ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লিয়াকতসহ তিনজনকে আজ আদালতে সোপর্দ করা হবে ॥ প্রদীপ দম্পতির বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

গাড়ি থেকে নামতে বলেই গুলি- রহস্য কী?

প্রকাশিত: ২২:২৯, ২৪ আগস্ট ২০২০

গাড়ি থেকে নামতে বলেই গুলি- রহস্য কী?

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যার বিষয়ে এ পর্যন্ত বিভিন্ন বক্তব্য বিভিন্নভাবে উঠেছে। এরমধ্যে সত্য মিথ্যা উভয়েরই সংমিশ্রণ রয়েছে। তবে সিনহা হত্যাকান্ডের মামলায় তদন্ত সংস্থা র‌্যাবের তদন্তে রবিবার পর্যন্ত যেসব বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে গত ৩১ জুলাই টেকনাফের বাহারছড়ার শামলাপুরস্থ এপিবিএন চেকপোস্টে রাত অনুমান সোয়া ৯টার দিকে সিনহাকে গাড়ি আটকিয়ে বের হওয়ার নির্দেশ দিয়ে গুলিতে হত্যা করা হয়। প্রথমে একটি ও পরে আরও তিনটি গুলি করেন বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন টেকনাফ থানার এএসআই নন্দদুলাল রক্ষিত। উভয়ই সিভিল ড্রেসে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তদন্ত সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, সিনহাকে হত্যার পর টেকনাফ থানায় নন্দদুলাল রক্ষিত যে মামলাটি রুজু করেন এবং তাতে যেসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে সেটিই ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীর বক্তব্য হিসেবে বলেছেন তিনি। জিজ্ঞাসাবাদে লিয়াকত বলেছেন, তিনি তার তিন সোর্সের কাছ থেকে তথ্য পেয়েছিলেন মারিসবুনিয়া পাহাড়ে দুইজন ডাকাতকে দেখা গেছে। এ ঘটনার পর তিনি তার ফোর্স নিয়ে রাত ৯টার পর শামলাপুর চেকপোস্টে পৌঁছান। সেখানে আটকানো হয়েছিল সিনহার গাড়ি। মামলায় তার দাবি রয়েছে, গাড়ি থেকে সিনহা তাকে লক্ষ্য করে পিস্তল তাক করেছিলেন। ফলে তিনি আত্মরক্ষার্থে গুলি করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আরও বলেছেন, ভুল ইনফরমেশনের কারণে সিনহাকে ডাকাত মনে করে গুলি করা হয়েছে। অপরদিকে, ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শী এবং কয়েক সাক্ষী বলেছেন, ঘটনার সময় তারা সিনহার হাতে কোন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র দেখেননি। সিনহার পিস্তলটি ছিল গাড়ির পেছনের সিটে। এদিকে, ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী এএসআই নন্দদুলালের পিস্তল দিয়ে সিনহাকে গুলি করার যে একটি তথ্য পাওয়া গেছে, তদন্ত সংস্থা র‌্যাব তা খতিয়ে দেখছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে একজনের অস্ত্র দিয়ে অন্যজনের গুলি করার বিধান নেই। যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে সেটিও একটি অপরাধ। এসব কারণে গ্রেফতারের পর তাদের আগ্নেয়াস্ত্র র‌্যাব হেফাজতে নেয়া হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, এ পর্যন্ত তদন্তে যা মিলছে তাতে একটি কথা সত্য যে, হত্যাকান্ডের এ ঘটনা কোন সংস্থা বা বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়নি। ঘটনাটি তাৎক্ষণিক বা পরিকল্পিত যেটাই হোক সেটির জট অবশ্যই খুলে যাবে। বিচারের উদ্দেশ্যে তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনার আদ্যোপান্ত জেনে নিচ্ছেন এবং তা গুছিয়ে আনছেন। যার কারণে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইতোমধ্যে ঘটনাস্থলসহ বিভিন্ন পয়েন্টে পরিদর্শনে গেছেন। রবিবার পর্যন্ত ১১ পুলিশসহ ১৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ৩ জনের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। যে তিনজনের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে তারা এপিবিএনের সদস্য। ঘটনার সময় তারা শামলাপুর চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনরত ছিলেন। তাদের সামনে এ ঘটনা ঘটেছে। অপরদিকে, এ ঘটনার একেবারেই প্রত্যক্ষদর্শী ও একেবারে কাছের সাক্ষী হলেন নিহত সিনহার সহযোগী সিফাত। র‌্যাব তার বক্তব্য নিয়েছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বক্তব্য এখনও লিপিবদ্ধ হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, সিনহার তিন সহযোগী সিফাত, শিপ্রা ও তাহসিনের বক্তব্য নিয়ে তাদের সাক্ষীও করা হতে পারে। এদিকে হত্যাকান্ডের ঘটনা প্রবাহ উদ্ঘাটনে জটিল কোন পরিস্থিতি এখনও সৃষ্টি হয়নি। আসামি ও সাক্ষীদের প্রত্যেকের বক্তব্যের মিল অমিল নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা পরবর্তীতে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। এর পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গঠিত এ সংক্রান্তে তদন্ত কমিটি চলতি মাসের একেবারে শেষ পর্যায়ে তাদের রিপোর্ট পেশ করবেন বলে ধারণা দিয়েছে। এ পর্যন্ত তারা ৬৭ জনের বক্তব্য নিয়েছেন। এখন শুধু অপেক্ষা একজনের। তিনি প্রদীপ কুমার দাশ। টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি। তার বক্তব্য পাওয়া গেলে জবানীদাতার সংখ্যা হবে ৬৮। প্রদীপ র‌্যাবের রিমান্ড হেফাজতে থাকায় তার বক্তব্য নেয়া যায়নি। আজ প্রদীপসহ ৩ জনকে রিমান্ড শেষে আদালতে সোপর্দ করা হবে। এরপর তার বক্তব্য নেয়া হবে বলে তদন্ত কমিটি সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে। বহুল আলোচিত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকা- পরিকল্পিত না তাৎক্ষণিক এ নিয়ে রবিবার পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে যেতে পারেনি তদন্ত সংস্থা র‌্যাব। অনুরূপভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটিও গ্রেফতার হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বক্তব্য নেয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। সিনহা হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রধান তিন আসামি প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলী ও নন্দদুলাল রক্ষিতের ৭ দিনের রিমান্ড শেষে আজ তাদের আদালতে সোপর্দ করা হবে। র‌্যাব সূত্রে জানানো হয়েছে, তাদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদে যেসব তথ্য মিলেছে তা অন্য আসামিদের জবানবন্দী এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের পক্ষে প্রদত্ত সাক্ষী খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রদীপসহ এ তিন আসামিকে প্রয়োজনে আবারও আদালতের অনুমতি নিয়ে রিমান্ডে নেয়া হবে বলে র‌্যাব জানিয়েছে। অপরদিকে, গ্রেফতারকৃত এপিবিএনের ৩ সদস্যের ৭দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। উল্লেখ্য, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খান হত্যা মামলার অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ১৮আগস্ট জেলা কারাগার থেকে এই তিন আসামিকে মামলার আইও র‌্যাব-১৫ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার খায়রুল ইসলামের হেফাজতে নেয়া হয়েছিল। ৬ আগস্ট মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে শুনানি শেষে আদালত প্রত্যেককে ৭দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন। এপিবিএন সদস্যদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে ॥ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় গ্রেফতার হওয়া আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের বরখাস্ত হওয়া তিন সদস্য রিমান্ডে র‌্যাব হেফাজতে রয়েছেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এপিবিএন-এর তিন সদস্য এসআই মোঃ শাহজাহান, কনস্টেবল রাজিব ও আবদুল্লাহর প্রত্যেকের সাতদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। প্রদীপের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ॥ আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা ডনদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়েছিলেন তৎকালীন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ দাশ। এটি একটি জোরালো অভিযোগ প্রদীপের বিরুদ্ধে। টেকনাফে দুই দফায় আত্মসমর্পণ করেছেন ১২৩ ইয়াবাকারবারি। গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২ জন এবং চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি ২১ জন ইয়াবাকারবারি আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের পর তাদের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় অস্ত্র ও মাদকবিরোধী আইনে মামলা হয়। তবে ওসি প্রদীপের মাধ্যমে ইয়াবা ডনদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া যখন চলছিল, তখন তারা গ্রেফতার হবে না মর্মে নিশ্চয়তা পেয়ে তাদের কালো টাকা ও অঢেল সম্পদ অন্যত্র সরিয়ে ফেলার সুযোগ করে দিয়েছিলেন ওসি প্রদীপ। স্থানীয় ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, ইয়াবার কারবারে বিনিয়োগকারীরা আর্থিক অনুসন্ধানের ধীরগতির সুযোগ নিয়ে টাকা-পয়সা সরিয়ে ফেলেছে। অনেকে আত্মসমর্পণের আগেই এই কৌশল নেয়ায় সম্পদের তথ্য পাননি তদন্তকারীরা। প্রদীপ দম্পতির বিরুদ্ধে দুদকের মামলা ॥ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত প্রায় ৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগে সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও চুমকি কারণের বিরুদ্ধে রবিবার চট্টগ্রামে দুদক মামলা করেছে। বিকেলে চট্টগ্রাম দুদক জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী অসৎ উদ্দেশ্যে একে অপরের সহযোগিতায় ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এতে উল্লেখ করা হয়, দুদকে দাখিলকৃত তাদের সম্পদ বিবরণীতে ১৩ লাখ ১৩ হাজার ১৭৫ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করার পাশাপাশি ৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করা হয়েছে। এর আগে প্রদীপ ও তার স্ত্রীর সম্পদ অনুসন্ধান এবং প্রাথমিক তদন্ত দুদকের সদর দফতর থেকে অনুমোদিত হয়েছে। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, এ দম্পতি নামে বেনামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের প্রমাণ মিলেছে। প্রদীপের স্ত্রী চুমকি কারণের নামে চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৬তলা বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট ও একাধিক গাড়িসহ অন্যান্য সম্পদের প্রমাণ মিলেছে। প্রদীপের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা ॥ টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে কক্সবাজার আদালতে আরও একটি মামলা হয়েছে। এতে আরও ১৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মীর আহমদ সিকদারের পুত্র মোঃ বাবুল আলমকে হত্যার অভিযোগে রবিবার কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ সংক্রান্তে অভিযোগ দায়েরের পর বিচারক তামান্না ফারা আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে এ সংক্রান্তে ইতোমধ্যে কোন মামলা হয়েছে কিনা তা জানানোর জন্য কক্সবাজার সদর থানাকে নির্দেশনা প্রদান করেছে। পুলিশের দায়ের করা মামলা তদন্তেও র‌্যাব ॥ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খানের বোন শরমিন শাহরিয়া ফেরদৌসের দায়েরকৃত সিনহা হত্যা মামলা তদন্তের পাশাপাশি মেজর রাশেদ খানের সহকর্মী শিপ্রা দেবনাথের বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা মাদক মামলাও তদন্তের কার্যক্রম শুরু করেছে র‌্যাব। ঘটনা সরেজমিনে তদন্তে হিমছড়ির ঘটনাস্থল নিলিমা রিসোর্ট পরিদর্শন করেছে র‌্যাবের তদন্ত দল। রবিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে র‌্যাবের তদন্ত দল রিসোর্টটি পরিদর্শনে যায়। সেখানে প্রায় একমাস ধরে অবস্থান করা মেজর (অব) সিনহা ও তার সহকর্মীদের ব্যবহৃত রুম পরিদর্শন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তদন্তকারী কর্মকর্তা বিমান চন্দ্র কর্মকার জানান, এই রিসোর্ট থেকে পুলিশের জব্দ করা আলামত ও ডিভাইসগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ চলছে। শিপ্রার বিরুদ্ধে করা মাদক মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। হোটেলের ম্যানেজার ও কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এর আগে গত ৩১ জুলাই রাতে সিনহা নিহতের পর এই রিসোর্টে অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযানে মদ উদ্ধার দেখিয়ে শিপ্রার নামে মাদক মামলা করে রামু থানায়। ওই মামলাটিও তদন্তের জন্য র‌্যাবকে আদালত থেকে দায়িত্বভার দেয়া হয়েছে।
×