ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আসছে বিধিনিষেধের আওতায়

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ২৩ আগস্ট ২০২০

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আসছে বিধিনিষেধের আওতায়

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বিদেশী কারিকুলামে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল পরিচালনায় কঠোর হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা ও আইনের অভাবকে কাজে লাগিয়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কর্তৃপক্ষ এতদিন ইচ্ছেমতো চললেও এবার সেই সুযোগ বন্ধ হচ্ছে। নিবন্ধন, আয় ব্যয়ের হিসাব দেয়া থেকে শুরু করে সকল কাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের, শিক্ষা অধিদফতর ও শিক্ষা বোর্ড। ইতোমধ্যেই আয় ব্যয়ের হিসাব অভিভাবকদের দেয়ার আদেশসহ প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি বৈধ কাঠামোর মধ্যে আনার লক্ষ্যে একগুচ্ছ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। কেবল তাই নয়, এতদিন ব্যক্তিগত বা পারিবারিকভাবে চললেও এখন থেকে নিয়মিত ম্যানেজিং কমিটি গঠন করতে হবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের স্কুল পরিদর্শক মোঃ আবুল মনসুর ভূঞা বলেছেন, স্কুলের নিয়মের স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা আনতে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। সাধারণ স্কুলগুলোর মতো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলেরও ম্যানেজিং কমিটি থাকতে হবে। কমিটি প্রতিষ্ঠান প্রধানকে নিয়ে ব্যয় বিবরণী তৈরি করবে। প্রতি অর্থবছরের শেষে হিসাব নিরীক্ষা সম্পাদন করে সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠাতে হবে। কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরিচালিত হবে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এতদিন চললেও এখন থেকে যাতে একটি নিয়মের মধ্যে চলে আসে সে লক্ষ্যেই কাজ করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যেখানে ইচ্ছেমতো বেতন ফি আদায় থেকে শুরু করে আয় ব্যয়ের সকল কার্যক্রম একটি শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি বৈধ কাঠামোর মধ্যে আনার লক্ষ্যে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোন খাতে কত টাকা ফি আদায় করা হচ্ছে তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণী অভিভাবকদের লিখিতভাবে জানানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যেই মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক, নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান ও মাউশির অধিন উপপরিচালকদের চিঠি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের এ আদেশ ইতোমধ্যেই হাতে পেয়েছেন কর্মকর্তারা। বিদেশী কারিকুলামে পরিচালিত বেসরকারী বিদ্যালয়ের নিবন্ধন নিশ্চিতকরণ সংক্রান্ত’ শিরোনামের ওই চিঠিতে বিদেশী কারিকুলামে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ইংরেজী মাধ্যমের পাঠ্যসূচী পরিচালিত ‘বেসরকারি বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালা, ২০১৭’ এর ১৯ (৩) ধারাটি মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেছেন, ‘ইংরেজী মাধ্যমের অনেক বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রেশন নেই, সেগুলোকে শৃঙ্খলায় আনতেই এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত হতে হবে। আইন অনুসারে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন করার সময় তাদের বিভিন্ন ধরনের ফি কত সেটা অভিভাবকদের জানাতে হয়। কিন্তু এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ধরনের ফি নিয়ে মাঝে মাঝে অভিযোগ পাওয়া যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘বেসরকারী বিদ্যালয়ে সহপাঠ কার্যক্রম পরিচালনা, কোন বিশেষ সুবিধা এবং উন্নতমানের যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তি সুবিধা ব্যবহারের জন্য ছাত্রছাত্রীদের নিকট হতে ফি আদায় করা যাবে, তবে অনুরূপ ক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত তার পূর্ণাঙ্গ ব্যয় বিবরণী অভিভাবকদের লিখিতভাবে অবহিত করতে হবে।’ মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘সাময়িক নিবন্ধন আবেদন ফরমে প্রতি মাসে বা বছরে শ্রেণীভেদে আদায় করা টিউশন ফি, ভর্তি ফি, খেলাধুলা ফি, গ্রন্থাগার ফি, টিফিন ফি, মুদ্রণ ফি এবং অন্যান্য ফি এর পরিমাণ ও বিবরণী উল্লেখ করার নিয়ম আছে। এ অবস্থায় বিদেশী কারিকুলামে পরিচালিত বেসরকারী বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালার বিধি ১৯ (৩) বাস্তবায়নের জন্য কর্মকর্তাদের অনুরোধ করা হয়েছে।’ এ ধরনের নিবন্ধিত এবং নিবন্ধনহীন কতটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে তার একটি তালিকাও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলা হয়েছে চিঠিতে। এদিকে প্রতিষ্ঠাগুলোকে পরিচালনার জন্য একগুচ্ছ নির্দেশনা জারি করা করেছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করা, হিসাব বিবরণী তৈরি, ব্যয় বিবরণী অভিভাবকদের দেয়া, নিয়মিত কমিটি গঠন ও ইআইআইএন নম্বর সংগ্রহ করতে বলা স্কুলগুলোকে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর অধ্যক্ষ এবং প্রধান শিক্ষকদের এসব নির্দেশনা দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। শিক্ষা বোর্ড থেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে দেয়া নির্দেশনায় বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নীতিমালা ২০১৭ অনুসারে করে সকল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু কিছু স্কুল এখনও নিবন্ধন করছে না। তাদের নীতিমালা অনুসারে নিবন্ধন ফি জমা দিয়ে আবেদন করতে বলা হয়েছে চিঠিতে। ইতোমধ্যে নিবন্ধনকৃত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর ইআইআইএন নাম্বার ঢাকা বোর্ডের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে জানিয়ে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইআইআইএন নাম্বার সংগ্রহ করে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে বোর্ড থেকে লগইন পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। শিক্ষা বোর্ডের স্কুল ও কলেজ পরিদর্শন শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলো বোর্ডের অনুমতি ছাড়া গঠন করা কমিটি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। তাই নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে ম্যানেজিং কমিটি গঠনের আবেদন করতে বলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর টিউশন ফি খেলাধুলা ফিসহ অন্যান্য ফিয়ের বিবরণী নিবন্ধন কর্তৃপক্ষকে জানানো বিধান থাকলেও তা করা হচ্ছে না। এবিশেষ যন্ত্রপাতি বা সহপাঠ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নেয়া ব্যয়ের হিসাব অভিভাবকদের দেয়ার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এছাড়া ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে নিয়মিত ম্যানেজিং কমিটি গঠন নিশ্চিত করতে চায় শিক্ষা বোর্ড। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের স্কুল পরিদর্শক মোঃ আবুল মনসুর ভূঞা বলছিলেন, শীঘ্রই এ বিষয়ে নির্দেশনা জারি করা হবে। স্কুলের নিয়মের স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা আনতে আমরা এ উদ্যোগ নিয়েছি। সাধারণ স্কুলগুলোর মতো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলেরও ম্যানেজিং কমিটি থাকতে হবে। ম্যানেজিং কমিটিকে ব্যয় বিবরণী তৈরি করে প্রতি অর্থ বছরের শেষে হিসাব নিরীক্ষা সম্পাদন করে রিপোর্ট নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে হবে। কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরিচালিত হবে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। এর মাধ্যমে কাজের গতিশীলতার পাশাপাশি স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে বলে মনে করছেন শিক্ষা বোর্ড কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্যারেন্টস ফোরামের আহ্বায়ক এ কে এম আশরাফুল হক বলেছেন, ইংরেজী মাধ্যমের কোন প্রতিষ্ঠানই তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব অভিভাবকদের জানায় না। এটা আমাদের দাবির মধ্যেই আছে, আমরাও চাই কোন খাতে কত ফি নেয়া হচ্ছে এবং কীভাবে তা খরচ করা হচ্ছে তা আমাদের জানানো হোক। ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষকে নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জি এম নিজাম উদ্দিন বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠানই আয়-ব্যয়ের হিসাব দেয় না। তবে কেউ কেউ বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব বিষয় তুলে ধরে। যদি স্কুলগুলো মনে করে এটা প্রকাশ করা অসুবিধার, তাহলে সরকারের সঙ্গে বসতে হবে। আর যদি সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় না আসা যায়, তাহলে সরকারের যে সিদ্ধান্ত তা তো পালন করতেই হবে। অনেক প্রতিষ্ঠানই অভ্যন্তরীণ বিষয় সবাইকে জানাতে চায় না।
×