ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সঙ্কটের তিন বছর পূর্ণ হলো ভাসানচরে স্থানান্তরেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার ঘোর আপত্তি

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সুদূর পরাহত ॥ মিয়ানমারের টালবাহানা

প্রকাশিত: ২২:৩৯, ২৬ আগস্ট ২০২০

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সুদূর পরাহত ॥ মিয়ানমারের টালবাহানা

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আশ্রয় লাভের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে মঙ্গলবার। জাতিসংঘসহ বিশ্ব শক্তিসমূহের সব আবেদন নিবেদনে কর্ণপাত নেই মিয়ানমারের। ফলে অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান এ সঙ্কটের সমাধান এখনও সুদূর পরাহত। এ দীর্ঘ পথপরিক্রমায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমার পক্ষ কেবলই পরিস্থিতি ঘোলাটে করে রেখেছে। আন্তর্জাতিক আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশের প্রতিও তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রত্যাবাসনের নামে কেবলই কালক্ষেপণ করে চলেছে। আর এদিকে রোহিঙ্গা ভারে জর্জরিত বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে একের পর এক আবেদন পেশ করে চলেছে এই বলে যে, মিয়ানমার যেন তার দেশের নাগরিকদের যত দ্রুত সম্ভব ফিরিয়ে নেয়। অপরদিকে, রোহিঙ্গারা বলছে তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে আগ্রহী। তবে নাগরিকত্বের ঘোষণা নিয়ে এবং সসম্মানে। এ ঘটনা নিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর বাস্তুচ্যুত ও রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ্বের কাছে আবারও সহায়তা ও সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারীর ঘটনা এ পরিস্থিতি করেছে আরও জটিল। আর এ সুযোগ নিয়েছে মিয়ানমার। এখন তারা করোনা পরিস্থিতির বাহানা দেখাচ্ছে। মূলত প্রত্যাবাসনের কথা মিয়ানমার সরকার মুখে বললেও বাস্তবক্ষেত্রে এর বাস্তবায়নে আগ্রহের লেশমাত্র নেই। ইতোপূর্বে কয়েক দফায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ভ-ুল হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট গভীর রাতে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা পল্লীতে সে দেশের সেনাবাহিনীর বড় বড় অভিযান শুরু হয়। সেনা সদস্যদের গুলিতে একের পর এক রোহিঙ্গা নরনারী ও শিশুর প্রাণহানি ঘটে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ফলে প্রাণ রক্ষার্থে দলে দলে রোহিঙ্গারা নাফ নদী পার হয়ে ও সাগর পথে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। মানবিক কারণে সরকার তাদের আশ্রয় দেয়। ওই সময়ে এই সংখ্যা আন্তর্জাতিক হিসাব মতে সাড়ে ৭ লাখ হলেও পরে তা ১২ লাখেরও বেশিতে গিয়ে ঠেকেছে। এরপর থেকে গণহত্যা শুরুর এ দিনটিকে রোহিঙ্গা জেনোসাইড রিমেম্বার ডে বা গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে পালন করছে তারা। এ ঘটনা নিয়ে আইসিজিতে (আন্তর্জাতিক বিচার আদালত) মামলা হলে আদালত মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে রক্ষার অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনা প্রদান করে। ছোট দেশ গাম্বিয়ার পক্ষে এ মামলা করা হয়। গাম্বিয়ার পক্ষে পূর্ণ আর্জি এখনও পেশ করা হয়নি। এ ব্যাপারে প্রস্তুতি চলছে। এদিকে কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফ রোহিঙ্গা ভারে জর্জরিত। স্থানীয় অধিবাসীদের চেয়ে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা বেশি। এছাড়া রোহিঙ্গা পরিবারে আসছে নতুন নতুন আদম সন্তান। ফলে এ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে। এদের জন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য এনজিওসমূহ যেমন সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে, তেমনি দেশীয় এনজিওগুলোর মধ্যে অসংখ্য এ কাজে সংযুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে এ সঙ্কট সমাধানে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে আহ্বান জানানো হয়েছে। এ আহ্বান এখনও চলছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের অর্থায়নে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে বাস্তবায়ন হয়েছে বিশাল প্রকল্প। যেখানে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বসবাস উপযোগী করা হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থার নেতিবাচক মনোভাবের কারণে সেখানে স্থানান্তর সম্ভব হচ্ছে না। তবে সাগর পথে মালয়েশিয়ায় গমন থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে আসাসহ কিছু রোহিঙ্গাকে সেখানে রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থায় এ প্রকল্প গড়ে তোলা হলেও বিদেশী ও স্বদেশী এনজিও কর্মকর্তাদের বিলাসী জীবন যাপনের সুযোগ না থাকার কারণে তারা নানা অজুহাত তুলেছে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিরুদ্ধে। ফলে স্থানান্তরের বিষয়টিও থমকে আছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট কফি আনান কমিশন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের পক্ষে রিপোর্ট দেয়। ওইদিন গভীর রাতে মিয়ানমারে ২১টি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার ঘটনা ঘটে। এ হামলা রোহিঙ্গারা চালিয়েছে বলে অভিযোগ তোলে পরদিনই শুরু হয় সেনা অভিযান। রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করতে সেনা অভিযানের সঙ্গে পুলিশও অংশ নেয়। ওই সময় সহিংসতায় প্রাণ হারায় দশ সহ¯্রাধিক। হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া, নিমর্মভাবে শিশু হত্যা, সহায় সম্পদ কেড়ে নেয়াসহ এমন কোন বেআইনী কর্মকা- ছিল না যা রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো হয়নি। এ কারণে ২৬ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার ঘটনা শুরু হয়। যদিও এর বহু আগেও নিপীড়িত হয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আগমন ঘটেছে। কিন্তু ২৫ আগস্ট রাতের পর রোহিঙ্গা আগমনের ঢল নজিরবিহীন ঘটনা। ওই সময়ে রোহিঙ্গাদের আগমনের আগেও ৪ লাখ রোহিঙ্গার অবস্থান ছিল বাংলাদেশে। সবমিলে বাংলাদেশে এদের সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়েছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের জন্য মিয়ানমারে সেফ জোন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু মিয়ানমার এ প্রস্তাবে এখনও কোন সায় দেয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাখাইন রাজ্যের মংডু, বুচিদং ও রাচিদংয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য তিনটি সেফজোন প্রতিষ্ঠা সম্ভব। আর সেফজোনে তাদের দেখভালের জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা দায়িত্ব নিতে পারে। রোহিঙ্গাদের কারণে ক্ষতি ॥ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কারণে উখিয়া টেকনাফের পাহাড়ী বনভূমি ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ দুই উপজেলার কয়েক হেক্টর বনভূমি রোহিঙ্গাদের অবৈধ দখলে চলে গেছে। এলাকার ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। পরিবেশ বিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপনে ৬ হাজার ১৬৪ একর বনভূমির ওপর তৈরি করা হয়েছে ৩৩টি ক্যাম্প। এসব ক্যাম্প রাতের বেলায় সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। গোটা কক্সবাজার অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের কারণে আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি হয়ে আছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আমরা কক্সবাজারবাসীর সমন্বয়ক সমাজ সেবক কলিমউল্লাহ জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের ক্ষতির পরিমাণ দীর্ঘ। এর পাশাপাশি খাদ্য সামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বহুক্ষেত্রে দ্বিগুণ মূল্যে ক্রয় করতে হয়। পাহাড়ের গাছ গাছালি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এদের কারণে উখিয়া টেকনাফের ৬ হাজার হেক্টরেরও বেশি বনভূমির গাছপালা ধ্বংস হয়েছে। এদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার দ্রুত সমাধান চান এলাকাবাসী। সমাধান মিয়ানমারের হাতে ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান মূলত মিয়ানমার সরকারের হাতে। অথচ মিয়ানমার এদেরকে তাদের নাগরিক নয় বলেও জানান দিয়েছে। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যাচার হলেও সে পথেই রয়েছে মিয়ানমার। ইতোমধ্যে এ সঙ্কট সমাধানের ব্যাপারে সে দেশে এডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন এস্টেট গঠন হয়েছে। এ কমিশনের পক্ষে সুপারিশও হয়েছে। কিন্তু এর বাস্তবায়নও সুদূর পরাহত বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
×