ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২৮ আগস্ট ২০২০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ আরও একজন সেক্টর কমান্ডারের বিদায়। এবার আমরা হারালাম সি আর দত্তকে। পুরো নামটি চিত্ত রঞ্জন দত্ত। মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। একাত্তরের বীর যোদ্ধা অনেকদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন। ২০ আগস্ট ফ্লোরিডার বাসভবনের বাথরুমে পা পিছলে পড়ে মারাত্মক আহত হন তিনি। হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর। মুহূর্তেই খবর চলে আসে ঢাকায়। দীর্ঘকাল এ শহরেই বসবাস করেছেন তিনি। তার পর প্রবাসজীবন। দেশে থাকতেই কে আর খবর নিয়েছে এই বীরের? বিদেশে যাওয়ার পর আরও চোখের আড়ালে। হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধ কী যারা সত্যি উপলব্ধি করেন তাদের শ্রদ্ধা সব সময়ই ছিল তাঁর প্রতি। কোন না কোন ইস্যুতে সেক্টর কমান্ডারকে ঠিক স্মরণ করা হতো। আর সে সুযোগ রইল না! আহা, বেদনা! সি আর দত্ত চলে গেলেন। তাঁর সঙ্গে পরিসমাপ্তি ঘটল এক মহা অধ্যায়ের। বাঙালীর সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা। আর এ স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসের সঙ্গে এ নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে নেয়া হয়েছিল। একটির নেতৃত্ব দেন এই বীর সেনানী। অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয় তাঁকে। আজকের এই করোনার কালে ফ্রন্টলাইনার বা সম্মুখসারির যোদ্ধা কথাটি খুব শোনা যাচ্ছে। কোভিডের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের ডাকা হচ্ছে এই নামে। সম্মান জানানো হচ্ছে। এ বড় ভাল কথা। কিন্তু বেদনার বিষয় হলো যারা সব অর্থেই যোদ্ধা, যারা একাত্তরে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলেন তাদের ইতিহাসটি সেভাবে সামনে আসেনি কোনদিন। বর্বর পাকিস্তান আর্মির সুসংগঠিত আক্রমণের বিরুদ্ধে জীবন তুচ্ছ করে লড়েছিল বাংলার অতি সাধারণ কৃষক মজুর। লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। দু’বেলা অন্ন জুটে না। অপুষ্টিতে ভোগা শরীর। অথচ সেই তারাই শুধু দেশপ্রেমে বলিয়ান হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং নিয়েই ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন প্রশিক্ষিত পাক আর্মির। এবং এই দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষগুলোকে যোদ্ধা হিসেবে তৈরি ও পরিচালনা করেছিলেন যারা তাদের অন্যতম সি আর দত্ত। সম্মুখ যোদ্ধাদের নিয়ে টানা ৯ মাস লড়ে গেছেন তিনি। তাঁর মতো, তাঁদের মতো বীরদের কারণেই আজকের বাংলাদেশ পাওয়া। আজকের দিনে কত টকশো! বড় বড় কথা। ফেসবুকে ইউটিউবে দেশ দেশ মাতম, এই করে কত লোক হিরো বনে গেলেন! অথচ প্রকৃত হিরোদের, ফ্রন্টলাইনারদের আমরা ভুলে থেকেছি বছরের পর বছর। এই লজ্জা এই দীনতা আমাদের ছিল। হয়তো সামনের দিনগুলোতেও থাকবে। ‘তবু এই বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা/তোমাদের এই ঋণ কোন ঋণ কোন দিন শোধ হবে না...।’ স্যালুট বিজয় বীর সি আর দত্ত। অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। রাজধানী ঢাকায় হাজারও সমস্যা। নাগরিক দুর্ভোগের শেষ নেই। পাশাপাশি কিছু মানুষ নগরের সৌন্দর্য বিনষ্ট করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ইতোমধ্যে পোস্টারে ঢাকা পড়েছে শহরের সব দেয়াল। ফ্লাইওভারের পিলারগুলোর দিকে তাকানো যায় না। একইভাবে শহরকে নোংরা করে রেখেছে তারের জঞ্জাল। তো সেই তারের গল্পটাই আজ করি। পাড়ায় মহল্লায় এমনকি মূল সড়কের দুই ধারে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে আছে তার। ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ও ডিশ ব্যবসায়ীরা বিদ্যুতের খুঁটিগুলোগুলো একরকম দখল করে নিয়েছেন। খুঁটির নিচের অংশে যে যার মতো করে তার প্যাঁচিয়ে চলেছেন তারা। ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একটু অসাবধান হলেই বিপদ। তারের কু-লী এসে মাথায় ঠেকবে। ওপর থেকে যখন তখন নিচের দিকে নেমে আসছে খোলা তার। ঝুলন্ত খোলা তার পথিকের চোখে বিঁদতে পারে যখন তখন। কিন্তু দেখার কেউ নেই। প্রতিকারহীন। এ অবস্থায় গত বুধবার নিউ ইস্কাটন রোডে হঠাৎ করেই চোখে পড়ল তার মুক্ত করার অভিযান। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের একটি টিম বেশ তৎপর হয়েছিল। রাঘব বোয়াল কাউকেই ছাড় দিলেন না তারা। একে একে সব তার কেটে জঞ্জাল সাফ করলেন তারা। নিচের দিকে তাকিয়ে অবাক হতে হলো। এত তার! তারের স্তূপ। সন্ধ্যা পর্যন্ত সেভাবেই মাটিতে পড়ে রইল। কিন্তু রাত হতে না হতেই চোখ কপালে! এবার সামনে এলো আরেক ছবি। একসঙ্গে অনেক লোকজন রাস্তায় নেমে তার সংগ্রহ শুরু করলেন। যার যে তার সে বুঝে নিচ্ছিল। প্রথমে মনে হলো তারগুলো সরাতে হবে তো, সে কাজই হচ্ছে। কিন্তু না। কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেল তার সংগ্রহ করে আবারও জোড়া দেয়ার কাজ করছেন ব্যবসায়ীরা। মগবাজার মোড় সংলগ্ন রাস্তার ধারে কথা হচ্ছিল স্থানীয় এক ইন্টারনেট ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি নিশ্চিত করেই বললেন, একদিকে তার কাটা হয়। অন্যদিকে জোড়া দেয়ার কাজ শেষ করেন তারা। এবারও তা-ই করেছেন। অভিযানের সময় সব দেখছিলেন তারা। প্রস্তুত হচ্ছিলেন। সিটি কর্পোরেশনের টিম চলে যাওয়ার পর পরই কাজে নেমে যান! বৃহস্পতিবার ভাল করে তাকিয়ে দেখা যায়, সেই আগের অবস্থাই ফিরে এসেছে। না, এখানেই শেষ নয়। সিটি কর্পোরেশনও নাকি বিষয়টি অবগত। তাহলে কী দাঁড়ালো বিষয়টি? হ্যাঁ, এসব কারণেই ঢাকাকে আর সুন্দর করা গেল না। কোনদিন কি যাবে? কে বলবে?
×