ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ বীর উত্তম সি আর দত্তকে অন্তিম অভিবাদন

প্রকাশিত: ২১:০০, ১ সেপ্টেম্বর ২০২০

সিডনির মেলব্যাগ ॥ বীর উত্তম সি আর দত্তকে অন্তিম অভিবাদন

আমাদের গৌরব স্তম্ভগুলো ধসে পড়ছে একে একে। জীবনের স্বাভাবিক নিয়ম এক সময় থেমে যাওয়া। সে নিয়মে পরিণত বয়সে অসাধারণ একটি জীবন যাপনের পর বিদায় নিয়েছেন চিত্ত রঞ্জন দত্ত। যাকে জাতি চেনে বীর সি আর দত্ত নামে। তখনকার দেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক না। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছিল ধর্মান্ধতার কারণে। উপমহাদেশের দুটি দেশ ভারত আর পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই শুরু সাম্প্রদায়িকতা। এই মানুষটির পাকিস্তানে থাকার কথা না। তার জন্মও হয়েছিল ভারতের শিলং এ। কিন্তু হবিগঞ্জের মানুষ কি আর দেশ ছেড়ে অন্য দেশে উদ্বাস্তু হতে পারে? ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি অসমের শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন চিত্ত রঞ্জন দত্ত। তার পৈত্রিক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। তার বাবার নাম উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত এবং মায়ের নাম লাবণ্য প্রভা দত্ত। শিলংয়ের লাবান গবর্নমেন্ট হাইস্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। পরে তার বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে হবিগঞ্জে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৫১ সালে চিত্ত রঞ্জন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কিছুদিন পর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে কমিশন পান তিনি। ১৯৬৫ সালে সৈনিক জীবনে প্রথম যুদ্ধে লড়েন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে আসালংয়ে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন। ওই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে পুরস্কৃত করে। বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন সি আর দত্ত। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি হেড কোয়ার্টার চিফ অব লজিস্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৯ সালে বিআরটিসির চেয়ারম্যান হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮২ সালে তিনি পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে একজন হিন্দু অফিসার কিভাবে থাকেন বা কিভাবে তার কাজ করতে পারেন সেটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু তিনি পেরেছিলেন। এবং ভারত পাকিস্তান যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে। কাশ্মীর প্রশ্নে দুই দেশের সেই যুদ্ধ এখনও ইতিহাসের এক জটিল বিষয়। সে জটিলতায় তার আনুগত্য বা যোদ্ধাসত্তা মার খায়নি। তবে এটা বলতেই হবে পরিবেশ তার অনুকূলে ছিল না। সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের সময়। তিনি আমাদের দেশকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে এক পাও পিছিয়ে থাকেননি। ভারতে চলে গিয়ে ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার পদে আসীন হবার পর তিনি যে বীরত্ব আর কৌশল উপহার দিয়েছিলেন তার তুলনা বিরল। সিলেটের চা বাগান এলাকায় তিনি যুদ্ধ সংগঠিত করা ছাড়াও পুরো একাত্তরেই ছিলেন সক্রিয়। আর সেই সক্রিয়তার কারণেই দেশ স্বাধীন হবার পর তার ললাটে জুটেছিল বীরোত্তম খেতাব। এরপরের ইতিহাস মূলত তাকে আরও নন্দিত আর উজ্জ্বল করেছে। কারণ দেশ স্বাধীন হবার পর আমরা আর আমাদের আদর্শ বা চেতনায় থাকতে পারিনি। জিয়াউর রহমানের মতো সেক্টর কমান্ডার কিংবা আরও অনেকের পাল্টি খাওয়া ইতিহাস বিকৃতি দেশকে ফেলে দিয়েছিল অন্ধকারে। আজ আমরা বীরোত্তম কাদের সিদ্দিকী কে দেখলে চিনতে পারি না। বুঝতে পারি না ইনিই কি সেই বাঘা সিদ্দিকী যাকে আমরা বেয়নেট হাতে রাজাকার নিধনে দেখেছিলাম? সি আর দত্ত তার অবসর জীবনে এদেশের দুর্বল সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারে আসার আগে এদেশে যখন ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আর সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সরকার রাষ্ট্রকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল তখন তিনি সামনে এসে দাঁড়ান। তার ভাবমূর্তির দুটি দিক ছিল। একদিকে লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা অন্যদিকে একজন বীর। তাই তাকে অবহেলা বা এড়িয়ে চলা ছিল যে কারও জন্য অসম্ভব। একবার তিনি তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়েন। আওয়ামী লীগের সঙ্গেও ছিল অম্লমধুর সম্পর্ক। সত্য কথা বললে যা হয়। তারাও তাকে অপমান করেছিল। তাদের বিরুদ্ধে গেলে তারাও ছেড়ে কথা বলেনি। কিন্তু এটা মানতেই হবে তার জায়গায় তিনি ছিলেন অটল। এদেশের সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন আজীবন। এমন সাহসী সৎ বাঙালী এখন আর চোখে পড়ে না। পরিণত বয়সে চলে গেলেও তার অভাব অনুভূত হবে দীর্ঘকাল। যতদিন গণতন্ত্র অসাম্প্রদায়িকতা আর সাম্যের দেশ না হচ্ছে ততোদিন তার মতো মানুষদের অভাব ঘুচবে না। আর ইতিহাসে তার তারকা খচিত জায়গাটিও চিরকালের। বিদায়ী প্রণাম বীর সি আর দত্তকে [email protected]
×