ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

১৭ স্লুইসগেটের নির্মাণ শেষ না হওয়াই মূল কারণ, মা ও শিশু হাসপাতালের অবস্থা করুণ

জোয়ারে প্রতিদিনই ডুবছে খাতুনগঞ্জ ও আগ্রাবাদ এলাকা

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ২৩ আগস্ট ২০২০

জোয়ারে প্রতিদিনই ডুবছে খাতুনগঞ্জ ও আগ্রাবাদ এলাকা

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রাম। এটিই দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। ফলে ৯২ ভাগ আমদানি-রফতানির ধকলও সইতে হয় মহানগরীকে। তাছাড়া বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও অন্যান্য নগরীর চেয়ে আলাদা। কারণ বর্ষা মৌসুমে শুধু বৃষ্টিই নয়, প্রতিদিনই আছড়ে পড়ে দুবার জোয়ারের ধাক্কা। যেজন্য বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পাশাপাশি আরেকটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সামুদ্রিক জোয়ারের পানি ঠেকানো। জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে এ পর্যন্ত প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হলেও বন্দরনগরীর মানুষের দুঃখ আর গেল না। চলমান রয়েছে ৫ হাজার ছয়শ কোটি টাকার প্রকল্প। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের ৫০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু সুফল দৃশ্যমান না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা হতাশ, চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ নাগরিকরা। এই দুর্ভোগ আর কতকাল চলবে প্রশ্ন তাদের? শনিবার আবারও ডুবেছে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল। একইচিত্র ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের। এভাবে চট্টগ্রামে জোয়ারের পানিতে প্রতিদিনই কমবেশি ডুবছে খাতুনগঞ্জ ও আগ্রাবাদসহ নগরীর নিচু এলাকাগুলো। এরসঙ্গে বৃষ্টি যুক্ত হলে সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনে নানা প্রকল্প এবং নাগরিক সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও জনপ্রতিনিধিদের আশ^াসেই কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর। কিন্তু নগরীর যেন পানিতে তলিয়ে যাবার হাত থেকে রেহাই নেই। লঘুচাপ সৃষ্টি হলে সাগরের পানি ফুলে ফেঁপে ওঠে, যা ডুবিয়ে দেয় বাণিজ্যিক এলাকা ও লোকালয়। বেশকিছু সড়ক উঁচু করায় যানবাহন চলাচল করতে পারলেও আবাসিক এলাকাগুলো নিয়মিতই প্লাবিত হচ্ছে। আগ্রাবাদসহ কয়েকটি অভিজাত আবাসিক এলাকা এরই মধ্যে একপ্রকার পরিত্যক্তই হয়ে গেছে। সড়ক ও ভবনের নিচতলা হাঁটু পানিতে সবসময় জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকে। যেজন্য ভাড়াটিয়া পাওয়া যায় না। ফ্ল্যাট খালি পড়ে থাকে। আর বাড়ির মালিকরাও এক প্রকার বাধ্য হয়েই অন্যত্র বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন। আগ্রাবাদ এলাকাতেই রয়েছে মা ও শিশু হাসপাতাল, যা চট্টগ্রামের অন্যতম বৃহৎ চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান। কয়েক বছর ধরেই দারুণ দুর্ভোগে পড়েছে হাসপাতালটি। রোগীর যাতায়াত বিঘিœত হবার পাশাপাশি নিচতলায় চিকিৎসা সেবা কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। নিরুপায় হয়ে হাসপাতালটির ক্যান্সার ইউনিট সরিয়ে নিতে হয়েছে ওপরতলায়। নিচতলায় এখন আর কোন কার্যক্রমই চালানো সম্ভব নয়। সে এলাকায় অবস্থিত সরকারী-বেসরকারি অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও রয়েছে চরম দুর্দশায়। জলাবদ্ধতায় নাকাল খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের মতো প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র। বৃষ্টি ও জোয়ারের সময় বিক্রি বন্ধ রেখে ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন পচনশীল ভোগ্যপণ্য রক্ষার কাজে। ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের এ কষ্টই যেন এখন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাতুনগঞ্জ ট্রেড এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগীর আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারের আন্তরিকতার কোন অভাব নেই। জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকার অর্থ বরাদ্দে কোন কার্পণ্য করেনি। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে প্রচুর অর্থ দেয়া হয়েছে। কিছু প্রকল্প বাস্তবায়িতও হয়েছে। কিন্তু আমরা তার সুফল পাচ্ছি না। তাই মূল সঙ্কটটা চিহ্নিত করা গেছে কিনা তা নিয়েও আমরা সন্দিহান। তবে পাঁচ হাজার ছয় শ’ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে, এমন আশায় রয়েছি আমরা। আশাবাদী না থেকে তো আর উপায় নেই। জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ৫৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প ॥ চট্টগ্রাম মহানগরীকে জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষায় গৃহীত হয়েছে পাঁচ হাজার ছয় শ’ কোটি টাকার এক মেগা প্রকল্প, যা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) প্রকল্পের আওতায় রয়েছে, কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে সংযোগ থাকা ১৬ খাল এবং এসব খালের সঙ্গে সংযুক্ত আরও ২০ খালসহ মোট ৩৬ খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন। প্রশস্ততা রক্ষায় খালের পাড় ঘেঁষে নির্মাণ করা হবে ৮৫.৬৮ কিলোমিটার সড়ক। সেসব সড়ক নিয়মিত খাল পরিষ্কারে ভূমিকা রাখা ছাড়াও যোগাযোগ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। প্রকল্পের আওতায় ৪৮ পিসি গার্ডার ব্রিজ ও ৬ কালভার্টও নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পটির আংশিক বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তা চলমান থাকলেও নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে তা শেষ করা যায়নি, সময় বাড়ানো হয়েছে আরও দুবছর। তার সুফল দেখতে ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি কতটুকু ॥ চট্টগ্রামের মানুষ চেয়ে আছে সেই মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে। প্রকল্পের কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী জনকণ্ঠকে জানান, ইতোমধ্যে ৫০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। টার্গেট ছিল জুন মাসের মধ্যে ৬০ ভাগ শেষ করার। কিন্তু করোনা দুর্যোগের কারণে কাজে স্থবিরতা নেমে আসায় লক্ষ্য পুরোপুরি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। সেজন্য প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আশা করা যায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অবশ্যই প্রকল্পের অবশিষ্ট কাজ শেষ করা সম্ভব হবে। কিছুক্ষেত্রে অগ্রগতি বেশ ভাল বলে জানান ওই প্রকল্প কর্মকর্তা। ৭০ লাখ জনঅধ্যুষিত চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণে চলমান প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন কাজগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে এ প্রসঙ্গ তুলে ধরেন প্রকল্প পরিচালক কর্নেল শাহ আলী। তিনি জানান, এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার কাজগুলো হল খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপন, রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, পাড় উঁচু করা, পাহাড় থেকে নেমে আসা পলি ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে সিলটেশন ট্যাপ তৈরিসহ গুরুত্বপূর্ণ আরও কয়েকটি কাজ। প্রকল্পের সব কাজই কমবেশি একসঙ্গে এগিয়ে চলছে। মোট ১৭ স্লুইসগেট বা রেগুলেটরের মধ্যে সেনাবাহিনী করছে ৫টির কাজ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় মহেশখাল। এগুলোর অগ্রগতি বেশ ভাল, যা আগামী বর্ষার আগেই খুলে দেয়া হবে। বাকি ১২ রেগুলেটর বসানোর কাজ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে নতুন খাল খননের কথা এলেও তা এখনই জরুরী নয়। এখন প্রয়োজন বিদ্যমান খালগুলো উদ্ধার এবং সংস্কার করে পানির প্রবাহ নির্বিঘœ করা। স্লুইসগেট বা রেগুলেটর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাহাড়, নদী ও সাগরবেষ্টিত চট্টগ্রাম আলাদা বৈশিষ্ট্যের নগরী। এখানে শুধু বৃষ্টির পানি নয়, জোয়ারের আঘাতও লাগে। যে কারণে খালের মুখে বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা সফল হবে না। কেননা জোয়ার ঠেকানো গেলেও বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাটাও ঠিক রাখতে হবে। নগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও নগর উন্নয়নে নগর পরিকল্পনাবিদদেরও সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।
×