ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হত্যার ঘটনা ভিন্ন খাতে নেয়ার অপচেষ্টা সফল হয়নি

প্রকাশিত: ২২:৪০, ২৬ আগস্ট ২০২০

হত্যার ঘটনা ভিন্ন খাতে নেয়ার অপচেষ্টা সফল হয়নি

চট্টগ্রাম অফিস, স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ॥ টেকনাফের শামলাপুরে সংঘটিত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের হত্যার ঘটনার পর ফায়দা হাসিলে অপতৎপরতা চালিয়েছিল একটি অশুভ শক্তি। পুলিশের গুলিতে যেহেতু অবসরপ্রাপ্ত একজন সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন সেটিকে কেন্দ্র করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চলেছিল। এ ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার কম চেষ্টা হয়নি। কিন্তু সেটি সফল হয়নি। এ তথ্য দায়িত্বশীল সূত্রের। ঘটনার পর সিনহাকে হত্যাকারী ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৭ পুলিশ আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাদেরকে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়। এরপর তদন্ত সংস্থা র‌্যাব এদের প্রত্যেককে রিমান্ডে নিয়েবর্তমানে জিজ্ঞাসাবাদের দ্বিতীয় পর্ব চালিয়ে যাচ্ছে। ঘটনার রহস্য উদঘাটনে এদেরকে মুখোমুখি করা হচ্ছে। প্রত্যেকের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে লিখিত বক্তব্য, যা এখন একটির সঙ্গে অপরটি মিলানো হয়েছে। এতে এ পর্যন্ত যে তথ্য অনেকাংশে নিশ্চিত হয়েছে সেটি হচ্ছে সিনহা হত্যাকান্ড আকস্মিক। পরিকল্পিত নয়। পবিত্র ঈদুল আযহার পূর্বদিন রাতে শামলাপুরস্থ এপিবিএনের তল্লাশি চৌকিতে সিনহাকে হত্যার ঘটনাটি সম্পূর্ণ আকস্মিক হিসাবেই জট খুলতে শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। মামলার তদন্তে ঘটনার অন্তর্নিহিত রহস্যও ক্রিস্টাল ক্লিয়ার হতে শুরু করেছে। মূলত বাহারছড়ার মারিসবুনিয়ার পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরতদের পক্ষে সিনহা ও তার সহযোগী শিফাতকে ডাকাত মনে করে টেলিফোনে উপর্যুপুরি পুলিশকে অবহিত করা হয়। ফলে বাহারছড়ার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী তার সহযোগী এএসআই নন্দদুলাল রক্ষিতকে নিয়ে সাদা পোশাকে একটি মোটর সাইকেলে তল্লাশি চৌকিতে পৌঁছেন। এ সময় তারা ড্রাম ফেলে সিনহার গাড়ি আটকিয়ে নিমিষেই হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এ পর্যন্ত তদন্তে যে সব তথ্য মিলেছে তাতে এটি কোন প্ল্যান্ড মার্ডার নয় বলে সূত্র জানিয়েছে। আর ঘটনার পর ১০ মিনিটেই টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি পৌছে যাওয়ার তথ্য ইতোপূর্বে প্রকাশ পেয়েছে সেটিও সত্য নয়। ওই সময় ওসি প্রদীপ ছিলেন থানা কক্ষে। ইন্সপেক্টর লিয়াকতের কাছ থেকে ঘটনা শুনেই তিনি পৌছে যান স্পটে। এতে কমপক্ষে আধাঘন্টা সময় নেয়। যে কারণে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সিনহার শরীর দীর্ঘক্ষণ ধরে স্পটে পড়ে থাকার ঘটনা ঘটেছে। স্পটে যাওয়ার আগে ইন্সপেক্টর লিয়াকত ওসি প্রদীপকে ঘটনা জানান। সূত্র জানিয়েছে, ইন্সপেক্টর লিয়াকত যাচাই বাছাই না করেই হত্যার ঘটনাটি ঘটিয়েছেন। ঘটনার পর এএসআই নন্দদুলাল রক্ষিত বাদী হয়ে থানায় যে এজাহার করেছেন তাতে উল্লেখ করা হয়েছে গত ৩১ জুলাই মারিসবুনিয়ার কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সদস্য নুরুল আমিন মোবাইল ফোনে বাহারছড়ার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকত আলীকে জানিয়েছিলেন কয়েকজন ডাকাত পাহাড়ে ছোট ছোট টর্চ লাইট জ¦ালিয়ে এদিক ওদিক হাটাহাটি করছে। অতঃপর বিষয়টি এলাকার নিজাম উদ্দিন, আয়াজ উদ্দিন এবং মঈনউদ্দিনকে অবহিত করে। আর পরে মঈন উদ্দিন স্থানীয় মারিসবুনিয়ার মসজিদের মাইকের মাধ্যমে পাহাড় থেকে ডাকাত নেমে আসছে মর্মে জানান দিয়ে এলাকাবাসিকে একত্রিত হওয়ার আহবান জানান। এ আহবানের পর এলাকার অনেকে পাল্টা উত্তরে বলেছন, ওরা ডাকাত নয় সেনাবাহিনীর লোক। কিন্তু এরপর উৎস্যুক কিছু লোক সিনহা ও শিফাকতে ঘেরাও দেওয়ার চেষ্টা চালায়। অভিযোগ রয়েছে, সিনহা তার পিস্তল দেখালে লোকজন সরে যায়। এরপর তারা সোজা মেরিন ড্রাইভ সড়কে চলে আসে। প্রথমে বিজিবির তল্লাশিকে বাধাপ্রাপ্ত হন। পরিচয় পাওয়ার পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর এপিবিএনের তল্লাশিতেও বাাধাপ্রাপ্ত হন। কিন্তু পরিচয় পেয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এ ঘটনা চলাকালীন লিয়াকত তার সহযোগী এএসআই নন্দদুলাল রক্ষিতকে নিয়ে মোটর সাইকেলযোগে ঘটনাস্থলে পৌছেন। কক্সবাজারমুখী সিনহার গাড়িটি ড্রাম ফেলে আটকে দেন। লিয়াকতের নির্দেশে শিফাত গাড়ি থেকে নেমে আসেন। তাকে গাড়ির পেছনে নিয়ে আটকে রাখা হয়। এরপর সিনহাকে বার বার নামতে বলার পর একপর্যায়ে হাত তুলে তিনি গাড়ি থেকে নামার প্রক্রিয়ায় লিয়াকত গুলিবর্ষণ করেন। এখন বেরিয়ে আসছে গুলিবর্ষণের ওই অস্ত্রটি ছিল নন্দদুলাল রক্ষিতের। যা ইতোমধ্যে জব্ধ করে তদন্ত কর্মকর্তার হেফাজতে নেয়া হয়েছে। ওই সময় এসআই লিয়াকত তার অস্ত্র নেননি। সূত্র জানায়, আরেকজনের অস্ত্র দিয়ে গুলি করার এ ঘটনাটিও বেআইনী হয়েছে। এছাড়া সিনহা নিজেকে তার পরিচয় দেয়ার পরও ইন্সপেক্টর লিয়াকত কেন এ ঘটনার অবতারণা করলেন তা নিয়ে তদন্তে এ পর্যন্ত যা নিশ্চিত হওয়া গেছে তা হচ্ছে বিষয়টি আকস্মিক। পরিকল্পিত কোন ঘটনা নয়। হতে পারে এটি এলাকার কয়েকজনের কাছ থেকে বার বার ডাকাত ডাকাত বলে অবহিত করার জের। অথবা হতে পারে মেরিন ড্রাইভে টেকনাফ পুুিলশের উপর্যুপুরি ক্রসফায়ার ঘটনার ধারাবাহিকতার একটি অংশ। যেখানে ওসি প্রদীপের নির্দেশনায় ১৬১টি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে, যারমধ্যে কিছু নিরীহ রয়েছেন। যারা কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ের শিকার। এমামলায় র‌্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা সিনিয়র এএসপি খাইরুল ইসলাম ঘটনাস্থলসহ বিভিন্ন পয়েন্টে সাক্ষী ও আগ্রহীদের সঙ্গে কথা বলে এ ধরনের বহু অভিযোগ পেয়েছেন। এসব অভিযোগ এ মামলার সঙ্গে বিবেচ্য নয়। এরপরও ওসি প্রদীপের আমলে ভীতসন্ত্রস্ত্র হয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছিল, এখন তারা মুখ খুলতে শুরু করেছে। মঙ্গলবার যে ৩ জনকে ফের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে তারা হলেন সিনহা হত্যাকান্ডের পর পুলিশী মামলার সাক্ষী নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও মোঃ আয়াছ। গত ১৪ আগস্ট এদেরকে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে আদালতের নির্দেশে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তদন্তের স্বার্থে তদন্ত কর্মকর্তা এ ৩ জনকে মঙ্গলবার ফের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানালে শুনানী শেষে কক্সবাজার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খাইরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তদন্ত বেশ অগ্রগতি হয়েছে। ফলে এ তিন আসামীকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হয়েছে। এর আগে অর্থাৎ সোমবার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ও এএসআই নন্দদুলাল রক্ষিতকে পুনরায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন জানানো হলে আদালত তাদের ক্ষেত্রেও চারদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। উল্লেখ্য, গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার- টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। ঘটনার পর পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় দুটি ও রামু থানায় একটি মামলা করে। গত ৫ আগস্ট কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলা করেন সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। এই মামলায় এ পর্যন্ত সাত পুলিশ সদস্য, এপিবিএনের তিন সদস্য ও টেকনাফ পুলিশের দায়েরকরা মামলার তিন সাক্ষীসহ মোট ১৩ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। সিনহার বড় বোনের মামলায় নয়জনকে আসামি করা হয়। আসামিরা হলেন- বরখাস্ত হওয়া টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, টেকনাফের বাহারছড়া শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলী, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, এএসআই লিটন মিয়া, পুলিশ কনস্টেবল সাফানুর রহমান, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, মোঃ মোস্তফা ও এসআই টুটুল। এদের মধ্যে আসামি মোস্তফা ও টুটুল পলাতক বলেই উল্লেখ করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেছেন। পুলিশ সুপার দফতর থেকে জানানো হয়েছে ওই নামে কোন পুলিশ সদস্য জেলা পুলিশে নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
×