ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নিকোলা টেসলা ॥ আলোর দেবতা

প্রকাশিত: ২৩:৪৩, ২৯ আগস্ট ২০২০

নিকোলা টেসলা ॥ আলোর দেবতা

প্রমিথিউস। পৌরাণিক গল্পগাথার নায়ক। নরক যন্ত্রণা নিশ্চিত জেনেও স্বর্গ থেকে চুরি করে এনেছিলেন আগুন- মানুষের স্বার্থে। যে আগুন আলো হয়ে পথ দেখিয়েছে সভ্যতাকে। নিকোলা টেসলা। কোন পৌরাণিক গল্পগাথার নায়ক নন। এক বাস্তবতা। আলোর জগতে এমন এক বাস্তবতা যে, তার আবিষ্কৃত অলটারনেটিভ কারেন্ট সিস্টেম শত বছর পেরিয়েও আলোকিত করে চলেছে সভ্যতাকে। তাই তার পরিচয়- আধুনিক প্রমিথিউস। বিশ্ব মানচিত্রে বর্তমান ক্রোয়েশিয়ার ছোট্ট শহর সিমালজান। সময় ঠিক মধ্যরাত ১০ জুলাই ১৮৫৬। সিমালজান শহরের বাসিন্দা মিলিটিন টেসলা-ডুকা মেনডিক দম্পতির কোলজুড়ে এলো এক শিশু। রাতটি ছিল প্রবল ঝড়, বৃষ্টি আর বিদ্যুত চমকানো। আবহাওয়া দেখে ধাত্রী মন্তব্য করেন, ‘এই শিশুটি হবে ঝড়ের সন্তান।’ ফিরতি মন্তব্যে জননী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘না, ও হবে আলোর সন্তান।’ অদৃষ্ট বুঝি হেসেছিল অলক্ষ্যে। কারণ দুটো উক্তিই সত্য প্রমাণিত হবে শিশুটিকে ঘিরে? হ্যাঁ, বিজ্ঞানের জগতে ঝড়ের মতোই আবির্ভাব ছিল তার। ঝড় তুলেছে তার প্রতিটি ভাবনা কিংবা সৃষ্টি। আর আলো? সারা পৃথিবী আজ তাকে জানে, ‘দি মাস্টার অব লাইট।’ ‘দি লাইটনিং ম্যান’ অথবা ‘আলোর দেবতা’ পরিচয়ে। যার আলোয় আলোকিত সারাবিশ্ব। নিজ সময় থেকে শত বছর এগিয়ে থাকা মেধা নিয়ে। ধারণার ব্যাপ্তি আর আবিষ্কারের বিশাল পরিধিতে বিস্তৃত তিনি। বাণিজ্যে উদাসীন, মানবতাবাদী, নারী বিদ্বেষ, বাতিকগ্রস্ততা, জুয়াতে আসক্তি, শূন্যে আওয়াজ শোনা, আধ্যাত্মিকতা নিয়েও তিনি আলোচিত। নির্ঘুম, নিরলস কাজের পরিণতিতে ক্ষ্যাপাটে প্রতিক্রিয়া, জীবনযাপনের ধরন সবকিছু নিয়ে নিজ সময়ে সারাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি চর্চিত সিমালজানের জন্ম নেয়া সেই শিশুটির নাম- নিকোলা টেসলা, বিজ্ঞানের ইতিহাসে যার আরেক পরিচয়, ‘দি ম্যাড জিনিয়াস’। আমাদের আজকের সভ্যতা তিলে তিলে গড়ে উঠেছে কিছু স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নকে ভিত্তি করে। বিজ্ঞানের জগতে স্বপ্নদ্রষ্টা এক রাজপুত্র- নিকোলা টেসলা। টেসলা কেবল স্বপ্ন দেখেননি; তা পরিণত করেছেন বাস্তবতায়। এমনকি তার নিজ সময়ে বাস্তবায়নে ব্যর্থ ধারণাগুলো পরবর্তী প্রজন্মকে পথ দেখিয়েছে নতুন উদ্ভাবনে। শৈশবের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন নায়াগ্রা জলপ্রপাতের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন করে। কাজ করেছেন তখনকার সময়ে অকল্পনীয় গাইডেড মিসাইল কিংবা ওয়্যারলেস মেসেজিংয়ের ধারণা নিয়ে। সৃষ্টির মধ্যগগনে টেসলা ছিলেন তৎকালীন সমাজের মধ্যমণি। বলা হয়, টেসলা হতে পারতেন ইতিহাসের প্রথম বিলিওনেয়ার। কিন্তু অর্থে খুব বেশি আগ্রহ ছিল না তার। তার ভাষায়, অর্থ আমার কাছে খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে না, অন্যদের মতো। আমার অর্জিত সব অর্থই ব্যয়িত আবিষ্কারের পেছনে, যা কাজে লাগবে মানব কল্যাণে। সম্ভবত ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রতারণার শিকার অন্যতম নাম নিকোল টেসলা। প্রতারিত হয়েছেন বহুবার, বহুভাবে। শৈশব থেকেই তিনি ভিন্ন। তার ভাষায়, ‘শৈশবেই আমি সূর্যরশ্মির আলোতে বিভিন্ন ইমেজ দেখতে পেতাম। আমি নিজেও নিশ্চিত হতে পারিনি সেগুলো কতটা বাস্তবানুগ। উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, শৈশবে আমি যখন নায়াগ্রা জলপ্রপাতের বর্ণনা শুনি, আমি অভিভূত হয়ে পড়ি। আমার কল্পনায় ভেসে ওঠে জলপ্রপাতের শক্তি ব্যবহার করে একটি বড় চাকা ঘুরছে। তিনি তার চাচাকে দৃশ্যটি নিয়ে বলেন, আমি একদিন আমেরিকায় যাব এবং স্বপ্নে দেখা দৃশ্যটি নিয়ে কিছু করে দেখাব। ১৮৭৫ এ টেসলা অস্ট্রিয়ার গ্রাহ শহরে আসেন প্রকৌশল বিদ্যা অধ্যয়নের লক্ষ্যে। সেখানে তড়িৎ প্রকৌশলে তার আগ্রহ রীতিমতো প্রেমে পরিণত হয়। তার ভাষায়, প্রতিটি স্পার্ক আমার মাথায় হাজারটা প্রতিধ্বনি হয়ে বাজত। ১৮৩১ এ মাইকেল ফ্যারাডে ব্রিটেনে প্রথম ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ইনডাকশন থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করেন। তখনকার ডিসি মোটর জেনারেটরের গঠনগত ত্রুটি নির্দেশ করে ছাত্র টেসলা সেগুলো উন্নতকরণে তার শিক্ষকের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করেন। জবাবে প্রফেসর ক্লাস ভর্তি ছাত্রের মাঝে বলেন, ‘মি. টেসলা তুমি এটি কখনই সফল করতে পারবে না।’ টেসলার জীবনের এই অধ্যায়টি বৈচিত্র্যপূর্ণ। প্রবলভাবে জুয়াতে আসক্ত হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। যদিও পরের বছরই হারানো অর্থ জিতে নেন। কিন্তু পরিণতি- অসমাপ্ত শিক্ষাজীবন ও কলেজ ত্যাগ। একই সময়ে তিনি শিকার হন নাভার্স ব্রেক ডাউনের। ১৮৮১ তে টেসলা বুদাপেস্টের সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিসে ড্রাফটসম্যান হিসেবে যোগ দেন। এ সময় তিনি টেলিফোন রিপিটার বা এমপ্লিফায়ারকে নিখুঁত রূপ দেন; যদিও তার কোন প্যাটেন্ট ছিল না। ইতোমধ্যে ১৮৮০-এর জানুয়ারিতে টমাস এডিসন আমেরিকার বিদ্যুত বাতির প্যাটেন্ট লাভ করেছেন। তৈরি হচ্ছে দুই মহারথীর ইতিহাসখ্যাত ‘বিদ্যুত যুদ্ধে’র ক্ষেত্র। যা তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে লুক্কায়িত। টেসলাকে তখন অনবরত তাড়িত করে ফিরছে এসি মোটরের ধারণা। তার তখনকার অনুভূতি ছিল, আমি আমার কক্ষ থেকে তিন কক্ষ দূরে থাকা ঘড়ির টিক টিক শব্দ শুনতে পেতাম। শুনতে পেতাম এক মাইল দূর দিয়ে যাওয়া ক্যারিজের শব্দ। লোকোমটিভ ইঞ্জিনের শব্দ আমার মস্তিষ্কে বিস্ফোরণের মতোই আঘাত করে। আমি বেদনায় কুঁকড়ে যাই। সেই বেদনা থেকে মুক্তি পেতে আমি হাঁটার সিদ্ধান্ত নেই। সিটি পার্কে হাঁটার একদিনে সূর্য যখন অস্ত যাচ্ছে হঠাৎ করেই তার মাথায় আসে এসি মোটরের ডিজাইন। তিনি তাৎক্ষণিক হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসেন এবং একটি কাঠির সাহায্যে মাটিতেই তার এসি মোটরের প্রথম ডিজাইনটি অঙ্কন করেন। টেসলা তখন নিশ্চিত, তার পক্ষে শিক্ষকের অসম্ভব আখ্যায়িত ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেয়া সম্ভব। আমেরিকা যাওয়ার পূর্বে, টেসলা ২ বছর প্যারিসে কাজ করেন কন্টিনেন্টাল এডিসন কোম্পানিতে। সেখানে তিনি ডায়নামোর ডিজাইন করেন। ১৮৮৩ স্ট্রাসবার্গে প্রোটো টাইপ অব ইনডাকশন মোটর তৈরি করেন এবং সফল পরীক্ষা করেন। কিন্তু ইউরোপে কেউ আগ্রহী না হওয়ায় টেসলা নিউইয়র্ক যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার আমেরিকা যাত্রা পথটাও মসৃণ ছিল না। জাহাজে সব অর্থ ও টিকেট হারান। কয়েকবার দুর্ঘটনার শিকার হন নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বেঁচে যান একবার। শেষ পর্যন্ত যখন আমেরিকার মাটিতে পা রাখেন তখন সম্বল কেবল পকেটে ৪ সেন্ট, বুকভরা স্বপ্ন আর টমাস এডিসনকে লেখা তার সহকর্মী ইউরোপের স্বনামধন্য বিজ্ঞানী চার্লস ব্যাটলারের দেয়া পরিচিতিমূলক এক পত্র। যেখানে ব্যাটলার লিখেছেন, প্রিয় এডিসন, আমি দুজন গ্রেটম্যান দেখেছি আমার জীবনে যার একজন তুমি আরেকজন এই যুবক। ২৮ বছর বয়সে জুনের ৬, ১৮৮৪ সালে পা রাখেন নিউইয়র্ক শহরে এক অখ্যাত স্বপ্নদ্রষ্টা যুবক। যিনি অচিরেই পাল্টে দিতে যাচ্ছেন সভ্যতাকে। টেসলা তার স্বপ্নপুরুষ এডিসনের সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং এডিসন মেশিন ওয়াকর্স অন ম্যানহাটন’স লোয়ারইস্ট সাইডে যোগ দেন। টেসলা এডিসন কোম্পানির ডাইরেক্ট কারেন্ট জেনারেটরকে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত করে ডিজাইনের প্রস্তাব করেন এডিসনের কাছে ১৮৮৫ তে। তিনি বলেন, এডিসনের মোটর ও জেনারেটর তার পক্ষে রি-ডিজাইন করা সম্ভব যা হবে আরও কার্যকর ও আর্থিকভাবে লাভবান। এডিসনের উত্তর ছিল, তুমি যদি এটি করতে পার তবে তোমার জন্য রয়েছে ৫০ হাজার ডলার। কয়েক মাসের শ্রমে টেসলা কাজটি সমাপ্ত করেন। প্রতিশ্রুত অর্থ চাইলে এডিসন হেসে উঠে বলেন, টেসলা তুমি আমাদের আমেরিকান হিউমার বোঝ না! পরিবর্তে এডিসন তাকে সপ্তাহে ১০ ডলারের মজুরি ১৮ ডলারে বৃদ্ধির কথা বলেন। টেসলা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাৎক্ষণিক পদত্যাগ করেন। এডিসনের কোম্পানি ত্যাগের পর ১৮৮৬ তে লেন ও বেনজামিন নামে দুজন বিনিয়োগকারী পান। প্রতিষ্ঠা করেন ‘টেসলা ইলেকট্রিক লাইট ও ম্যানুফ্যাকচারিং’ কোম্পানি। আর্ক লাইট উন্নতকরণের পাশাপাশি তিনি ‘ডায়নামো ইলেকট্রিক মেশিন কমিউটার’ ডিজাইন করেন যা তার ইউএসএতে প্রথম প্যাটেন্ট। এখানেও পরিণতি সুখকর হয়নি। অংশীদারদের প্রতারণার শিকার হয়ে শূন্য পকেটে বেরিয়ে আসেন। ১৮৮৬/৮৭’র শীতে তাকে প্রতিদিন দুই ডলার মজুরিতে গর্ত খুঁড়তে হয়েছে। ১৮৮৭ সালের এপ্রিলে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন প্রতিনিধি এস ব্রাউন ও এ্যাটনি এফ পিকের সহায়তায় টেসলা প্রতিষ্ঠা করেন ‘টেসলা ইলেকট্রিক কোম্পানি।’ তিনি নতুন ধরনের ইলেকট্রিক মোটর, জেনারেটর ও অন্যান্য ডিভাইস নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৮৮৭ তে টেসলা অলটারনেটিভ কারেন্ট পরিচালিত ইনডাকশন মোটরের ডিজাইন উন্নত করেন। এই উদ্ভাবনটি ১৮৮৮তে প্যাটেন্ট লাভ করে এবং এতে কোন কমিউটার প্রয়োজন হতো না। সে বছরই ইলেকট্রিক্যাল ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের সম্পাদক টমাস মার্টিন, আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিঃ (বর্তমানে আই ই ই ই)-এ টেসলার উদ্ভাবন নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। বিষয়টি জর্জ ওয়েস্টিং হাউসের নজরে আসে। জুলাই ১৮৮৮তে ওয়েস্টিং হাউস, টেসলার ‘পলিফেস ইনডাকশন মোটর ও ট্রান্সফরমার’র ডিজাইন ৬০ হাজার ডলারে কিনে নেন। সঙ্গে প্রতি হর্স পাওয়ার এসির জন্য টেসলা পাবেন ২.৫০ ডলার। এ ছাড়াও তিনি টেসলাকে তার পিটার্সবার্গ ল্যাবে নিয়োগ দেন মাসিক ২০০০ ডলার সম্মানীর বিনিময়ে। পরের পাঁচ বছরে ২২টি প্যাটেন্ট তার নামে তালিকাভুক্ত হয়। ১৮৮০-এর শেষ দশকে বিখ্যাত এডিসন এক প্রচার যুদ্ধ শুরু করেন টেসলার অলটারনেটিভ কারেন্টের বিরুদ্ধে। শুরু হয় বিখ্যাত ‘বিদ্যুত যুদ্ধ’। এডিসন বলেন, আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা অলটারনেটিভ কারেন্ট নিষিদ্ধ হোক। এটি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়, এমনকি তার কর্মচারীরা এ/সির বিপদ বোঝাতে বিভিন্ন পশুর ওপর তা প্রয়োগ করে তাদের হত্যা করেন। এসব টেসলাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। এই ‘বিদ্যুত যুদ্ধ’ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় ১৮৯৩-এ-‘কলম্বিয়ান এক্সপোজিশন ইন শিকাগো।’ বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত পৃথিবীর প্রথম মেলা। এডিসন তার কোম্পানি নিয়ে জেনারেল ইলেকট্রিকের সঙ্গে ততদিনে একীভূত। তারা মেলার কাজটির জন্য ১ মিলিয়ন ডলার দাবি করেন। অপরদিকে টেসলার কোম্পানির প্রস্তাব ছিল হাফ মিলিয়ন ডলার। স্বাভাবিকভাবেই টেসলা কাজটি পান। প্রতিক্রিয়াতে জি-ই টেসলার কোম্পানির কাছে তাদের বাল্ব বিক্রিতে অসম্মতি জানায়। টেসলার কোম্পানি ওই সময় ‘টু পিস স্টপার ল্যাম্প’ উদ্ভাবন করে এবং মেলা আলোকিত করতে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। শিকাগো টেসলাকে সুযোগ করে দেয় নিজেকে প্রমাণ করে ইতিহাস সৃষ্টির। পহেলা মে, ১৮৯৩ লাখো লোকে মুখরিত মেলা। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে কেবল একটি সুইচ অন করা। আলোকিত মেলা প্রাঙ্গণ, প্রমাণিত টেসলা। ১৮৯৩-এ এডওয়ার্ড ডিন এডামস নায়াগ্রা ফলস ক্যানটর্যাকট কনস্ট্রাকশন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। নায়াগ্রার জলরাশি ব্যবহার করে বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য তার কাছে বিভিন্ন প্রস্তাব আসে। তিনি টেসলার সাহায্য প্রার্থী হলে টেসলা তাকে পরামর্শ দেন যে, একটি টু ফেসড সিস্টেম বিষয়টিকে সহজে রূপ দিতে পারে। টেসলার কোম্পানি ওয়েস্টিং হাউস ইলেকট্রিক নায়াগ্রা ফলসে একটি টু ফেস এসি জেনারেটিং সিস্টেম স্থাপনের কাজ পায়। কাজটির সাফল্য টেসলার শৈশবের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে। বিদ্যুত যুদ্ধে টেসলার বিজয় চূড়ান্ত রূপ পায়। ১৮৯৭-এ ওয়েস্টিং হাউস টেসলাকে তার অর্থ সঙ্কটের কথা জানিয়ে প্রতি এ/সি হর্স পাওয়ারের জন্য ২.৫০ ডলার প্রদানের দায় থেকে অব্যাহতি চান। তিনি টেসলাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হন। মাত্র ২ লাখ ১৬ হাজার ডলার টেসলাকে প্রদান করে টেসলার প্যাটেন্টের একক স্বত্বের অধিকারী হন। অথচ চুক্তিটি টেসলাকে বিলিওনেয়ার করে তুলতে পারত। টেসলা এখানেই থেমে যাননি। রেডিওর প্রথম আবিষ্কর্তা হিসেবে আমরা মার্কনির নাম জানি। কিন্তু ১৯৪৩-এ মার্কিন সুপ্রীমকোর্টের দেয়া একটি আদেশ ভিন্ন কথা বলে। আদালতে এটি প্রমাণিত যে টেসলা মার্কনির কয়েক বছর আগেই রেডিও উদ্ভাবন করেছিলেন। টেসলা বিশ্বের প্রথম রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস উদ্ভাবন করেন। তিনি একটি মডেল বোটকে পরীক্ষামূলকভাবে রিমোট দ্বারা পরিচালিত করেন ১৮৯৮-এ। প্যাটেন্ট নং ৬১৩৮০৯। টেসলা উদ্ভাবিত ‘টেসলা কয়েল’ সত্যতাকে এগিয়ে দিয়েছে এক ধাপ। এক্স-রে সম্পর্কিত বিতর্ক তার জীবনের আরেক অধ্যায়। এ ছাড়াও তিনি এটমোসফেরিক ইলেকট্রিসিটিতে আগ্রহী ছিলেন। কলোরাডো স্প্রিংয়ে উৎপাদন ও সফল পরীক্ষা করেছেন কৃত্রিম বিদ্যুত। ১৮৯৯ এ জন জ্যাকব এস্টোর একটি নতুন উন্নত লাইটিং সিস্টেম তৈরির জন্য টেসলাকে ১ লাখ ডলার দেন। যার সবটাই টেসলা ব্যয় করেন কলোরাডো স্প্রিং গবেষণায়। ছিলেন রাডার সিস্টেমের স্বপ্নদ্রষ্টা। তার অন্যতম উদ্ভট ধারণা ছিল ‘টেসলা এসকেলেটর।’ এ বিষয়ে ওয়ার্ল্ড টুডে তে ঘরশড়ষধ ঞবংষধ উৎবধসবৎ শিরোনামে এলেন বেনসনের একটি লেখা প্রকাশিত হয় ১৯১২-এর ফেব্রুয়ারিতে। দুভাগে বিভক্ত ধরণীর ছবিসহ ক্যাপশন ছিল- টেসলা দাবি করেছেন কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি পৃথিবীকে কম্পনের এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন যে এটি তার কক্ষ থেকে ১০০ ফিট ওপর-নিচে সরে যাবে যার অর্থ সভ্যতার ধ্বংস। তার মতে, এই গবেষণা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীকে দুভাগ করে দেবে। ১৯১২ তে তার অভিনব ধারণা ছিল বিদ্যুত শক্তি ব্যবহার করে দুর্বল ছাত্রদের মেধার উন্নয়ন। কাজ করেছেন লেজার নিয়ে। আর তার কল্পিত ‘ডেথ বিম’ তো আজও আলোচিত। তার পঞ্চাশতম জন্মদিনে ১৯০৬-এ তিনি বর্ণনা করেন ২০০ হর্স পাওয়ারের ১৬ হাজার ৎঢ়স ব্লেডলেস টারবাইনের ধারণা। যা টেসলা টারবাইন নামেও পরিচিত। তার সবচেয়ে আলোচিত ও ব্যর্থ ধারণা ছিল ফ্রি এনার্জি ও ওয়্যারলেস মেসেজিংয়ের। এ প্রকল্পে জেপি মরগ্যান প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার বিনিয়োগ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে আরও অর্থের প্রয়োজন হওয়ায় মরগ্যান অসম্মতি জানান। অর্থাভাবে পরিত্যক্ত হয় প্রকল্পটি। টেসলার সর্বশেষ প্যাটেন্টটি ছিল বাইপ্লেনের যা আলোর মুখ দেখেনি। বলা হয় তার অর্জিত প্যাটেন্ট সংখ্যা প্রায় ২৭৮। এ ছাড়াও টেসলার অসংখ্য উদ্ভাবন প্যাটেন্ট দ্বারা সুরক্ষিত ছিল না। তার চুরি যাওয়া উদ্ভাবন নিয়ে বিতর্ক এখনও চলমান। এমনও বলা হয়, মার্চ ১৮৯৫ এ টেসলার ফিফথ এ্যাভিনিউ ল্যাবরেটরি আগুনে পুড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার শতাধিক উদ্ভাবন, মডেল, নোট, ল্যাবরেটরি ডাটা সব ধ্বংস হয়ে যায়। বলা চলে একজন মানুষের অর্ধেক জীবনের অর্জন পুড়ে যায় আগুনে। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতা আর ৬৪ কেজি ওজনের টেসলার বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ সম্পাদক আর্থার ব্রিসবেন বলেন, টেসলা লম্বা, শুকনো ও সিরিয়াস ধরনের মানুষ। তার নীল চোখে আলো জ্বলত। তার মুখের ভাব দেখে মনের তল পাওয়া যেত না। তিনি মাঠের কর্মী ছিলেন না। তার জীবন তিনি যাপন করেছেন মস্তিষ্কের উপরের অংশে। যেখানে ধারণা জন্ম নেয় এবং অসংখ্য ধারণা ধারণ করার ক্ষমতা তার মস্তিষ্কের ছিল। আলোচিত সব মানুষের মাঝেও তিনি আলাদা, সব সময়ই তার নিজের কিছু বলার থাকে। তিনি ফটোগ্রাফিক মেমোরির অধিকারী ছিলেন। আটটি ভাষা জানতেন, যে কোন ডিজাইন তিনি মাথায় রাখতে পারতেন। কোন কাগজপত্রের সাহায্য ছাড়াই পারতেন তা নির্মাণ করতে। তার দাবি মতে তিনি দিনে দুই ঘণ্টা ঘুমাতেন। ল্যাবরেটরিতে একটানা বিরতিহীন ৮৪ ঘণ্টা কাজের রেকর্ড তার আছে। আজীবন ব্যাচেলর। ধর্মে ক্রিশ্চিয়ান যদিও বৌদ্ধ মতবাদ দ্বারাও প্রভাবিত হন। সৃষ্টির মধ্যগগনে তিনি ছিলেন নিজ সমাজের মধ্যমণি তার সময়ে বিশ্বের অন্যতম আলোচিত ব্যক্তিত্ব। এক কথায় সেলিব্রেটিদের সেলিব্রেটি। তাকে নিয়ে ছড়িয়ে পড়া সবচেয়ে বড় গুজবটি ছিল বোধকরি নোবেলপ্রাপ্তির। ৬ নবেম্বর ১৯১৫ রয়টার্স নিউজ এজেন্সি লন্ডন থেকে জানায়- সে বছর পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেয়েছেন টমাস এডিসন ও নিকোলা টেসলা। যদিও তা সত্য ছিল না। তাকে নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য গ্রন্থ। তিনি প্রকাশিত তাকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র, অসংখ্য ডকুমেন্টারি, রেডিও, মঞ্চনাটক, কমিকস ও ভিডিও গেমসে। তার কল্পনাকে ভিত্তি করে রচিত হয়েছে সায়েন্স ফিকশন। তার ৭৫তম জন্মদিনে টাইম ম্যাগাজিন তাকে প্রচ্ছদে ঠাঁই দেয়। ৭০-এর অধিক নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চিঠি লেখেন যাদের একজন আলবার্ট আইনস্টাইন। তার ওয়্যারলেস মেসেজিং ও ফ্রি এনার্জি প্রকল্পটির ব্যর্থতার পর টেসলা দেউলিয়া ঘোষিত হন। শেষ জীবন কাটে নিউইয়র্কের হোটেল রুমে একাকী নিঃসঙ্গ। প্রতিদিন নিয়ম করে পার্কে বুনো পায়রাদের খাওয়াতেন। একটি সাদা পায়রার প্রতি তার ছিল বিশেষ দুর্বলতা। তিনি পায়রাটির সঙ্গে কথা বলতেন। ১৯৩৭ এ মারাত্মক গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হন। ৭ জানুয়ারি ১৯৪৩, ৮৬ বছর বয়সে নিউইয়র্কে নিজ হোটেলের কক্ষ নং ৩৩২৭ এ মৃত্যুবরণ করেন। টেসলাকে নিয়ে বিতর্ক ছিল, আছে, থাকবে। আছে সত্য-মিথ্যা নানা গল্প আর গুজব। কিন্তু তার উত্তরসূরি এলেন মাস্ক যখন চালকবিহীন পরিবেশবান্ধব গাড়ির কোম্পানির নামকরণ করেন টেসলা মটরস। তখন তিনি একটি বার্তাও দেন। সেটি হচ্ছে- সময় হয়েছে টেসলা অধ্যায় উন্মোচনের তাকে তার প্রাপ্য স্থান দেয়ার। আপনি তাকে সন্দেহ করতেই পারেন। সেটি নিরসনের সহজ পথও আছে। হাতের কাছের বিদ্যুত বাতিটির সুইচ অন করুন। অলটারনেটিভ কারেন্ট সিস্টেম আপনাকে জানিয়ে দেবে তিনি আছেন। তিনি নিকোলা টেসলা-আলোর দেবতা।
×