ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকৃতির বৈরিতা

প্রকাশিত: ২২:৪০, ২৪ আগস্ট ২০২০

প্রকৃতির বৈরিতা

প্রকৃতি স্বেচ্ছাচারী নয়, তার নিজস্ব ছন্দ রয়েছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাত, দাবদাহ এবং বন্যা- এসবই প্রকৃতিসম্মত আচরণ। মানুষসহ এ গ্রহের প্রাণিজগতকে এসবের সঙ্গেই সহাবস্থান করতে হয়। প্রকৃতির ওপর অত্যাচার করলে এক সময় সে রুখে দাঁড়ায়, বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আমরা তখন বলি যে, প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে। প্রকৃতি কেন বৈরী হয়ে ওঠে সেসব নিয়ে আমাদের ভাবনা-চিন্তা কম। বরং প্রবৃতির ওপর অত্যাচার এবং ক্ষেত্রবিশেষে তার বিরুদ্ধাচারণ করে যাই। ফলে তার একটি প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আমরা বিপন্ন বোধ করি। বর্তমানে পৃথিবী যেভাবে চলছে তাতে প্রকৃতির রুদ্ররূপ আমাদের দেখে যেতে হবে বহুকাল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই বহু বিঘ্ন ঘটছে বিশ্বে। মানুষের লোভ, অতিরিক্ত সুখ ও আরামের সন্ধান এবং আধুনিকতার নামে বিচিত্র পণ্য উৎপাদনের প্রয়োজনে কল-কারখানা চালাতে গিয়ে পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে ফেলেছি আমরা। গত বছর বিশ্বখ্যাত নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, কোথাও তাপমাত্রা ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাতের পরিমাণ ১২ শতাংশ বেড়ে যায়। গত ৩০ বছরে বিশ্বের তাপমাত্রা ইতোমধ্যে ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে গেছে, ফলে বজ্রপাতও বাড়ছে। এ বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রতি মাসেই দেশে বৃষ্টিপাত গত ৩০ বছরের গড় তুলনায় স্বাভাবিকের চেয়ে ছিল বেশি। আর তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে কম। এবার অন্যতম বড় বন্যা ছাড়াও এ বছরই বাংলাদেশে গত ১০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানে। কালবৈশাখী ও বজ্রপাতও এবার ছিল অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। দুই সপ্তাহ ধরে আন্দামান সাগর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি ছিল। এ কারণে সেখানে দ্রুত ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি প্রচুর জলীয়বাষ্প তৈরি হচ্ছে, যা মৌসুমি বায়ুর সঙ্গে মিশে বাংলাদেশ ও ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। এ কারণে এখানে বৃষ্টি ও বন্যা বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করলে দেখা যায় প্রকৃতির স্বাভাবিক আচরণ শত শত বছর ধরে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে এক প্রকার সহনীয়ই ছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রকৃতির আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দিয়েছে। এর পেছনে আমরা যতটা না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী উন্নত দেশগুলো। তাদের চিন্তাহীন স্বেচ্ছাচারী তথাকথিত উন্নয়ন প্রক্রিয়া জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। বদ্বীপ এলাকা ও হিমালয়ের পাদদেশে হওয়ায় বাংলাদেশে প্রতিবছরই বন্যা হয়। ৫১ দিন ধরে চলা বন্যায় দেশের ৩৭ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ৯০ লাখ মানুষ। ফসলের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। জরুরী ত্রাণ এবং পুনর্বাসন পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের ভেতর দিয়ে আমরা হয়ত এ ক্ষতি অনেকটাই পুষিয়ে নিতে পারব। কিন্তু প্রতি বছরই যে প্রকৃতির বৈরিতা বেড়েই চলেছে সেজন্য আমরা কি প্রস্তুত? সরকার ও জনগণের সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তনকে বিবেচনায় আনার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। একদিকে প্রকৃতির বৈরিতা থেকে রক্ষা পেতে হলে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হবে, অপরদিকে প্রতিটি পদক্ষেপেই বিজ্ঞানসম্মত পথ গ্রহণ করতে হবে। সেজন্য চাই মহাপরিকল্পনা ও বৃহত্তর উদ্যোগ।
×