ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাহিদুল আলম জয়

ইউরোপের পরাশক্তি বেয়ার্ন মিউনিখ

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ২৬ আগস্ট ২০২০

ইউরোপের পরাশক্তি বেয়ার্ন মিউনিখ

শুধু ইউরোপিয়ান ফুটবল নয়, বিশ্ব ফুটবলেরই অন্যতম সেরা শক্তি জার্মানি। কি জাতীয় দল কি ক্লাব ফুটবল সবখানেই দাপট জার্মানদের। ইউরোপের পাওয়ার হাউসদের ধারাবাহিক সাফল্য অন্যদের কাছে বিস্ময়কর। দেশটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চারবারের বিশ্বকাপজয়ী। জার্মানদের ক্লাব বেয়ার্ন মিউনিখও বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা শক্তি। ২৩ আগস্ট উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপা জিতে বাভারিয়ানরা এ প্রমাণ আরও একবার রেখেছে। ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে ২০১৪ সালে আমেরিকা অঞ্চল থেকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্ব দেখায় জার্মানি। ১৯৯০ সালে সর্বশেষ বিশ্বকাপ জয়ের পর দুই যুগের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আবারও বিশ্বজয়ের মুকুট পড়েছিল ইউরোপের পাওয়ার হাউসরা। এর আগে ১৯৫৪, ১৯৭৪ ও ১৯৯০ সালে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে জার্মানি। সেমিফাইনাল আর ফাইনাল ট্র্যাজেডির দল বলা হয়ে থাকে জার্মানিকে। ফুটবলের যে কোন আসরে সবসময়ই ফেবারিটের তকমা থাকে তাঁদের গায়ে। ফাইনাল আর সেমিতে হারের লম্বা মিছিলে যোগ না দিলে জার্মানদের বিশ্ব ফুটবলের সেরা দল আপনাকে বলতেই হতো। সেক্ষেত্রে ব্রাজিলের আগে তাদের নামটিই উচ্চারণ করতে হতো বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। বিশ্বকাপের ইতিহাসেও জার্মানি সবচেয়ে ধারাবাহিক সাফল্য পাওয়া দল। ব্রাজিল বিশ্বকাপেও শেষ চারে পৌঁছে ইউরোপের পাওয়ার হাউসরা বিশ্বরেকর্ড গড়ে। কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সকে ১-০ গোলে হারিয়ে টানা চতুর্থবার সেমিফাইনাল খেলার রেকর্ড গড়ে জোয়াকিম লোর দল। প্রথম কোন দল হিসেবে নিজেদের গড়া ২০১০ সালের আসরে টানা হ্যাটট্রিক সেমিফাইনাল খেলার রেকর্ড ভাঙে বর্তমান বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে ধারাবাহিক সাফল্য পাওয়া দলটি। এরপর সেমিফাইনালে স্বাগতিক ব্রাজিলকে ৭-১ গোলে নাস্তানাবুদ করে ফাইনালে পাড়ি জমান লাম, ক্লোস, মুলার, শোয়েনস্টেইগাররা। এর ফলে ব্রাজিলকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে বেশি ৮ বার ফাইনালে খেলার রেকর্ড গড়ে জার্মানি। মারাকানায় চূড়ান্ত মহারণে ফের আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে বিশ্বকাপ ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চারবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবে ভাসে জার্মানরা। এই অদম্য জার্মানির ক্লাব বেয়ার্ন মিউনিখ সদ্যই ফরাসী বিপ্লব থামিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফুটবলের শিরোপা পুনরুদ্ধার করেছে। পিএসজিকে ১-০ গোলে হারিয়ে এ কৃতিত্ব দেখিয়েছে বাভারিয়ানরা। এর ফলে দীর্ঘ সাত বছর অর্থাৎ ২০১২-১৩ মৌসুমের পর আবারও ইউরোপ সেরার ট্রফি জিতেছে বেয়ার্ন। সবমিলিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লীগে এটি বেয়ার্নের ষষ্ঠ শিরোপা। ২০২০ সালে কোন ম্যাচ না হারা বেয়ার্ন এ নিয়ে টানা ২১ ম্যাচ জিতেছে। এই পথে তারা জিতেছে ঐতিহাসিক ট্রেবল। চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জয়ের আগে বাভারিয়ানরা জিতেছে জার্মান বুন্দেসলীগা ও জার্মান কাপ। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার নিজেদের ইতিহাসে ‘ট্রেবল’ জয়ের গৌরব দেখাল বেয়ার্ন। এর আগে তারা সবশেষ ট্রেবল জিতেছিল ২০১২-১৩ মৌসুমে। সেবারও চ্যাাম্পিয়ন্স লীগ জিতেছিল জার্মান জায়ান্টরা। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ৬৪ বছরের ইতিহাসে দুর্দান্ত রেকর্ড গড়েছে বেয়ার্ন। চ্যাম্পিয়ন্স লীগ বা ইউরোপিয়ান কাপের ৬৪ বছরের ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে কোন আসরের সবগুলো ম্যাচ জয়ের রেকর্ড গড়েছে তারা। এর আগে বেশ কয়েকটি আসরেই দেখা গেছে অপরাজিত চ্যাম্পিয়নের। কিন্তু কোন দলই নিজেদেও খেলা সবগুলো ম্যাচ জিততে পারেনি। সবশেষ ২০০৭-০৮ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লীগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইংলিশ জায়ান্ট ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। কিন্তু সেবার তারা ড্র করেছিল তিনটি ম্যাচ। কিন্তু এবারের আসওে কোন ড্র বা হারের মুখ দেখেনি বেয়ার্ন। ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর নিজেদের প্রথম ম্যাচে সার্বিয়ার ক্লাব রেড স্টার বেলগ্রেডকে ৩-০ গোলে হারিয়ে মিশন শুরু করা বেয়ার্ন শেষটা করেছে পিএসজিকে হারিয়ে ট্রফি জিতে। ফাইনাল ম্যাচে করা একমাত্র গোলের মাধ্যমে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ইতিহাসে তৃতীয় দল হিসেবে ৫০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেছে বেয়ার্ন। তাদের আগে ৫০০ গোল করা দুই দল হলো স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদ (৫৭৬) ও বার্সিলোনা (৫১৭)। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার জুনিগোর বাজে ট্যাকেলের শিকার হয়েছিলেন নেইমার। যে কারণে সেমিফাইনালে জার্মানির বিরুদ্ধে খেলতে পারেননি নেইমার। শেষ আটের ওই ম্যাচে চোখের জলে মাঠ ছেড়েছিলেন সেলেসাও তারকা। ছয় বছর পর আবারও চোখের জলে মাঠ ছেড়েছেন ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার। তবে এবারের মঞ্চটা আলাদা। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনালের মঞ্চ। ফরাসী ক্লাব পিএসজির হয়ে জার্মান জায়ান্ট বেয়ার্ন মিউনিখের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিলেন নেইমার। কিন্তু পরশু রাতে নিজে দুর্দান্ত খেলার পরও চ্যাম্পিয়ন করাতে পারেননি পিএসজিকে। যে কারণে ম্যাচ শেষে নেইমারকে অঝোরে কান্না করতে দেখা গেছে। তাঁকে সমবেদনা জানিয়েছেন সতীর্থ, প্রতিপক্ষসহ সবাই। নেইমার এতটাই ভেঙে পড়েন যে, তাঁর কান্না দেখে অন্যরাও কেঁদেছেন। নেইমারকে যেন আবেগটা একটু বেশিই ছুঁয়ে যায়। বার বার টিভি ক্যামেরায় তার চোখ ছল ছল চেহারা দেখা যায়। ম্যাচ শেষে কান্নাজড়িত নেইমারকে সান্ত¡না দেন কোচ টমাস টাচেল, ক্লাব সভাপতি নাসের আল- খেলাইফি। এমনকি প্রতিপক্ষ কোচ হ্যান্স ফ্লিকসহ খেলোয়াড়রাও সববেদনা জানান। ম্যাচ শেষে পিএসজি কোচ টাচেল বলেন, আমরা নেইমার ও এমবাপের কাছ থেকে গোল চাই। কিন্তু সব সময়ই সেটা সম্ভব হবে এমন আশা করাও ঠিক না। আমি সত্যিই গর্বিত। কারণ নেইমার তার মানসিকতার প্রমাণ দিয়েছে। পুরো ম্যাচেই সে সমান তালে খেলেছে। এমবাপের জন্য ম্যাচটা কিছুটা হলেও কঠিন ছিল। কারণ সবাই জানে সে ইনজুরিতে ভুগছে। বেশ কয়েকটি অনুশীলনে সে অনুপস্থিত ছিল। পুরো ম্যাচে যে সে আমাদের সঙ্গে ছিল এটাই অনেক বড় বিষয়। সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে ম্যাচের ফলাফল অন্যরকম হতে পারত বলেও মনে করেন পিএসজি কোচ। টাচেল বলেন, প্রথম গোলটি যদি আমরা করতে পারতাম তাহলে হয় আমরই ম্যাচটি জিতে নিতাম। আমি সবসময়ই মনে করি প্রথম গোলই এ ধরনের ফাইনালে ভাগ্য গড়ে দেয়। আমাদের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। পিএসজির কাতারী সভাপতি নাসির আল-খেলাইফি বলেন, খেলোয়াড়দের নিয়ে আমি গর্বিত। পুরো মৌসুম দারুণ কেটেছে, এই টুর্নামেন্টেও আমরা অসাধারণ খেলেছি। কেউই চিন্তা করেনি আমরা ফাইনালে খেলব। জয়ের খুব কাছাকাছি আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম। জয়ের জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই আমরা করেছি। কিন্তু এটাই ফুটবল। আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জয়ের জন্য আমরা কাজ করে যাব। কারন এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। এদিকে ফাইনালে বেয়ার্ন মিউনিখের কাছে হারের পর প্যারিসে বিক্ষুব্ধ সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত ১৫০ জনের আটকের খবর পাওয়া গেছে। ফাইনালে পিএজিকে সমর্থনের উদ্দেশ্যে প্যারিসের পার্ক দ্য প্রিন্সেসের বাইরে হাজার পাঁচেক সমর্থক জড়ো হয়েছিলেন। বড় পর্দায় ম্যাচটি উপভোগের সময় তারা উল্লাসে মাতোয়ারা ছিলেন। কিন্তু ম্যাচ শেষে গভীর রাতের দিকে বিক্ষুব্ধ সমর্থকরা ভাঙচুর শুরু করে। এ সময় স্টেডিয়ামের বাইরে রাখা কয়েকটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। দোকানের জানালা ভেঙ্গে বিক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। এর আগে প্যারিসের মেয়র আন্নে হিডালগো অনুরোধ জানিয়ে বলেছিলেন পিএসজি যদি জয়ী হতে পারে তাহলে সব ধরনের উদযাপন যেন শান্তিপূর্ণভাবে করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ট্রফি জিততে পারেনি প্যারিসের পরাশক্তিরা। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে প্রথমবারের মতো ফাইনালে খেলার উল্লাসে পিএসজির উচ্ছ্বসিত সমর্থকদের মধ্যে কোন ধরনের সামাজিক দূরত্বও দেখা যায়নি। পুরো ম্যাচ জুড়েই পুলিশের সঙ্গে ছোটখাটো সংঘর্ষ লেগেই ছিল। এসময় পুলিশকে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করতেও দেখা গেছে।
×