ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোস্তাফা জব্বার

নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ ॥ বরেণ্য জেআরসি

প্রকাশিত: ২২:৪১, ২৪ আগস্ট ২০২০

নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ ॥ বরেণ্য জেআরসি

দেওয়াং মেহতা ও বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি : জে আরসি কমিটির প্রথম সুপারিশটি ছিল কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও কর প্রত্যাহার করার। আমাদের কমিটির যে দলটি ভারত গিয়েছিল তারা অনুভব করেছিল যে ভারতের সফটওয়্যার রফতানির রূপকথার মতো সাফল্যের নেপথ্য কাহিনী জানার জন্য ভারতের নাসকমের নির্বাহী পরিচালক দেওয়াং মেহতার সঙ্গে আমাদের কথা বলা দরকার। কিন্তু ভারত সফরকালে তারা মেহতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। আামরা ১৪ সেপ্টেম্বর ৯৭ জেআরসি রিপোর্ট পেশ করার পর আজিজ ভাই আমেরিকা যান। সেখানে তিনি জানতে পারেন যে ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে অবস্থিত গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে নাসকম আয়োজিত এক সেমিনারে দেওয়াং মেহতা অংশ নেবেন। অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে তিনি সেখানে মেহতার সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানান। মেহতা শর্ত দিলেন যে, তাকে সরকারীভাবে আমন্ত্রণ জানাতে হবে এবং তার আসা যাওয়া-থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আজিজ ভাই আমেরিকা থেকেই আমাকে ফোন করে দুটি শর্তসহ বিসিএস সম্মতি দেবে কিনা সেটি জানতে চাইলেন। আমি তখন কাজী নজরুল ইসলাম রোডের ভাড়া বাড়িতে থাকি। রাতের বেলা তিনি ল্যান্ডলাইনে ফোন করেন। আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে আজিজ ভাইয়ের প্রস্তাবে সম্মতি দিলাম। আজিজ ভাই ঢাকা এসে সরকারী আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিলেন। আমরা জেআরসি স্যারকে অবলম্বন করে ইপিবির মাধ্যমে মেহতাকে সরকারীভাবে আমন্ত্রণ জানালাম। বিসিএস-এর পক্ষ থেকে তার আসা যাওয়ার টিকেট ও ইন্টারকন হোটেলে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। মেহতাকে মূল বক্তা রেখে আমরা ১৪ ডিসেম্বর ইপিবি-বিসিএস এর যৌথ সেমিনারের ব্যবস্থা করলাম। সেমিনারের বিষয়বস্তু ছিল হাও টু এন্টার দ্য সফটওয়্যার এক্সপোর্ট মার্কেট। কিন্তু ১৪ ডিসেম্বর দেওয়াং মেহতা না পৌঁছানোর জন্য আমরা সেমিনারটির আয়োজন করি ১৮ ডিসেম্বর ৯৭। সেই সেমিনারে আমিই সভাপতিত্ব করি। প্রথমে কথা ছিল মন্ত্রীদের বক্তব্য শেষ হলে মেহতা কথা বলবেন। জেআরসি স্যারের মধ্যস্থতায় আমরা মন্ত্রীদের আগে মেহতাকে কথা বলাতে পারলাম। কথা ছিল মেহতা ১০ মিনিট কথা বলবেন। কিন্তু তিনি ৪০ মিনিট কথা বললেন। মেহতার বক্তব্যের পর মন্ত্রী মহোদয়রা মেহতার সুরেই কথা বললেন। এই একটি সেমিনারে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত বস্তুত একযুগ সামনে যেতে পেরেছিল। মেহতা, জেআরসি ও আমার বক্তব্যে আমাদের নীতি নির্ধারকগণ বুঝতে সক্ষম হলেন যে আগত দিনগুলো তথ্যপ্রযুক্তির। তারা এটি বুঝতে পেরেছিলেন যে আগামীর যাত্রী হতে হলে ঘরে ঘরে কম্পিউটার পৌঁছাতে হবে এবং সেজন্য কম্পিউটারকে বিলাস সামগ্রী হিসেবে গণ্য না করে এর বিস্তার ঘটাতে হবে। আমরা জেআরসি কমিটির প্রতিবেদনে সামগ্রিক বিষয়াদি তুলে ধরার পরও মেহতার মুখে ভারতের এগিয়ে যাবার ইতিহাসটা শুনে আমাদের নীতিনির্ধারকরা একটা বড় ঝাঁকুনি পান। ২০০১ সাল পর্যন্ত এই বেগটা প্রবাহিত হয় এবং সেই পাঁচ বছরে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তির পশ্চাৎপদতাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। ২০০১ সাল নাগাদ আমরা তথ্যপ্রযুক্তির মানচিত্রের ভেতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হই। দুঃখজনক হলো ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তির যে অগ্রযাত্রাকে সামনে নিয়ে যাচ্ছিলেন তার গতি বিপরীত দিকে ধাবিত করা হয়। শুল্কমুক্ত কম্পিউটার : বিসিএসের নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে ১১ ডিসেম্বর থেকে বিসিএস কম্পিউটার শোর আয়োজনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা। আমরা মেহতাকে কম্পিউটার মেলা দেখাতে চেয়েছিলাম। ’৯৬ সাল বা তারও আগে থেকেই বিসিএস শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত কম্পিউটারের দাবি অব্যাহতভাবে তুলে ধরা সত্ত্বেও ৯৭-৯৮ সালের বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটেনি। এই বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই আমরা বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি সেই বিসিএস কম্পিউটার শোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করেছিলাম তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে। ২ ডিসেম্বর ৯৭ শেরাটনের এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে জনাব কিবরিয়ার প্রধান অতিথি হওয়া নিশ্চিত করেছিলেন আজিজ ভাই। এর আগে আমি বার বার চেষ্টা করেও মাননীয় মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। ১১ ডিসেম্বর ৯৭ বিসিএস কম্পিউটার শোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মরহুম কিবরিয়া সাহেবের বক্তব্য পেশের আগে আমি সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও কর প্রত্যাহারের দাবি জানাতে থাকি। বিসিএসের তখনকার সহসভাপতি আব্দুল্লাহ এইচ কাফি অনুষ্ঠানের মঞ্চে ছিল। সেখান থেকে সে স্লিপ পাঠাল যে কিবরিয়া সাহেব আমার বক্তব্যে বিরক্ত হচ্ছেন এবং আমার উচিত কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি পেশ না করা। কাফির স্লিপ পেয়ে আমি বক্তব্য দ্রুত শেষ করলাম। কিবরিয়া সাহেব তার বক্তব্যে আমাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। অনুষ্ঠান শেষে তাকে কম্পিউটারের মেলা দেখালাম। মেলা দেখে তিনি এত খুশি হলেন যে যাবার সময় আমাকে ও আমার টিমকে ধন্যবাদ দিলেন এমন আয়োজন করার জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় শাহ এ এম এস কিবরিয়া তার দৃষ্টিভঙ্গি বদল করেন এবং ৯৮ সালের ৪ জানুয়ারি এক সভায় সফটওয়্যারের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করেন। এরপর ’৯৮-৯৯ সালের বাজেটে কম্পিউটারের হার্ডওয়্যারের ওপর থেকে সকল শুল্ক ও কর তুলে নেন। আমরা জেআরসি কমিটির রিপোর্ট বাস্তবায়নের কাজও জোরেশোরে করতে থাকি। আমাদের করণীয় একটি কাজ ছিল বেসিস গঠন করা। ’৯৭ সালে বেসিস গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলেও এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮। সেদিনও আমরা ইপিবি ও বেসিসের উদ্যোগে ঢাকার হোটেল সোনারগাঁও এ একটি সেমিনারের আয়োজন করি। সেমিনারের বিষয়বস্তু একই ছিল; হাও টু এন্টার দ্য সফটওয়্যার এক্সপোর্ট মার্কেট। সেখানেও দেওয়াং মেহতা উপস্থিত ছিলেন। প্রয়াত শাহ এ এম এস কিবরিয়া, মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও তোফায়েল আহমেদ যারা মেহতার প্রথম সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন তারাও সেই সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন। সেমিনারে প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। আমি বিটিভির পক্ষে দুবারই মেহতার দুটি সাক্ষাতকারও গ্রহণ করি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, মেহতাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, সফটওয়্যার রফতানির ক্ষেত্রে ভারতের সবচেয়ে বড় ভুলটি কি? মেহতা বলেছিলেন, ভারত প্রযুক্তির ওপরের স্তরটার দিকে না তাকিয়ে কামলাগিরি করছে। আমি আশা করি এখন যারা ভারত-বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার ও সেবা রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেন তারা প্রয়াত মেহতার সেই কথাটির মর্ম অনুভব করবেন। করোনা পরবর্তীকালে পুরো প্রেক্ষিতটি যে বদলে যাবে সম্ভবত সেটিও আমাদের অনুভব করতে হবে। মেহতা সেই ৯৭-৯৮ সালে বুঝতে পেরেছিলেন যে আউটসোর্সিং নামক কামলাগিরি প্রযুক্তি দুনিয়ার ভবিষ্যত নয়, বরং উদ্ভাবন হচ্ছে বড় শক্তি। আমরা অন্তত সেটি এখন যেন বুঝতে পারি। তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ ও ডিজিটাল শিক্ষার যাত্রা : জেআরসি স্যারের ঢাকা শহরের পৈত্রিক বাড়িটি হচ্ছে ৬৮ এলিফ্যান্ট রোড। ৮৭ সালে কম্পিউটারে বাংলা ও ৮৮ সালে বিজয় কীবোর্ড প্রবর্তন করার পাশাপাশি আমি তখন দেশজুড়ে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিই। ঢাকার নানা জায়গায় ভাড়া থাকতে থাকতে ৯৭-৯৮ সালের দিকে জেআরসি স্যারের বাসার পাশে এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাসায় ভাড়া থাকা শুরু করি। আমার প্রশিক্ষণের বিষয় ছিল গ্রাফিক্স ও মাল্টিমিডিয়া। তখন আমাদের পারিবারিক বন্ধু ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বর্তমানে সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জমানের সঙ্গে একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন করার পরিকল্পনা করি। আমরা তখন জানতে পারি যে স্যারের বাসার দোতলাটা খালি। স্যারের কাছে গিয়ে প্রস্তাব দিলাম যে স্যার আপনার দোতালাটায় একপাশে আমরা চারজন (স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা) থাকব এবং আরেক পাশে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেব। স্যার ছাত্রছাত্রীদের অত্যাচারের বিষয়টি মাথায় রেখেই সম্মতি দিলেন। সেই মোতাবেক আমরা সুবর্ণ-বিজয় নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করলাম। সুবর্ণ ছিল আক্তারুজ্জামানের ছেলের নাম আর বিজয় আমাদের ছেলের নাম। সেই সময়ে ৯৯ সালে গাজীপুরের কাজী আজিমুদ্দিন কলেজের শিক্ষক সদ্য প্রয়াত মজিবুর রহমান একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রস্তাব করে। আমি তাকে একটি শিশুদের মাল্টিমিডিয়া স্কুল বা কম্পিউটারভিত্তিক স্কুল প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করি। তিনি রাজি হলে আমি স্যারকে জানালাম যে আমি একটি মাল্টিমিডিয়া স্কুল চালু করব। স্কুলের ধারণাটা স্যারকে জানালাম। তিনি শিশুদের কম্পিউটার শিক্ষিত করা ও কম্পিউটারের মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষা দান করার ধারণাটি প্রশংসা করেন। ঢাকার কাছে গাজীপুরের ছায়াবীথিতে ৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর সেই স্কুলটি চালু করার প্রস্তাব করে স্যারকেই উদ্বোধন করতে বলায় তিনি সস্ত্রীক সেটির উদ্বোধন করেন। সেই ৯৯ সালে তিনি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তরে কাজ করার জন্য আমাদের উৎসাহিত করেন এবং কাজটি যেন আমরা সাহসের সঙ্গে সামনে নিয়ে যাই সেই আহ্বান জানান। আমরা সেই স্কুলের মাধ্যমেই বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শিশুদের কম্পিউটার শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা করি। একই সঙ্গে সেই আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল কম্পিউটারের মৌলিক জ্ঞান, গ্রাফিক্স ও মাল্টিমিডিয়া বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করি। প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর বাড়ি থাকার সুবাদে তার ড্রইং রুমে প্রায়ই তথ্যপ্রযুক্তি এবং তার বিবিধ বিষয় নিয়ে কথা বলতাম। তার স্ত্রী সেলিনা মল্লিক যতেœর সঙ্গে নিজ হাতে চা বানিয়ে খাওয়াতেন। বস্তুত বাংলাদেশের ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থার সূচনাটি আমি তার হাত দিয়েই করতে পারি। তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা প্রণয়নের সময় আমি স্যারকে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার কথাও জানাই। অনেকের মূর্খতার জন্য ধারণাটি ৮ সালের খসড়ায় ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা তুলে ধরতে পারিনি। বস্তুত তথ্যপ্রযুক্তির সকল বিষয়ে আমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ও ব্যবসায়ী বিধায় বিশেষ মহলের কাছে অপাঙ্ক্তেয় বিবেচিত হলেও তিনি ছিলেন আমার আশ্রয়দাতা ও অভিভাবক। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব না আমাদের দেশে এমন আর কোন অভিভাবক পাব কিনা। আজ যখন তিনি নেই তখন তার কথা ভাবতেই মনটা ভারি হয়ে যায় আর চোখটা পানিতে ভরে আসে। ঢাকা, প্রথম লেখা ৮ মে ২০২০। সর্বশেষ সম্পাদনা ২২ আগস্ট ২০২০ ॥ মতামত লেখকের নিজস্ব। লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক [email protected], www.bijoyekushe.net.bd, www.bijoydigital.com
×