ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় ১৭১ দিনে মৃত্যু ছাড়াল চার হাজার

প্রকাশিত: ২২:৪১, ২৬ আগস্ট ২০২০

করোনায় ১৭১ দিনে মৃত্যু ছাড়াল চার হাজার

নিখিল মানখিন ॥ প্রথম রোগী শনাক্তের পর ১৭১ দিনে দেশে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বে ২৯তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। পরীক্ষিত নমুনার ভিত্তিতে মোট শনাক্তের হার বিবেচনায় বিশ্বে পঞ্চম, এবং দক্ষিণ এশিয়া দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। মোট আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ১৫তম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা রোগীর সুস্থতার হারের বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। তবে কয়েকমাস ধরে দৈনিক নতুন রোগী শনাক্তের উচ্চহার, মৃত্যুর সংখ্যার অস্বস্তিদায়ক অবস্থান, নমুনা পরীক্ষায় মানুষের অনীহা, উপসর্গহীন রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে উচ্চ ঝুঁকির বাইরে আসতে পারছে না দেশের করোনা পরিস্থিতি। করোনা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কার্যক্রমেও নেমে এসেছে স্থবিরতা। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আরও ৪৫ জনের মৃত্যু এবং শনাক্ত হয়েছেন নতুন ২৫৪৫ জন। এ নিয়ে এ পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৪০২৮ এবং আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ২ লাখ ৯৯ হাজার ৬২৮ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হওয়া ৩৮৮১ জনসহ এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৫৬ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪ হাজার ১৫৩টিসহ এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১৪ লাখ ৭০ হাজার ১৯১টি। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ১৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৬২ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার এক দশমিক ৩৪ শতাংশ বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদী হওয়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে সংক্রমণ প্রতিরোধে নেয়া পদক্ষেপগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তারা বলছেন, গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর সাধারণ ছুটি, লকডাউন পরিস্থিতিসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নেয় সরকার। করোনা নিয়ন্ত্রণে এখনও সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ চলছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছিল, সেগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। ফলে সংক্রমণ ছড়িয়েছে এবং সংক্রমণ দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। মাসভিত্তিক আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ॥ মাস বিবেচনায় করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা মার্চে যথাক্রমে ৫১ ও ৫ জন, এপ্রিলে ৭৬১৬ ও ১৬৭ জন, মে মাসে ৩৯ হাজার ৪৮৬ জন ও ৪৮২ জন, জুনে ৯৮ হাজার ৩৩০ জন ও ১১৯৭ জন এবং জুলাই মাসে ৯২ হাজার ১৭৮ জন ও ১২৬৪ জন রেকর্ড হয়েছে। আর ২৫ তারিখ পর্যন্ত আগস্ট মাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা রেকর্ড হয়েছে যথাক্রমে ৬১ হাজার ৯৬৭ জন ও ৯১৩ জন। রাজধানীতে বেড়েছে নতুন রোগীর সংখ্যা ॥ রাজধানীতে এক মাসে রোগী বেড়েছে ৫৬ শতাংশ। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানম-ি, উত্তরায় আক্রান্ত বেশি। দেশে মোট আক্রান্তের ৩৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ রাজধানীর বাসিন্দা। এই তথ্য সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর)। রাজধানীতেই ১৬ লাখের বেশি করোনা রোগী ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতর নমুনা পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে আক্রান্তের যে সংখ্যা দেয়, প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা তারচেয়ে বেশি। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিসিডিআরবি) যৌথ জরিপের প্রাথমিক ফলাফলে ১০ আগস্ট বলা হয়, রাজধানীর আনুমানিক ৯ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০১৭ সালে ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ। সে হিসাবে রাজধানীতে আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ লাখ ২০ হাজার। স্বাস্থ্যবিধি অমান্যের প্রতিযোগিতা ॥ রাজধানীর জীবনযাত্রা মহামারী শুরুর প্রায় আগের অবস্থায় চলে এসেছে। রাস্তায় মানুষের ঢল আর যানজট অনেকটা আগের মতো। খুব কম মানুষ মাস্ক পরে রাস্তায় বের হচ্ছেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার বিষয়টি গুরুত্ব হারিয়েছে। কাঁচাবাজার শুধু নয়, অফিস ও ব্যাংক পাড়াতেও পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেখা যাচ্ছে না। মানুষ অনেকটা বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে চলাফেরা যাতায়াত করছে। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে তেমন কোন সরকারী উদ্যোগ মানুষ দেখতে পাচ্ছে না, মানুষের সামনে কোন বিধিনিষেধ কার্যত নেই। তাই বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরে সংক্রমণ থেমে নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অবস্থান ॥ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত করোনা পরিস্থিতিকে হাল্কা করে তুলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। করোনা মোকাবেলা কার্যক্রম ঢেলে সাজাতে গিয়ে আবার আলোচনায় উঠে এসেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অকার্যকর হয়ে পড়ছে করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে গঠিত বিভিন্ন কমিটির কার্যক্রম। মাঠ পর্যায়ের কমিটিগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পর্ক ও যোগাযোগ না থাকার অভিযোগ উঠেছে। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রেও বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। জোনভিত্তিক লকডাউন নিয়ে আলোচনা নেই। নিষ্ক্রীয় হয়ে পড়েছে প্রতিরোধ কমিটি সমূহের কার্যক্রম ॥ করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে প্রধান করে গঠিত হয় জাতীয় করোনা প্রতিরোধ কমিটি। এই কেন্দ্রীয় কমিটির আওতায় পরবর্তীতে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে করোনা কমিটি গঠিত হয়। বর্তমানে ওইসব কমিটির দৃশ্যমান কর্মতৎপরতা নেই। বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হয় না। সীমিত নমুনা পরীক্ষা ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের বুলেটিনে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১ জুন থেকে দৈনিক পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা ১১ হাজারে উঠে আসে এবং তা জুন মাসজুড়ে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। দৈনিক পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ১৫ জুন ১৪ হাজারে এবং ২০ জুনের মধ্যে ১৫ হাজারে পৌঁছে যায়। তিন ভাগের দুই ভাগ করোনা শয্যাই খালি ॥ ২৫ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, সারাদেশে করোনা রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যার সংখ্যা ১৫ হাজার ২৫৫টি, রোগী ভর্তি রয়েছে ৪০৭৩ জন এবং খালি শয্যার সংখ্যা ১০ হাজার ৭৭০টি। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে মোট সাধারণ শয্যার সংখ্যা ৭০৩৭টি, রোগী ভর্তি রয়েছে ২১৮৩ জন এবং খালি শয্যার সংখ্যা ৪৪৪২টি, চট্টগ্রাম মহানগরীতে মোট শয্যার সংখ্যা ৭৮২টি, ভর্তিকৃত ১৯৪টি এবং খালি শয্যার সংখ্যা ৫৮৮টি। আর দেশের অন্যান্য হাসপাতালে মোট সাধারণ শয্যার সংখ্যা ৭৪৩৬টি, ভর্তিকৃত ১৬৯৬টি এবং খালি শয্যার সংখ্যা ৫৭৪০টি। আত্মতুষ্টির সময় আসেনি ॥ বিশেষজ্ঞরা করোনার বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, পৃথিবীর যে কোন দেশেই করোনা কমবেশি আক্রমণ করে চলেছে। আমাদের দেশে হয়ত বলতে পারেন, অন্য দেশের বিচারে তুলনামূলক হয়তবা কম। কিন্তু, এখানে আত্মতৃপ্তি বা আত্মতুষ্টির কোন সুযোগ আমি দেখি না। তৃপ্তির ঢেকুর তোলার কোন সুযোগ তো নেই। করোনা কবে যাবে, কেউ তো নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারছে না। হয়ত অন্য অনেক ভাইরাসের মতো করোনাও সারাজীবনই রয়ে যাবে। সুতরাং এর সংক্রমণ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় তো ভ্যাকসিন। এখন পর্যন্ত গবেষণায় তো এটাই পাওয়া গেছে। আর নতুন কোন তথ্য তো নেই। ভ্যাকসিন ছাড়া কোন উপায় নেই। কারণ, নির্দিষ্ট কোন ওষুধ তো নেই করোনার। এখন করোনায় আক্রান্ত হলে যেগুলো আমরা দেই, সেগুলো তো অন্য রোগের। আমরা জানি, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম।
×