ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিমান থেকে লাশ ফেলার গুজব- আলোচিত সেই খুনের রহস্য উদ্ঘাটন

প্রকাশিত: ২৩:৪৪, ২৩ আগস্ট ২০২০

বিমান থেকে লাশ ফেলার গুজব- আলোচিত সেই খুনের রহস্য উদ্ঘাটন

গাফফার খান চৌধুরী ॥ হত্যার পর বিমান থেকে লাশ ফেলে দেয়ার গুজব ছড়ানো আলোচিত সেই খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই। একটি বাঁশঝাড়ের প্রায় ত্রিশ ফুট ওপর থেকে এক নারীর গলিত লাশ উদ্ধারের পর খুনীরা পরিকল্পিতভাবে এমন গুজব ছড়ায়। গ্রামবাসী তা বিশ্বাসও করেছিল। কিন্তু বিধি বাম। গুজবের সূত্রধরে শেষ পর্যন্ত হত্যাকা-ে জড়িত দুজন গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারের পর তারা পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে থাকে। জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে বলে, তারা হত্যাকা-ের বিষয়ে কিছুই জানে না। খুব সম্ভবত হত্যার পর ওই নারীর লাশ বিমান থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে। নতুবা এত ঘন বাঁশঝাড়ের মধ্যে অত উঁচুতে হত্যার পর লাশ কারো পক্ষেই তোলা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত তারাই হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। হত্যাকা-ে জড়িত আরও পাঁচ আসামি পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এমন তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, ঘটনাটি ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবরের। গাজীপুরের কাপাসিয়া থানাধীন রায়েদ ইউনিয়নের একটি ঘন বাঁশঝাড়ের আনুমানিক ২০/৩০ ফুট ওপর থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় এক তরুণীর গলিত লাশ উদ্ধার হয়। পোস্টমর্টেমে তরুণীকে হত্যা করা হয়েছে বলে চিকিৎসকরা মতামত দেন। এছাড়া তরুণীর সারা গায়ে আঘাতের চিহ্নও আছে। থানা পুলিশসহ অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থা খুনের রহস্য কিনারা করতে না পারায় আদালত পিবিআইকে মামলাটির তদন্তভার দেন। পিবিআই প্রধান বলছিলেন, লাশ উদ্ধারের পর থেকেই গ্রামবাসীদের অনেকের মধ্যেই হত্যার পর ওই নারীর লাশ বিমান থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে বলে বিশ্বাস জন্মায়। কারণ গভীর ঘন বাঁশঝাড়ের এত উপরে হত্যার পর কারো লাশ তোলা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। পিবিআইয়ের তদন্তকারী দলের সদস্যরা প্রথমেই গ্রামবাসীদের কাছে ঘটনার বিষয়ে জানতে চান। গ্রামবাসীরা এমনটাই জানান। তারা দেখেছেন কিনা জানতে চাইলেই বলেন, তারা শুনেছেন। কে বা কারা এমন গুজব ছড়িয়েছে তার সন্ধান চলতে থাকে। দীর্ঘ সময় পর এমন তথ্য প্রচারের সঙ্গে জড়িত মোঃ সোহাগ (২৪) ও মোঃ আলমগীর প্রধানকে (২৫) শনাক্ত করা হয়। পরে তাদের আটক করা হয়। আটকের পর তারা আবারও তাদের বিভ্রান্ত করতে থাকে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলে, তারা হত্যার বিষয়ে কিছুই জানে না। তবে খুব সম্ভবত হত্যার পর ওই নারীর লাশ বিমান থেকে ফেলে দেয়া হতে পারে। কারণ ঘন বাঁশঝাড়ের এত উঁচুতে হত্যার পর লাশ তোলা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এক পর্যায়ে তারাই হত্যাকা-ের ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এমন গুজব ছড়ায় বলে স্বীকার করে। পরে দুজন আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। জবানবন্দীতে সোহাগ জানায়, সে অটোরিক্স চালক। ঘটনার দিন রাত সাড়ে আটটার দিকে আলমগীর তাকে ফোনে জানায়, তাদের বন্ধু নাইম এক তরুণীকে মাইক্রোবাসে করে নিয়ে আসছে। তাদের রাস্তায় পাহারা দিতে হবে। পাহারায় থাকবে আলমগীর, মোমেন ও সোহরাব। তাকেও থাকতে হবে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে মাইক্রোবাসে করে মাইক্রোবাসে করেই এক তরুণীকে নিয়ে আসে। তার সঙ্গে নাইম ছাড়াও কামাল ও বাহাদুর ছাড়াও আর ২/৩ জন ছিল। সে পাশেই পাহারায় ছিল। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর নাইম এসে জানায়, কামাল ও বাহাদুর মিলে ওই তরুণীকে বাঁশের চ্ঙ্গুা দিয়ে ঠেলে উপরে তুলে রশি দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। পরে তারা মাইক্রোবাসে করে চলে যায়। আলমগীরও পিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। সেও দাবি করে, হত্যার পর ওই নারীকে খুব সম্ভবত বিমান থেকে ফেলে দেয়া হতে পারে। কারণ হত্যার পর কোন লাশ এত উপরে তোলা সম্ভব নয়। পরবর্তীতে আলমগীর আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে জানায়, ঘটনার দিন সে কাপাসিয়ার আওলাবর বাজারে ছিল। বন্ধু নাইম তাকে একটি মেয়েকে মাইক্রোবাসে করে নিয়ে আসবে বলে জানায়। সে যেন থাকে। এছাড়াও সেখানে সোহাগ, মোমেন ও বাহাদুর থাকবে বলেও নাইম জানায়। সে বাজারে অপেক্ষা করতে থাকে। খানিক পরেই এক তরুণীকে নিয়ে মাইক্রোবাসে করে বাজারে আসে। দুই হাজার টাকা দিয়ে তাদের রুহুলের বাড়ির পাশে থাকতে বলে। সে সেখানে পাহারা দিতে থাকে। পরে তারা মাইক্রোবাস নিয়ে বাঁশঝাড়ের দিকে যায়। নাইমের সঙ্গে সোহাগ, মোমেন ও সোহরাব যায়। খানিক পরে তারা ফিরে এসে মেয়েটিকে বাঁশের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বলে জানায়। সেখানে সে প্রায় তিন ঘণ্টার মতো ছিল। এরপর সে বাড়ি চলে যায়। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক হাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, আসামিরা প্রথমেই আমাদের বিভ্রান্ত করেছিল। বলেছিল, হত্যার পর লাশ বিমান থেকে ফেলে দেয়া হতে পারে। এত উপরে ঘন বাঁশঝাড়ে লাশ তোলা সম্ভব নয়। গলার রশির বিষয়ে তারা দাবি করেছিল, রশি দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে ওই নারীকে। হত্যার পর ওই নারীকে বাঁশঝাড়ের উপরে তোলার পর রশি কেটে দেয়া হয়েছে। যাতে কেউ লাশ টেনে উপরে তোলার বিষয়টি আর সন্দেহ করতে না পারে।
×