রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তথা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো মোটেও ভাল চলছে না। তদুপরি নানা অনিয়ম-অব্যবস্থা-দুর্নীতি-খেলাপী ও অনাদায়ী ঋণে জর্জরিত। কোন কোনটি নিমজ্জিত। সরকারী আনুকূল্য ও দয়া-দাক্ষিণ্যে কোনক্রমে চলছে ব্যাংকগুলো। এর পাশাপাশি বর্তমানে অবলুপ্ত ফারমার্স ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক বহুল আলোচিত বিষয় ব্যাংকিং জগতে। অথচ দেশে ইসলামী ব্যাংকসহ বেসরকারী ব্যাংকগুলো নিয়মিত লভ্যাংশ অর্জন করে ব্যবসা-বাণিজ্য করে যাচ্ছে সুনামের সঙ্গে। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো, যেগুলো সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে, যেমন- প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক- এগুলোর কার্যক্রমের কোন খবর তথা তৎপরতা প্রায় নেই বললেই চলে। প্রধানত বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশী তথা প্রবাসীদের কল্যাণের নিমিত্ত ২০১১ সালে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিলের মালিকানায় গঠিত হয় প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে ২০১৮ সালে ব্যাংকটিকে তফসিলভুক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাণিজ্যিক কার্যক্রমের লাইসেন্স পাওয়ার পরও অদ্যাবধি কার্যক্রমে আসতে ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকটি। সারা দেশে মাত্র ৬৩টি শাখা নিয়ে কোনমতে সরকারের কাঁধে ভর করে চলছে এটি। সবচেয়ে যা দুঃখজনক তা হলো, মূলত প্রবাসীদের কল্যাণের জন্য গঠিত হলেও এখন পর্যন্ত রেমিটেন্স আহরণের কোন কাজই শুরু করতে পারেনি এই ব্যাংক। এজন্য যেসব পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয় তাও করেনি। এমনকি প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ বিদেশের ব্যাংকে নস্ট্রো এ্যাকাউন্টও খুলতে পারেনি। বর্তমানে রেমিটেন্স প্রেরণসহ প্রবাসীদের স্বার্থ রক্ষার কাজগুলো করছে অন্যান্য সরকারী-বেসরকারী ব্যাংকগুলো। এখন পর্যন্ত কিছু ক্ষেত্রে কেবল বিদেশ ফেরত বাংলাদেশীদের ‘অভিবাসন ঋণ’ ও ‘পুনর্বাসন ঋণেই’ সীমাবদ্ধ রেখেছে কার্যক্রম। করোনাভাইরাসের কারণে যেসব প্রবাসী দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন তাদের জন্য মাত্র ১১টি খাতে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া শুরু হয়েছে গত ২৫ জুলাই থেকে। ১ মার্চের পর যারা দেশে এসেছেন কেবল তারাই পাবেন এই ঋণ সুবিধা। এর জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড আপাতত ২০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বিনা সুদে। পরবর্তীতে আরও পাঁচ শ’ কোটি টাকা দেয়ার কথা রয়েছে। ফলে ব্যাংক গঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়েছে বলা চলে। ব্যাংকটির পক্ষে জনবল সঙ্কটের কথা বলা হলেও অধিকাংশই অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ বলে অভিযোগ আছে। ফলে এর খোলনলচে পাল্টানো জরুরী হয়ে পড়েছে।
অথচ দেশে ও বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর এই দুঃসময়েও বাংলাদেশের জন্য এক পরম প্রাপ্তি ও গৌরব বয়ে এনেছেন প্রবাসীরা। এবার অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। করোনাভাইরাসজনিত সঙ্কটে যখন দেশে-বিদেশে অর্থনীতির চাকা প্রায় স্থবির, আমদানি-রফতানি ঠেকেছে তলানিতে এবং পোশাক ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি রয়েছে রীতিমতো হুমকিতে, তখন এর চেয়ে আশা জাগানিয়া খবর আর কি হতে পারে? প্রধানত এই প্রবাসী আয়ের ওপর ভিত্তি করে এবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভও প্রথমবারের মতো ছাড়িয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এক্ষেত্রে অবশ্য সরকারের গত বছর থেকে প্রবাসী আয়ে নগদ ২ শতাংশ হারে প্রণোদনাও উৎসাহ জুগিয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক শ্রম সংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবে জানা যায়, বিশ্বের ১৬৯টি দেশে অন্তত এক কোটি ২০ লাখের মতো বাংলাদেশী রয়েছে, যাদের অধিকাংশই শ্রমিক। করোনার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামে ধস নামায় বর্তমানে অধিকাংশই হয়ে পড়েছেন বেকার তথা চাকরিচ্যুত। এক হিসাবে জানা যায়, শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই অন্তত দশ লাখ শ্রমিককে ছাঁটাই করে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে অন্তত এক হাজার ৮১৯ বাংলাদেশী মৃত্যুবরণ করেছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। সেক্ষেত্রে তাদের অসহায় পরিবার ও স্বজনদের দুঃখ-কষ্ট-দুর্ভোগ সহজেই অনুমেয়।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে এসব ক্ষেত্রে ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ অবদান রাখার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এ নিয়ে যেন কোন নয়-ছয় তথা দুর্নীতি-অনিয়ম না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে।
শীর্ষ সংবাদ: