ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর হাতেই স্থাপিত স্বাস্থ্য খাতের মূল স্তম্ভ

প্রকাশিত: ২১:১৪, ১ সেপ্টেম্বর ২০২০

বঙ্গবন্ধুর হাতেই স্থাপিত স্বাস্থ্য খাতের মূল স্তম্ভ

স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধবিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত, কপর্দকহীন একটি দেশ গঠনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। দেশে তখন নেই খাদ্য, নেই অর্থ, ব্যাংক রিজার্ভ শূন্য, বিপর্যস্ত অর্থনীতি। সেই সঙ্গে রাস্তা-ঘাট, রেলপথসহ সকল যোগাযোগের মাধ্যম এবং অবকাঠামোতে শুধু ধ্বংস আর ধ্বংসের চিহ্ন। প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং পুলিশ-সেনাবাহিনী তখনও পুরোপুরি পুনর্গঠিত হয়নি। এ রকম একটা ভঙ্গুর এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার মাঝে দেশ গঠনের দায়িত্ব নিয়েই বঙ্গবন্ধু ব্যাপকভাবে জনকল্যাণমুখী কর্মসূচী হাতে তুলে নেন। আজীবন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বাংলার খেটে খাওয়া, গরিব-দুঃখীসহ সর্বস্তরের মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। তিনি এমন একটি স্বাধীন, সার্বভৌম এবং সুখী-সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন, যেখানে সর্বস্তরের মানুষের জন্য পাঁচটি মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সুনিশ্চিত করা যাবে। আর এই মৌলিক অধিকারগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি তার নীতিমালা প্রণয়নে সচেষ্ট হন। পাঁচটি মৌলিক অধিকারের অন্যতম স্বাস্থ্যসেবাকে তিনি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন এবং তা বাস্তবায়নে সুপরিকল্পিতভাবে কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। তিনি তার আন্তরিকতা, বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শিতা দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য জনগণের চিকিৎসা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি করা অবশ্যই জরুরী। বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্যচিন্তা ছিল অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত, যুগোপযোগী, আধুনিক এবং জনকল্যাণমুখী। সত্যি বলতে কি, তারই চিন্তাপ্রসূত নীতিমালা এবং পরিকল্পনায় বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গোড়াপত্তন বা ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল, দেশের প্রতিটি মানুষের দোরগোড়ায় এবং প্রান্তিক জনগণের জন্য ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়া। দেশের কোন মানুষ যেন চিকিৎসার আওতার বাইরে না থাকে, এমনকি কাউকে যেন অর্থের অভাবে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হতে না হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্যসেবার পরিকল্পনা শুধু রাজধানী বা শহর কেন্দ্রিক ছিল না। বরং জেলা, থানা, ইউনিয়ন এবং গ্রামসহ তৃণমূল পর্যায়ে সেই সুযোগ নিশ্চিত করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। সেগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে তিনি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, মহকুমা হাসপাতাল, থানা হেলথ কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি সুবিন্যস্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রণয়নের পথ দেখিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তার উত্তরসূরি এবং সুযোগ্যা কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই পূর্ণতা পায় এই কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক চিকিৎসাসেবা, যা বর্তমানে প্রান্তিক জনগণের ন্যূনতম প্রাথমিক চিকিৎসার প্রধান আশ্রয়স্থল হিসেবে স্বীকৃত এবং বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। আজ বিশ্বের দরবারে এই কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থা একটি রোল মডেল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে থানা পর্যায়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ছিল খুবই দুর্বল। সেখানে যেমন ডাক্তার, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব ছিল, তেমন সার্বিক অবকাঠামো ছিল খুবই নড়বড়ে। বঙ্গবন্ধুই এসবের উন্নতিকল্পে থানা হেলথ কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশব্যাপী প্রায় প্রতিটি থানায় স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করেন। ১৯৭২ সালে সব জেলায় পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল ছিল না। দেশে সর্বসাকল্যে হাসপাতাল ছিল মাত্র ৬৭টির মতো। এই অবস্থায় তিনি প্রতি জেলায় একটি করে জেলা হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেন। একই সময়ে তিনি চিকিৎসক সঙ্কট মোকাবেলায় দ্রুততম সময়ে তৎকালীন মিটফোর্ড হাসপাতালকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে পরিণত করেন এবং প্রথম ব্যাচেই ১৫০ জন শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিশ্চিত করেন। তখন সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চিকিৎসক হওয়ার আগ্রহ থাকলেও পাস করার পর তাদের চাকরির নিশ্চয়তা ছিল না। নবীন চিকিৎসকদের জন্য এমবিবিএস পাসের পরপরই তিনি সর্বপ্রথম ইনসার্ভিস ট্রেনিং বা ইন্টার্নিশিপ নামক বৈতনিক প্রশিক্ষণ চালু করেন। তাদের প্রশিক্ষণকালীন সময়কে নিয়মিত চাকরির অন্তর্ভুক্ত করেন এবং এক বছর প্রশিক্ষণ শেষেই সরকারী চাকরির অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্থায়ী চাকরি হিসেবে পদায়ন করার ব্যবস্থা করেন। তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশে চিকিৎসকদের এমবিবিএস পরবর্তী উচ্চশিক্ষার তেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না। তাদের উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডন বা বিদেশের অন্য কোন দেশে যেতে হতো। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সে সুযোগও বন্ধ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু দেশেই উচ্চ প্রশিক্ষিত ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেই তৎকালীন ‘শাহবাগ হোটেল’কেই ‘আইপিজিএম এ্যান্ড আর’-এ রূপান্তরিত করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই পূর্ণাঙ্গ এবং দেশের সর্বপ্রথম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আজকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নিয়েছে। এছাড়াও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে চিকিৎসকদের আন্তর্জাতিক মানের আরও বিশেষজ্ঞ তৈরির প্রয়োজনে ১৯৭২ সালের জুন মাসে অর্ডিনেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ কলেজ ফিজিশিয়ানস এ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস) প্রতিষ্ঠা করেন। মেডিক্যাল উচ্চশিক্ষার এই দুটি বিদ্যাপীঠ থেকে প্রতিনিয়ত অসংখ্য চিকিৎসক বিশেষজ্ঞ হিসেবে উচ্চতর ডিগ্রী গ্রহণ করে দেশের জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া অসংখ্য যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের যথাযথ সুচিকিৎসার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ট্রমাটলজি এ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন বা নিটোর (পঙ্গু হাসপাতাল)। আহতদের দেশেই চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য তিনি বিখ্যাত আমেরিকান অর্থোপেডিক সার্জন ডাঃ গ্রাস্ট তার স্ত্রী ডাঃ মেরিকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানান। তাদের নেতৃত্বেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সুচিকিৎসার সুব্যবস্থা হয়। দেশী ডাক্তাররা যাতে এই চিকিৎসার হাল ধরতে পারেন, সে লক্ষ্যে এই প্রতিষ্ঠানের অধীনেই দেশে সর্বপ্রথম এমএস ও ডি অর্থো নামক উচ্চতর কোর্স ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করেন। একই সময়ে অর্থোপেডিক সার্জারির পাশাপাশি প্লাস্টিক সার্জারি এবং পুড়ে যাওয়া রোগীদের সেবার জন্য প্লাস্টিক সার্জারিরও কার্যক্রম শুরু হয়। ওই সময়ের সেই বিচক্ষণ উদ্যোগের পরিপূর্ণ ফলই আজকের ‘শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি।’ এছাড়াও তিনি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, বিশেষায়িত সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা এবং দেশের তৎকালীন একমাত্র কলেরা হাসপাতালকে আইসিডিডিআর, বি হিসেবে আন্তর্জাতিক মানে রূপান্তরিত করেন। শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্যের দিকেও বঙ্গবন্ধুর সজাগ দৃষ্টি ছিল। আর এই লক্ষ্যেই তিনি ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করণে তিনি মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া জমি প্রদান করার মাধ্যমে বারডেম হাসপাতাল ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গোঁড়াপত্তন করেন, যা বর্তমানে সুনামের সঙ্গে দেশের স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। ‘প্রতিকারের থেকে প্রতিরোধ শ্রেয়’—এ নীতিকে বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি ১৯৭৪ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ প্রিভেন্টিভ এ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন বা নিপসম প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে বাংলাদেশে প্রিভেনটিভ মেডিসিনের মহীরুহ হিসেবে কাজ করে চলেছে। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতিকল্পে গবেষণার কোন বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গবেষণার প্রচলন, মান নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল বা বিএমআরসি প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের সমস্ত মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর প্রতিষ্ঠা করেন। ভবিষ্যতে জনবিস্ফোরণের বিষয়টি উপলব্ধি করে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তিনি পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর স্থাপন করেন। জাতির পিতার স্বাস্থ্য ভাবনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল জনগণের সার্বিক কল্যাণ। তিনি চেয়েছিলেন প্রচুর ডাক্তার হবে, ডাক্তাররা মর্যাদাবান হবে, তাদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত হবে, আর এই ডাক্তাররাই সর্বস্তরের জনগণকে সেবা দেবে। রাষ্ট্র সকল নাগরিকের জন্য সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করবে, আর এর জন্যই তিনি এক সুবিন্যস্ত বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা নিয়েছিলেন। রোগের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের ব্যবস্থা, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও উন্নয়নকল্পে গবেষণা, এমনকি ওষুধ নীতি—কি ছিল না তার পরিকল্পনা ও কর্মযজ্ঞে! প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে তিনি যে রূপরেখা দিয়ে গিয়েছিলেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, আজও সেগুলোর বাস্তবায়নের সর্বাত্বক চেষ্টা চলছে। জনগণ যতটুকু স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন, তা তারই কর্মপরিকল্পনা এবং কর্মের ধারাবাহিক ফসল বলা চলে। বঙ্গবন্ধুর আজন্ম স্বপ্নের স্বাস্থ্যসেবার সফল এবং সার্থকভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তার সুযোগ্য উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনার নেয়া বাস্তবভিত্তিক ও ব্যাপক কার্যক্রম দেশের জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে এবং আগামীতে একটি পূর্ণাঙ্গ, সুপরিকল্পত ও সুদূরপ্রসারী স্বাস্থ্যব্যবস্থা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে, এই হোক আমাদের প্রত্যাশা। লেখক : প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি অধ্যাপক
×