ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এম. এ. হানিফ

প্রবাসী আয়ে রেকর্ড ॥ স্বস্তির নাকি উদ্বেগের

প্রকাশিত: ২২:৪২, ২৪ আগস্ট ২০২০

প্রবাসী আয়ে রেকর্ড ॥ স্বস্তির নাকি উদ্বেগের

দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি মনে করা হয় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। কঠোর পরিশ্রম করে তারা দেশে ডলার পাঠান। এতে সচল থাকে অর্থনীতির চাকা, বাড়ে রিজার্ভ। ১৯৭৬ সাল থেকে দেশে রেমিটেন্স আসা শুরু হয়। ঐ বছর আসে ৩৫.৮৫ কোটি টাকা। আর সদ্য বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে আসে রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স, যার পরিমাণ ১৮২০ কোটি ৪৯ লাখ ডলার। যা আগের অর্থ বছরের তুলনায় ১০.৯০ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আসে ২৬০ কোটি ডলার, যা এ যাবতকালে কোন এক মাসে আসা সর্বোচ্চ রেমিটেন্স। এর আগের রেকর্ডটি ছিল গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে। ঐ সময় এসেছিল ১৮৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। পর পর দু’মাস রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড তৈরি হলো। করোনা মহামারীর এ সময়ে পুরো বিশ্বের অর্থনীতির যখন টালমাতাল অবস্থা, তখন রেমিটেন্সের এই রেকর্ড অবশ্যই দেশের জন্য একটা দারুণ সুসংবাদ। কারণ এটা একদিকে দেশীয় মার্কেটে টাকার প্রবাহ বাড়িয়েছে, অন্যদিকে বাড়িয়েছে, দেশের রিজার্ভ। বর্তমানে দেশের রিজার্ভ ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অথচ ধারণা করা হয়েছিল করোনা মহামারীর কারণে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে বিরাট ধস নামবে। খোদ বিশ্বব্যাংক বলেছিল, করোনার কারণে এ বছর সারা বিশ্বে প্রবাসী আয় কমবে ২০ শতাংশ, আর বাংলাদেশে কমবে ২২ শতাংশ। শুধু বিশ্বব্যাংক নয়, রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ে বড় পতনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)। সংস্থাটি বলেছিল, করোনার পাশাপাশি বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ কারণে তারা অভিবাসী শ্রমিকদের ছাঁটাই করছে। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ওপরও। অথচ গত তিন মাস ধরে রেমিটেন্স প্রবাহ উর্ধমুখী, যদিও বছরের শুরু থেকে এপ্রিল পর্যন্ত তা ছিল নিম্নমুখী। এবার রেমিটেন্স আহরণে রেকর্ড় গড়া সম্ভব হয়েছে অর্থবছরের শুরু থেকেই সরকারের নেয়া বেশ কিছু পদক্ষেপের কারণে। প্রথমত, প্রবাসী আয়ের ওপর সরকার ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা ঘোষণা করে। এরপর থেকেই বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়তে থাকে। দ্বিতীয়ত, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রবাসী আয়ের মন্দা দূর করতে প্রবাসীদের পাঠানো পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে কোন যাচাই-বাছাই ছাড়াই ২ শতাংশ সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, যা আগে দেড় লাখ পর্যন্ত ছিল। তৃতীয়ত, মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে টাকা পাঠানোর সুযোগ তৈরি হওয়ায় হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো কমেছে। গত তিন মাসে রেকর্ড সংখ্যক রেমিটেন্স আসার পিছনে উল্লিখিত কারণ ছাড়াও আরও কিছু কারণ রয়েছে। যেমন, করোনা মহামারীর কারণে প্রবাসে চাকরির অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অনেককে দেশে ফেরত আসতে হয়েছে। অনেকে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। তারা তাদের জমানো সঞ্চয় ভেঙ্গে দেশে পাঠাচ্ছেন। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে অনেক দেশ রেমিটেন্স হাউস ও ব্যাংকগুলো বন্ধ করেছিল। ফলে প্রবাসীরা টাকা দেশে পাঠিয়েছেন। ফলে এত বেশি রেমিটেন্স এসেছে। প্রবাসী আয়ে শীর্ষ দশটি দেশের একটি বাংলাদেশ। বিশ্বে ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশী প্রবাসে রয়েছে। তাদের প্রায় ৭৫ ভাগ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। শুধু সৌদি আরবেই রয়েছেন ১৫-২০ লাখের মতো প্রবাসী। দেশের এই সঙ্কটকালে প্রবাসীরা রেকর্ড সংখ্যক রেমিটেন্স পাঠালেও খুব একটা ভাল নেই তারা। অনেকের বেতন কমে গেছে, অনেকের কাজ নেই। বিদেশে থাকতে অনেকে ভরসা পাচ্ছেন না। দেশে চলে আসছেন। সরকারী হিসেবেই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২২ হাজার প্রবাসী দেশে এসেছেন বলে জানা যায়। হয়ত বাস্তব সংখ্যা এর চাইতেও বেশি। তাই গত তিন মাসে যে রেমিট্যান্স এসেছে তাতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার খুব একটা কারণ নেই, বরং এটা দীর্ঘমেয়াদে একটা উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি মাইগ্রেশনের নয়টি সংগঠন কর্তৃক মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত ২০০ প্রবাসী পরিবারের ওপর চালানো এক জরিপে দেখা গেছে, করোনাকালে ৬৪ শতাংশ পরিবারের রেমিটেন্স আসা বন্ধ হয়েছে, ৬১ শতাংশ পরিবারে তিন মাসে রেমিটেন্সের কোন অর্থ আসেনি। ৩৬ শতাংশ পরিবার আগের চেয়ে কম অর্থ পেয়েছে। জরিপভুক্ত ৫৭ শতাংশ পরিবারের একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম প্রবাসী আয়। এছাড়াও, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা, আইওএমের করা আরেক জরিপে বলা হচ্ছে, দেশে ফেরত প্রবাসীদের ৭০ শতাংশ বর্তমানে জীবিকা সঙ্কটে রয়েছে। সুতারাং রেমিটেন্সের এই উর্ধমুখী ধারা যে প্রবাসীদের বর্তমান আয়ের চিত্র, এটা বলার সুযোগ কম। তাই এই ধারা ধরে রাখা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। সেই সঙ্গে যারা দেশে ফেরত এসেছেন এবং সামনে আসবেন, তারা অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়বেন। তাই এখনই তাদের জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেয়া দরকার। ঠিক কতজন প্রবাসী দেশে ফিরলেন, তাদের কতজনের আয়ের বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই, এসব তথ্য জানা খুব জরুরী। নইলে বড় একটা কর্মক্ষম শ্রেণীর আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার প্রবাসীদের জন্য ৭০০ কোটি টাকার প্রবাসী কল্যাণ ঋণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। প্রবাসীরা যাতে দেশেই সঞ্চয় করতে পারে, সেজন্য এক বছর বা তার বেশি মেয়াদী সঞ্চয় স্কিম চালু করেছে। নিঃসন্দেহে এসব ভাল উদ্যোগ। তবে এর পাশাপাশি তাদেরকে কিভাবে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা যায়, সে চেষ্টা করা উচিত। এ জন্য প্রয়োজনীয় বাধা দূর করার বিষয়ে সরকারকে আরও বেশি পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সঙ্গে জনশক্তি রফতানি যাতে অব্যাহত থাকে, সেজন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। করোনার কারণে অনেক দেশ কর্মী নিচ্ছে না। অনেক দেশ ফ্লাইট বন্ধ করেছে। দেশ থেকে ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট নিয়ে যাওয়ায় অনেককে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে বিদেশে আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করাতে হবে। প্রবাসী আয়ে সামনের কাতারের দেশ হলেও আমাদের কর্মীদের একটা বড় অংশ অদক্ষ, এটা ভুলে গেলে চলবে না। বিশ্ববাজারে দেশের ভাবমূর্তি ও কর্মী চাহিদা বাড়াতে দক্ষতা বৃদ্ধিতে জোর দেয়ার কোন বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়া কমাতে হবে। মনে রাখতে হবে রেমিটেন্সের এই সাফল্য এক দিনে তৈরি হয়নি। এটা সরকারের একটা দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফল। তাই এই সাফল্য ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় গবেষণা ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের এটাই উপযুক্ত সময়। একটা তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প যেমন নদীর গতিপথ বদলে দেয়, করোনা সেরকমই পৃথিবীর পরিস্থিতি এরই মধ্যে অনেক বদলে দিয়েছে। সামনে হয়ত আরও বদলে দেবে। তাই এর জন্য এখনই প্রস্তুত থাকা চাই। নইলে রেমিটেন্সের এ সাফল্য ধরে রাখা হয়ত সম্ভব হবে না। লেখক : কথাসাহিত্যিক [email protected]
×