে ‘বিরোধী দলের নাশকতা’ শব্দগুলো লিখেছিলাম। প্রকাশ হওয়ার আগেই বিষয়টি নিয়ে খুব আপত্তি উঠল। কেউ কেউ বললেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে মালিক এবং প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে- এভাবে লেখা যাবে না। রাহাত ভাই বললেন, নাশকতাকে তো নাশকতাই বলা হবে- এটাই যাবে। সেদিন তার এই দৃঢ় উচ্চারণ আমাকে সাহস জুগিয়েছিল।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি আবারও জনকণ্ঠে ফিরে আসি। আসার সময় রাহাত ভাই বললেন, দুলাল আমি যদি ভাল কোন প্রতিষ্ঠানে যাই, তোমাকে ডাকব। সেদিন রাহাত ভাইয়ের বিষণ্ণমুখ অসহায়ের মতো দেখাচ্ছিল। এর কিছুদিন পর রাহাত ভাইও বর্তমান ছেড়ে দেন।
২০১৫ সালের প্রথম দিকের কথা। একদিন স্বদেশ দা (তখন জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক) আমার হাতে একটি লেখা দিয়ে বললেন, রাহাত ভাই এখন থেকে নিয়মিত লিখবেন, ওনার জন্য একটা দিন ঠিক কর। আমি তালিকা দেখে সোমবার উপ-সম্পাদকীয় পাতার জন্য দাদাকে বললাম। স্বদেশ দা তোয়াব ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে সোমবারই নির্ধারণ করলেন। সেই থেকে তিনি জনকণ্ঠে বেশ কিছুদিন লিখেছিলেন। এই লেখার সুবাদেই রাহাত ভাইয়ের সঙ্গে সপ্তাহে দু-একবার কথা হতো। আজ রাহাত ভাই নেই, আমার জন্য সবই স্মৃতি।
একজন সাংবাদিক হিসেবে সমাদৃত হলেও রাহাত খান ছিলেন আপাদমস্তক কথাসাহিত্যিক। বর্ণাঢ্য জীবনে রাহাত খান ছোটোগল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও উপন্যাসের নিপুণ কারিগর হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৭২ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অনিশ্চিত লোকালয়’ প্রকাশিত হয়। তার উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- অমল ধবল চাকরি, ছায়াদম্পতি, শহর, হে শূন্যতা, হে অনন্তের পাখি, মধ্য মাঠের খেলোয়াড়, এক প্রিয়দর্শিনী, মন্ত্রিসভার পতন, দুই নারী, কোলাহল ইত্যাদি। জনপ্রিয় ও বিখ্যাত থ্রিলার সিরিজ মাসুদ রানার রাহাত খান চরিত্রটি তাকে অনুসরণ করেই তৈরি করা। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন রাহাত খান।
শুধু সাংবাদিকতাই নয়, বাংলা ভাষার সাহিত্যাঙ্গনে যে কজন লেখক আলো ছড়িয়েছেন, রাহাত খান ছিলেন তাদের অন্যতম। একদিকে তিনি ছিলেন প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, উদার ও উন্নত মনমানসিকতার অধিকারী, অন্যদিকে তার কর্মের মধ্য দিয়ে হৃদ্য হয়েছে দেশের শিল্প-সাহিত্য অঙ্গন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম যে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন হয়, তার কার্যনির্বাহী সাধারণ সম্পাদক ছিলেন রাহাত খান। সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কবি জসীমউদ্্দীন ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। দেশের বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একনিষ্ঠ নিবেদিতকর্মী ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পূর্বাপর সময়ে রাজপথের আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে তিনি বহু কলাম, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও ছাত্রলীগের প্রায় প্রতিটি আলোচনা সভায় তিনি বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে বক্তৃতা করেছেন, কবিতাও লিখেছেন।
রাহাত খান শুধু কর্মজীবনে নয়, ব্যক্তিজীবনেও নিরহঙ্কার ও অমায়িক মানুষ ছিলেন। তিনি সুন্দর ও নান্দনিক জীবনযাপন করতেন। জীবনের প্রায় সবটুকুজুড়েই মানবতার ছাপ নানাভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। একজন রাহাত খানের অনন্যতা ছিল তার সৃষ্টির কৃতিত্ব ও গৌরব। জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মধ্যে নিমগ্ন করে রেখেছিল তার লেখকসত্তা। বলা যায়, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব অমীমাংসিত রেখেই চিরবিদায় নিলেন তিনি। তিনি আজ নেই। রেখে গেছেন তার অনন্য সাহিত্য সৃষ্টি, বিশাল ভক্তকুল। তার এই সৃষ্টিকর্ম যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যজগতে অসাধারণ অবদানের জন্য রাহাত খান স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: