ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খাবারের পাতে ফের মিলছে হারানো সব দেশী মাছ

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২৫ আগস্ট ২০২০

খাবারের পাতে ফের মিলছে হারানো সব দেশী মাছ

বাবুল হোসেন ॥ বাঙালীর খাবারের পাতে আবার ফিরে এসেছে আবহমান গ্রাম বাংলার নদ নদী হাওড় বাঁওড় ও খাল বিলের হারিয়ে যাওয়া সুস্বাদু মলা, ডেলা, খলিশা, পাবদা, টেংরা, গুলশা, কৈ, শিং, মাগুর, বৈরালিসহ হরেক প্রজাতির ছোট মাছ। মৎস্য বিজ্ঞানীরা জানান, বাংলাদেশে মিঠা পানির ২৬০ প্রজাতির মধ্যে ৬৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। তবে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন ও বাণিজ্যিকভাবে চাষের ফলে ইতোমধ্যে বিলুপ্তপ্রায় ২৩টি জাত পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে একুশে পদকপ্রাপ্ত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। ফলে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছের প্রাপ্যতা বেড়েছে এবং এসব মাছের দামও ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। এ বিষয়ে ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, বর্তমান সরকারের আমলে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছ সংরক্ষণে গবেষণা জোরদার করা হয়েছে এবং বিলুপ্তপ্রায় সকল মাছকে বাঙালীর খাবারের টেবিলে ফিরিয়ে আনতে প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ইনস্টিটিউট থেকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এসব প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে চাষীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি মৎস্য অধিদফতর থেকে নদ নদী ও খাল বিলে অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণেও নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান এই মৎস্য বিজ্ঞানী। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশে মৎস্য খাতের একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালীর খাদ্য তালিকায় এই ছোট মাছের রয়েছে বিশেষ কদর। এজন্যই প্রবাদে ছিল ‘মাছে ভাতে বাঙালী’। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মুক্ত জলাশয় ভরাট, সেচ দিয়ে মাছ আহরণসহ কৃষিকাজে কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক জলাশয়ের ছোট প্রজাতির মলা, ডেলা, পুঁটি, কাচকি, বাইম, চান্দা, পাবদা, গুলশা, টেংরা বৈরালি, রাজপুঁটি, খলিশা, ভাগনা, কৈ, শিং, মাগুর, গুজি, আইড়, ফলি, মহাশোল, বালাচাটা, গুতুমসহ অনেক মাছ বিলুপ্তির পথে। বাংলাদেশে মিঠা পানির ২৬০টি প্রজাতির মধ্যে ১৪৩টি ছোট মাছ। এর মধ্যে ৬৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। ফলে গত এক দশক আগেও বাজারে ছোট মাছের প্রাপ্যতায় ছিল নানা সঙ্কট। চাহিদার ছোট মাছ পাওয়া গেলেও দাম ছিল ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। বিশেষ করে দেশীয় কৈ, শিং, মাগুর, পাবদা কেনার সামর্থ্য ছিল না অনেকের। আবহমান গ্রাম বাংলার নদ নদী হাওড় বাঁওড় ও খাল বিল শুকিয়ে যাওয়াসহ জলবায়ুর প্রভাবে দেশীয় প্রজাতির সুস্বাদু বাহারি সব মাছ ছিল হারিয়ে যাওয়ার কাতারে। পুষ্টি সমৃদ্ধ ও সুস্বাদু বিলুপ্তপ্রায় এসব মাছ উৎপাদন ও সংরক্ষণে এ সময় এগিয়ে আসে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। গবেষণার জন্য হাতে নেয় নানা প্রকল্প। বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিগত ১৯৮৭ সাল থেকে ইতোমধ্যে ২৩টি মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষ কৌশল উদ্ভাবন করেছেন। প্রথমে ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহের স্বাদু পানি গবেষণা কেন্দ্র থেকে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে গবেষণা করা হলেও এখন বগুড়ার সান্তাহার, নীলফামারীর সৈয়দপুর ও যশোর উপকেন্দ্রে এই গবেষণা করা হচ্ছে। এর ফলে পাবদা, গুলশা, টেংরা, কৈ, শিং, মাগুর, গুজি, আইড়, চিতল, ফলি, মহাশোল, বৈরালি, রাজপুঁটি, মেনি, বালাচাটা, গুতুম, ভাগনা, খলিশা, বাটা, সরপুঁটি, কালি বাউশ, গজার, গনিয়াসহ বিলুপ্তপ্রায় ২৩টি প্রজাতির ব্যাপক চাষ হচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির পোনা উৎপাদনে বর্তমানে চার শতাধিক হ্যাচারি কাজ করছে। এর মধ্যে কেবল ময়মনসিংহ অঞ্চলেই ২০০ কোটি পাবদা ও গুলশা মাছের পোনা উৎপাদিত হচ্ছে। সংরক্ষণসহ এসব নানা কারণে নদ নদী হাওড় বাঁওড় ও খাল বিলেও মিলছে এসব মাছ। দেশজুড়ে বর্তমানে দেশীয় কৈ, শিং, মাগুর পাবদা, গুলশার ব্যাপক চাষ হচ্ছে। চাষীদের মধ্যেও এ নিয়ে তৈরি হয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। আগ্রহী চাষীদের ইনস্টিটিউট থেকে বছরজুড়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। ময়মনসিংহ সদরের দাপুনিয়া গ্রামের মাছ চাষী রায়হান জানান, তিনি আড়াই একর জমিতে দেশীয় শিং মাছের চাষ করছেন। বছরে দুবার বিক্রি হচ্ছে এই শিং। প্রতি কেজি শিং ৩০০-৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ইনস্টিটিউটের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সেলিনা ইয়াছমিন জানান, পুষ্টির অন্যতম উৎস এসব ছোট মাছে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন এ, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন ও আয়োডিনের মতো খনিজ উপাদান। এগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি রক্তশূন্যতা, গলগ- ও অন্ধত্ব প্রতিরোধে সহায়তা করে। ইনস্টিটিউট থেকে বর্তমানে কাকিলা, শাইল বাইম, রানী কাজলি, বাতাসি, ডেলা, আংগুস ভোল মাছ ও উপকূলীয় কাওন মাছের প্রজনন ও চাষ নিয়ে গবেষণা চলছে বলে জানান ইনস্টিটিউটের স্বাদু পানি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এএইচএম কোহিনুর। তিনি জানান, বিলুপ্তপ্রায় সবকটি প্রজাতি ফের খাবার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে নিরলস কাজ করছে ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। সর্বশেষ যোগ হলো বৈরালি ॥ এরই ধারাবাহিকতায় কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউ-বিএফআরআই এর বিজ্ঞানীরা দেশে প্রথমবারের মতো বিলুপ্তপ্রায় বৈরালি মাছের পোনা উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করেছে। ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহের সদর দফতর সূত্র এই তথ্য জানিয়েছে। আইইউসিএন এর গত ২০১৫ সালের তথ্যমতে বৈরালি মাছকে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। চলতি বছরের গত মার্চ মাসে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় বৈরালি মাছের পোনা উৎপাদনে সাফল্য অর্জিত হয়। বিএফআরআই এই সাফল্যের ফলে হারিয়ে যাওয়া এই মাছের আবার স্বাদ পাবে বাঙালীরা। ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, বাংলাদেশে বৈরালি মাছ বারালি, বরালি ও কোকসা নামেও পরিচিত। এই মাছের আরও পাঁচটি প্রজাতি রয়েছে। দেশে এক সময় এই মাছটি বৃহত্তর সিলেট, নেত্রকোনা ও রংপুর অঞ্চলে পাওয়া যেত। বর্তমানে রংপুর বিভাগের কয়েকটি নদী ও খালের স্বচ্ছ পানিতে সীমিত আকারে বৈরালি মাছ পাওয়া যায়। দেশের বাইরে ভারত, নেপাল ও মিয়ানমারেও এই মাছের বিস্তৃতি রয়েছে। সুস্বাদু এই মাছটি বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয়। সাম্প্রতিককালে মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক নানা কারণে এই মাছের প্রাচুর্যতা বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবং সুস্বাদু এই মাছকে বিপন্নের হাত থেকে রক্ষায় গত ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে স্বাদু পানি উপকেন্দ্র থেকে গবেষণা পরিচালনা করা হয়। গবেষক দলে ছিলেন উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. খোন্দকার রশীদুল হাসান ও বৈজ্ঞানিক কর্মকতা শওকত আহম্মেদ। রংপুর অঞ্চলের চিকলি, বরাতি, বুড়িখরা ও তিস্তা নদী হতে বৈরালি মাছ সংগ্রহ করে গবেষণা উপকেন্দ্রের পুকুরে প্রতিপালন করা হয়। গবেষণায় উপকেন্দ্র থেকে চলতি বছরের গত মার্চ মাসে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় বৈরালি মাছের পোনা উৎপাদনে সাফল্য অর্জিত হয়। এ সাফল্যের ফলে পর্যায়ক্রমে এই মাছের সকল প্রজাতিকে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা জানান। ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, সুস্বাদু বৈরালি মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে বৈরালি মাছকে চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে এবং মাছটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। উল্লেখ্য, দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণসহ গবেষণায় গৌরবজনক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চলতি ২০২০ সালে একুশে পদক লাভ করে।
×