ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ॥ মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক

প্রকাশিত: ২১:১২, ৩০ আগস্ট ২০২০

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ॥ মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখার সাহস বা দুঃসাহস কোনটাই আমার নেই। তাঁর জীবন, দর্শন, রাজনীতি, দেশপ্রেম, দূরদৃষ্টি, সাহস, প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের বিশালতা আমার এই লেখায় প্রকাশ করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তার পরেও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে একান্তই কিছুকথা স্মৃতি থেকে লেখার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। লেখার শুরুতেই স্মরণ করি জাতির পিতাকে প্রথম দেখার স্মৃতি। সেই ১৯৬৯ সালে কুষ্টিয়া জেলা শহরের ডাকবাংলোয় বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে প্রথম দেখা। স্বৈরশাসক আইয়ুবের কারাগার থেকে এদেশের ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করার পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়। মুক্তির পর দেশব্যাপী সফরের অংশ হিসেবে একই বছরে খোলা জীপে করে জাতীয় নেতৃবৃন্দসহ বীরবিক্রমে তাঁর কুষ্টিয়ায় আগমনে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু সেøাগানে মুখরিত করে লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল সেদিন রাজপথে। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতা, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সঙ্গে কিশোর বয়সে যোগ দিয়েছিলাম বিজয়ের মিছিলে। সে অনুভূতি লিখে প্রকাশ করা কি সম্ভব? প্রগতিশীল রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণের সুবাদে পথভ্রষ্ট হতে পারিনি কখনও, পথ চলা তো একই রয়েছে। এ যেন সমান্তরাল রেলপথ, আদর্শিক জায়গা থেকে বিচ্যুতি হইনি কখনও। তবে লক্ষ্যচ্যুত হয়েছি, এ কথা অস্বীকার করি না। রাজপথ ছেড়ে আসীন হয়েছি উচ্চ আদালতের বিচারকের আসনে। ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এ ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বজ্রকণ্ঠে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পরেই পাকিস্তানী সামরিক জান্তা গ্রেফতার করেন বঙ্গবন্ধুকে। গ্রেফতারের পূর্বেই তিনি ধানমণ্ডির ৩২ নং রোডের বাড়ি থেকেই জাতীয় নেতৃবৃন্দকে মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশনা দিয়েছেন। সে মতেই ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামানসহ অন্যান্য জাতীয় নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে গঠিত প্রথম মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নবগঠিত সরকারের নেতৃত্বে আইনানুগভাবে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীকে রণাঙ্গনের প্রধান (সেনাপ্রধান) হিসেবে নিয়োগ দেন, যা ১২ এপ্রিল ১৯৭১ থেকে কার্যকর হয়। সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিশেষ বেঞ্চে স¤প্রতি মাতৃভাষায় প্রকাশিত একটি রায়ে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের মুক্তিযুদ্ধে অবদানসহ ঐতিহাসিক ভূমিকা আলোচনায় প্রাসঙ্গিকভাবেই বিষয়টি নিয়ে ইতিহাস সন্ধানে মনোনিবেশ করি। কারণ, বঙ্গবন্ধুই তো মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক। মামলাটি শুনানিকালে বাহিনীর ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর থেকে আজ অবধি প্রায় ৪৯ বছর যাবত রণাঙ্গনের প্রধান সেনাপতি কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক’ হিসেবে সরকারী ও বেসরকারী প্রকাশনায় প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়ে আসছে। বিষয়টি বড় অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর মনে হওয়ায় আমি আমলে নেই। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে পারিবারিকভাবে সরাসরি জড়িয়ে থাকার সৌভাগ্য হওয়ায় আমার দেখা মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি থেকে সঙ্গত ও ঐতিহাসিক কারণেই ইতিহাসের এই ‘ভ্রমটি’ সংশোধনের তাড়না আমার বিবেক থেকে দৃঢ়ভাবে অনুভূত হওয়ায় প্রয়োজনীয় গবেষণা অব্যাহত রাখি। তা ছাড়া ওই মামলার প্রেক্ষাপটে বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হওয়ায় আমার লেখা রায়ে, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক’ উল্লেখ করেছি। কারণ বিষয়টি কেবলমাত্র আবেগ তাড়িত নয় এটা ইতিহাস এবং দালিলিকভাবে নির্ধারিত। সংবিধানের ৬১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- The supreme command of the defence service of Bangladesh shall vest in the President and the exercise thereof shall be regulated by law. বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বিভাগসমূহের সর্বাধিনায়কতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত হবে এবং আইনের দ্বারা তার প্রয়োগ নিয়ন্ত্রিত হবে। আভিধানিক ও সাংবিধানিকভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ‘মহানায়ক’-এ বিষয়ে কারও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আমার সাংবাদিক বন্ধুর নিকট থেকে প্রাপ্ত একটি নিয়োগপত্র দৃষ্টে স্পষ্টভাবে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয় যে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীকে কেবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদায় ঈড়সসধহফবৎ রহ ঈযরবভ ড়ভ ঃযব ইধহমষধফবংয ঋড়ৎপবং হিসেবে নিয়োগের মাধ্যমে রণাঙ্গনে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের জন্মের ৪৯ বছর পর জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে প্রকাশিত পিলখানা হত্যা মামলার রায়ে প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিক কারণেই এই ঐতিহাসিক সত্যটি মামলার পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করেছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই ‘ভ্রমটি’ সংশোধনের প্রয়াসের যথার্থতা বিবেচনার দায় ইতিহাসবিদের ওপরেই বর্তাবে। এ প্রজন্ম ভুল করলেও আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সন্ধানে নিশ্চয়ই আরও অধিক গবেষণা করবে। এটিই ইতিহাসের অমোঘ বিধান। তবে বিস্ময়ের বিষয় যে, মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের অর্ধশত বছর পরেও সরকারী প্রকাশনা ও বিভিন্ন দলিলপত্রে কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীকেই ‘মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক’ হিসেবে স্থান করে দিয়েছে। কিন্তু কেন? এটা কি অনিচ্ছাকৃত ভুল, না পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা, তা খতিয়ে দেখার সময় কি এখনও আসেনি? ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ধানম-ির ৩২নং রোডের বাড়ি থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানী সামরিক জান্তার কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও, এর ভিত্তি রচিত হয়েছিল আরও ২৩ বছর আগে। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পাক-ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমন্বয়ে পাকিস্তান নামক এক অদ্ভুত ধরনের রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই ১৯৫২, ৫৪, ৫৬, ৫৯, ৬৬, ৬৯-এর পথ পেরিয়ে ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচন ও ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, ৬ দফা, আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলা, গণভ্যুত্থান, সবকিছুই তো বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং তাঁর নামেই পরিচালিত হয়েছিল বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। তিনিই তো স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক। কোন সামরিক মেজরের বাঁশির শব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের ঝঁঢ়ৎবসব পড়সসধহফ এ ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সর্বজন শ্রদ্ধেয় নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন যথার্থই বলেছেন, ‘বর্তমান যুগের ইতিহাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক জন্ম একটি বিরাট ঘটনা। এই মহান যাত্রার কর্ণধার মহীয়ান বঙ্গবন্ধু। সুচিন্তিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা যে সম্ভব, শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রমাণ সমগ্র পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালীর বন্ধু ও অধিনায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবজাতির পথ-প্রদর্শক ও মহান নেতা। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর উৎসাহ শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সভ্যতা, সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা, সব মানুষের মানবাধিকারের স্বীকৃতি। তাঁর সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত পৃথিবীও স্বীকার করবে-এ আশা আমাদের আছে এবং থাকবে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তির আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যে শেখ মুজিবের বিশাল মহিমার একটি প্রকাশ যেমন আমরা দেখতে পাই, তাঁর মহামানবতার আরেকটি পরিচয় আমরা পাই তাঁর চিন্তাধারার অসাধারণতায়। পৃথিবীর ইতিহাসের এই কঠিন মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর জীবন, আদর্শ ও নেতৃত্ব¡ নিয়ে আলোচনার খুবই প্রয়োজন আজ। তাঁর আদর্শ বোধের গভীরতায় এবং চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্যে আমরা আবারও অনুপ্রাণিত হব।’ বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য সহচর বাংলাদেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ তাঁর স্মৃতি থেকে লিখেছেন- বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখা এবং প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল আমার। আমি তার চিন্তাচেতনায়, মননে স্বাধীনতাকে দেখেছি। আর তাই তো ১৯৫২ সালের মহান ভাষা-আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সিঁড়ি পেরিয়ে তিনি গোটা জাতিকে স্বাধীনতার স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দেন। তাঁর নেতৃত্বে বাস্তবায়িত হয় মহান স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ। বিশ্ব-মানচিত্রে ঠাঁই করে নেয় গাঢ় লাল-সবুজের প্রিয় জাতীয় পতাকা। বঙ্গবন্ধু মনপ্রাণ উজাড় করে ভালবাসতেন বাংলাদেশ ও বাঙালীকে। হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতেন বাঙালীর দুঃখ-কষ্ট। বাঙালীর জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে তিনি মিশে আছেন বাংলায়। দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় তাঁর স্মৃতি অমর হয়ে আছে, থাকবে বহুকাল-চিরকাল। বাঙালীর প্রতিটি বসতভিটা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, দিগন্ত প্রসারিত সবুজে উজ্জ্বল হয়ে থাকা বঙ্গবন্ধু বিশ্ব-দরবারেও সমানভাবে উদ্ভাসিত হয়ে আছেন। আজও বিশ্ববাসী বঙ্গবন্ধুর নাম শুনে শ্রদ্ধায় নত হয়। বঙ্গবন্ধুকে নিঃস্ব-নিরন্ন, দিগভ্রান্ত অসহায় মানুষের অধিকার রক্ষার মূর্তপ্রতীক হিসেবে অভিষিক্ত করে। আমার এখনও চোখে ভাসে, মন-মননে পাহাড় সমান উচ্চতার তেজোদীপ্ত এই মানুষটি জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় কী সাবলীল বক্তুতাই না করলেন। বাংলায় ভাষণ দিয়ে দারুণ এক অসাধ্য সাধন করে গেছেন এই মহান ব্যক্তিত। আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রথম বাংলাভাষী এই বক্তার ভাষণ শুনে সেদিনের উপস্থিত রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সকলে বিমোহিত হোন। ভাষণ শেষ হওয়ার পর নিজ নিজ আসন ছেড়ে এসে করমর্দন করে শুভাশিষ জানান বঙ্গবন্ধুকে। জাতিসংঘে সেই দিন বঙ্গবন্ধু মন্ত্রমুগ্ধের মতো বক্তৃতা দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাঙালী জাতিকে সম্মানিত করেছেন তিনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপোসহীন। পর্বতসম ব্যক্তিতের অধিকারী এই মানুষটি খুব সহজেই মানুষকে কাছে টেনে নিতেন। মাঠ পর্যায়ের কর্মীদেরও নাম মনে রাখতেন। সঠিক সময়ে নির্ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় তাঁর কোন তুলনা ছিল না। তথাকথিত আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু হয় ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন। এই বিচার যে একটা প্রহসন ও বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝোলানোর যড়যন্ত্র, তা বুঝতে একটুও কষ্ট হয়নি এদেশের মানুষের। আসাদ, মতিউর, রুস্তম, মকবুল, সার্জেন্ট জহুরুল হক, ড. শামসুজ্জোহাসহ অনেকের রক্তের বিনিময়ে ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান সেনানিবাস থেকে মুক্তি পান। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সংবর্ধনা সভায় আসেন শেখ মুজিব। গোধূলিলগ্নে মঞ্চে আসীন হন তিনি। কেঁপে ওঠে সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যান। সমবেত সকলের আকাক্সক্ষার বিস্ফোরণ ঘটে কেবল একটি কণ্ঠে। ‘আজ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু’-বাংলার বন্ধু-যিনি ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও বাঙালীর জয়গান গেয়েছেন। তাঁর প্রতি আমাদের শত সহস্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। বাঙালী জাতির ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। ইতিহাসে তাঁর স্থান চির অমলিন, অমোঘ। তিনিই ছিলেন বাঙালী জাতির সবচেয়ে গৌরবপূর্ণ স্বাধীনতার রূপকার, বাঙালী জাতির দুঃসময়ের কা-ারি, তিনি ইতিহাসের মহানায়ক। ওই স্থানটি শুধু তাঁর জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। তাঁকে যতই ভুলে যাবার বা ভুলিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা হোক বা তাঁর জায়গায় কাউকে বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হোক, তাতে কোন লাভ হবে না ইতিহাস বিকৃতিকারীদের- এটিই ইতিহাসের বিধান। বিচার বিভাগ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ। তিনি বিচারপ্রার্থী জনগণের দোরগোড়ায় ন্যায়বিচার পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই ভূখ-ে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও দক্ষ বিচার বিভাগ গঠনের জন্য দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও স্বাধীন বিচার বিভাগ গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। সুপ্রীম কোর্টসহ আমাদের বিচার বিভাগ বঙ্গবন্ধুর হাতেই সৃষ্টি হয়েছে। জাতির পিতার নির্দেশিত পথ ধরেই তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নেয়ার কাজে নিরত আছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের বিচার বিভাগ হবে গণমুখী, দেশপ্রেমের সঙ্গে মানুষের সুখ-দুঃখ উপলব্ধির মাধ্যমে আইনানুগ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। বিচারের মর্মবাণী যেন বাংলার সর্বস্তরের প্রতিটি মানুষের বুঝতে কষ্ট না হয়। বিচার প্রার্থী প্রতিটি মানুষ যাতে সহজে বুঝতে পারে যে, আদালতের রায়ে তারা ন্যায়বিচার পেয়েছে। এটা প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক। এ অনুভূতি থেকে ১৯৭১ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একডেমির একুশের অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার প-িতরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপরে বাংলাভাষা চালু হবে, তা হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব। সেই বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ বঙ্গবন্ধুর চেতনা থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রায়ই বিচারকদের মাতৃভাষায় রায় লিখতে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে আসছেন। স্বাধীন বিচার বিভাগের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু ছিলেন বদ্ধপরিকর। ১৯৭২ সালে রচিত আমাদের সংবিধানের ২৭, ৩১, ৩২, ৩৩ অনুচ্ছেদে আইনের শাসন সম্পর্কে বলা হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশের স্বাধীন বিচার বিভাগের মাধ্যমেই কেবল কোন রাষ্ট্রে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আইনের শাসন ছাড়া গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা করা দুরূহ। সে কারণে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। লেখক : সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপীল বিভাগের সরকারী কৌঁসুলি
×