ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চাঞ্চল্যকর সিনহা হত্যা

আসামিদের মধ্যে প্রথম স্বীকারোক্তি আবদুল্লাহর

প্রকাশিত: ২২:৪৩, ২৭ আগস্ট ২০২০

আসামিদের মধ্যে প্রথম স্বীকারোক্তি আবদুল্লাহর

চট্টগ্রাম অফিস, স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ॥ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের রহস্যজট খুলতে শুরু করেছে বলে প্রতীয়মান। গ্রেফতারকৃত ১৩ আসামির মধ্যে বুধবার এপিবিএন (আর্মড ব্যাটালিয়ন পুলিশ) সদস্য মোঃ আবদুল্লাহ বুধবার বিকেলে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। তিনি এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন। তিনি রিমান্ডে থেকে আসামিদের মধ্যে প্রথম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করলেন। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কনস্টেবল আবদুল্লাহ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে রাজি হওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের এএসপি খাইরুল ইসলামের নেতৃত্বে বিকেলে তাকে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে নেয়া হয় ম্যাজিস্ট্রেটের খাস কামরায়। বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সন্ধ্যা প্রায় সোয়া ৭টা পর্যন্ত তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়। জবানবন্দীতে তিনি সিনহাকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে এ নিয়ে তিনি যা দেখেছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। সিনহাকে কেন হত্যা করা হয়েছে তা তিনি জানেন না বলে ম্যাজিস্ট্রেটকে অবহিত করেন। ওইদিন ঘটনার সময় শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে তিনিসহ এপিবিএনের ৩ সদস্য দায়িত্বরত ছিলেন। এপিবিএনের অপর দুজন হলেন এএসআই শাহজাহান ও কনস্টেবল রাজিব। জবানবন্দীতে আবদুল্লাহ আরও জানিয়েছেন, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকতকে তিনি গুলি করতে দেখেছেন। তার গুলিতে সিনহার মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন। আবদুল্লাহর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর বিশদ ব্যাখ্যা তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, আসামিদের মধ্যে প্রথম একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবান্দদানের ঘটনায় সিনহা হত্যাকাণ্ডের জট খুলতে শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানিয়েছে, সিনহা হত্যার প্রথম তিন আসামি ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও এএসআই নন্দদুলাল রক্ষিতের পক্ষেও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ তিনজনকে টানা ১১ দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। আগামী শুক্রবার তাদের রিমান্ড শেষ হবে। ঐদিন এদের আদালতে সোপর্দ করার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়া হবে কিনা তা এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। প্রদীপ ও লিয়াকতের বিরুদ্ধে পৃথক আরও ২টি হত্যা মামলা ॥ বুধবার কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-৩ (টেকনাফ) আদালতে সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা হয়েছে। মামলার আবেদন করেন টেকনাফে ক্রসফায়ারে নিহত মাহমুদুর রহমানের ভাই নুরুল হোসাইন। শুনানি শেষে বিচারক মোঃ হেলাল উদ্দিন আবেদনটি মামলা হিসেবে ওই ঘটনায় অন্য কোন হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে কিনা তা জানাতে ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, থানায় ধরে নিয়ে ক্রসফায়ারে না মারার কথা দিয়ে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। তড়িঘড়ি করে ৫ লাখ টাকা দেয়া হয়। অবশিষ্ট ৫ লাখ টাকা দিতে না পারায় প্রবাসী মাহমুদুর রহমানকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। বাদীর পক্ষে আইনজীবী ইনসাফুর রহমান জানিয়েছেন, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মাহমুদুর রহমানকে এসআই দীপকের নেতৃত্বে একদল পুলিশ নিয়ে যান। টানা তিনদিন থানায় আটক রেখে ৫ লাখ টাকা আদায় করা হয়। অবশিষ্ট ৫ লাখ টাকা দিতে না পারায় ৩১ ফেব্রুয়ারি রাতে মাহমুদুর রহমানকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। মামলার আর্জিতে এসআই দীপককে প্রধান ও তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে দুনম্বর আসামি করে মোট ২৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৮ জন পুলিশ সদস্য, অবশিষ্ট ৫ জনের মধ্যে চৌকিদারসহ স্থানীয়রা রয়েছে। অপরদিকে বুধবার চট্টগ্রাম মহানগর আদালতে সিনহা হত্যাকারী লিয়াকতসহ ৩ পুলিশকে আসামি করে ৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আমলে নেয়া হয়েছে। মহানগর হাকিম আবু সালেম মোহাম্মদ নোমানের আদালতে একজন ব্যবসায়ীকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ আনা হয়। এতে সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারসহ আরও ৬ জনকে অভিযুক্ত করা হলেও আদালত তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেননি। ৩ পুলিশসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে সিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনারকে (উত্তর) তদন্তে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয়া হয়েছে তারা হলেন, চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক এসআই লিয়াকত আলী, কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার সাবেক এসআই নজরুল ও হান্নান। এছাড়া আর চারজন হলেন এসএম শাহাবউদ্দিন, কৃষ্ণপদ পাল, কাজল কান্তি বৈদ্য ও জিয়াউর রহমান। মামলার বাদী জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন, ২০১৪ সালের ১৪ জুন লিয়াকত আলী তার অফিসে ডেকে নিয়ে একটি মামলার সঠিক তদন্তের জন্য তার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নেন। কিন্তু পরবর্তীতে আবার ডেকে নিয়ে আসামি পক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করার চাপ দেন। রাজি না হওয়ায় তাকে আটকিয়ে তার চোখ বেঁধে একটি মাইক্রোবাসে তোলা হয়। চোখ খোলার পর দেখতে পান তার অবস্থান পতেঙ্গা থানায়। সেখানে কয়েক পুলিশ সদস্য তাকে মারধর করেন। ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি দিয়ে ৫ লাখ টাকা দাবি করলে তিনি আড়াই লাখ টাকা তিনি তাদের হাতে দেন। টাকা দেয়ার পরও দাউদকান্দি থানার একটি ভুয়া পরোয়ানায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। ৬ মাস জেল খেটে তিনি জামিনে মুক্তি পান। প্রদীপ আতঙ্কে পলাতকরা ফিরেছেন ॥ ব্যবসায়ী, প্রবাসী, চিংড়িঘেরসহ জমিজমার মালিক ও ধনাঢ্যশালী ব্যক্তিরা ছিলেন প্রদীপ কুমার দাশের প্রাইভেট বাহিনীর টার্গেট। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্যের বৈধ ব্যসায়ীসহ টেকনাফে অর্থবিত্তের মালিক অনেকে প্রদীপ দাশের ক্রসফায়ার আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে বা আত্মগোপনে ছিলেন। ইয়াবা কারবারে জড়িত না থেকেও ঘের এবং বঙ্গোপসাগরে মৎস্যসহ আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের বৈধ ব্যবসা করে টেকনাফের বহু বিত্তশালী প্রদীপ বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়। দালালরা ওইসব ব্যক্তির কাছ থেকে ওসি প্রদীপের নামে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করত। টাকা না দিলে ক্রসফায়ারে মারা হবে বলে হুমকি দিত। প্রাণে বাঁচার ভয়ে টেকনাফ থেকে গা ঢাকা দিয়ে ছয়মাস, কেউ এক বছর, কেউ দুই বছর ধরে পলাতক জীবন বেছে নেয়। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যাকা-ের পর প্রদীপ কুমার দাশসহ টেকনাফ থানা পুলিশের ৭ সদস্য গ্রেফতার হওয়ায় ওইসব নিরীহ ব্যক্তি টেকনাফে নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে এসেছেন।
×