ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশাখে গড়া শখের হাঁড়ি বিক্রি হয়নি আজও

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ২৩ আগস্ট ২০২০

বৈশাখে গড়া শখের হাঁড়ি বিক্রি হয়নি আজও

মোরসালিন মিজান ॥ সেই বৈশাখে গড়া হয়েছিল শখের হাঁড়ি। বাঙালীর বর্ষবরণ উৎসবকে রাঙাতে অনেক আগে থেকেই কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন শিল্পীরা। ওই সময়টাতে বাঙালিত্বের অদ্ভুত এক জাগরণ চোখে পড়ে। একই কারণে চাহিদা বাড়ে লোকসংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গের। শখের হাঁড়ি সেইসব ঐতিহ্যবাহী অনুষঙ্গের একটি। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই এর চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। তাই আগেভাগে কাজে নেমে পড়েন শিল্পীরা। এই ধারার কাজের বিখ্যাত শিল্পী সুশান্ত কুমার পালও তা-ই করেছিলেন। যোগ্য উত্তরসূরি দুই পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে দিন রাত কাজ করেছিলেন তিনি। দেখদে দেখতে ঘর ভর্তি হয়ে গিয়েছিল শখের হাঁড়িতে। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবের প্রথম পর্যায়ে বাতিল হয়ে যায় বৈশাখের সব আনুষ্ঠানিকতা। প্রস্তুত করা মালামালের কিছুই আর বিক্রি হয়নি। এখনও সব অবিক্রীত। এ অবস্থায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে শিল্পী পরিবারটি। শখের হাঁড়ি বাংলার বিলুপ্ত প্রায় মৃৎশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। সাধারণত প্রাকৃতিক এবং খুব উজ্জ্বল রঙে এ হাঁড়িগুলো আঁকা হয়ে থাকে। লাল হলুদ সাদাসহ বিভিন্ন রঙের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। হাঁড়ির গায়ে ফুল লতাপাতা পাখি জল মাছ ইত্যাদি লোকজ মোটিফ নিজস্ব রীতিতে উপস্থাপন করেন শিল্পীরা। অনন্য সাধারণ কারুকৃতি দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। মাটির পাত্রে গ্রামীণ জীবনাচার, উৎসব, সংস্কার, ধর্মসহ নানা কিছুর বহির্প্রকাশ ঘটানো হয়। লোকচিত্রের বর্ণাঢ্য নমুনা বহন করে শখের হাঁড়ি। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ লোকশিল্পের সার্থক প্রকাশ ঘটে এই ধারার কাজে। এক সময় মূলত বিয়ের আলাপ ও আনুষ্ঠানিকতায় শখের হাঁড়ি ব্যবহারের রীতি প্রচলিত ছিল। চিত্রিত হাঁড়িতে করে কুটুম বাড়িতে মিষ্টি পাঠানো হতো। নানা জাতের পিঠা তিলা কদমা নাড়– মোয়া ইত্যাদিও শখের হাঁড়িতেই বেশি মানাতো। চাঁপাইনবাবাগঞ্জে মেয়ে বিদায়ের সময় তার সঙ্গে সখের হাঁড়ি দেয়ার রেওয়াজ ছিল। প্রথম সন্তান প্রসবের পর স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার সময় মেয়েরা বাপের বাড়ি থেকে এই হাঁড়ি সঙ্গে করে নিয়ে যেত। বর্তমানে অনেক কিছুই বদলে গেছে। মৃৎপাত্রের ব্যবহার বলা চলে শূন্যের কোটায়। উৎসব অনুষ্ঠানের চরিত্রেও পরিবর্তন এসেছে। একই ধাক্কায় দুর্দিনে পড়েছে শখের হাঁড়ি। এ অবস্থায়ও চর্চাটিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন সুশান্ত পাল। একেবারে শৈশব থেকেই এ কাজের সঙ্গে যুক্ত তিনি। এখন বয়স হয়েছে। শরীরও ভাল যায় না। তবে এরই মাঝে দুই ছেলেকে প্রস্তুত করেছেন। ছেলেরাও পুরোদমে শখের হাঁড়ি তৈরির কাজ করেন এখন। দেশের বিভিন্ন মেলায় অংশ নেন তারা। ঢাকার লোকজ মেলাগুলোতে নিয়মিত দেখা যায় তাদের। এভাবে কোনরকমে চলে যায়। তবে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ভাল নেই তারা। শনিবার ফোনে সুশান্ত পাল জনকণ্ঠকে বলেন, সারা বছরই টুকটাক কাজ করি আমরা। বৈশাখে বিক্রি ভাল হয়। তাই অনেক আগে থেকে শখের হাঁড়ি বানানো শুরু করে দিয়েছিলাম। চৈত্রের ৫ দিন আগে মোটামুটি শেষ হয়ে যায় কাজ। ঘর ভর্তি হয়ে যায় শখের হাঁড়িতে। মাটির সরা খেলনা ইত্যাদিও তৈরি করেছিলাম। কিন্তু পহেলা বৈশাখের আগে আগে করোনা এসে আমাদের বিপদে ফেলে দেয়। আক্রান্ত হইনি। তবে খেয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে গেছে। তিনি জানান, তৈরি করা শখের হাঁড়ি আর বিক্রি করা যায়নি। প্রায় ১০ হাজার পিস মাল। সবই অবিক্রিত। যা কিছু টাকা ছিল, এখানে আটকে আছে। কিন্তু কতদিন? এভাবে চললে পরীবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে বলে জানান তিনি। কথা হয় সুশান্ত কুমার পালের ছেলে শিল্পী মৃত্যুঞ্জয় কুমার পালের সঙ্গেও। তিনি বলছিলেন, বৈশাখ ঘিরে অনেক স্বপ্ন ছিল আমাদের। শুধু বাবা আমি আর আমার ভাই কাজ করিনি, আমার স্ত্রী এবং বৌদীও হাঁড়ি তৈরির কাজ করেছিলেন তখন। করোনায় শেষ হয়ে গেল। যারা আগাম অর্ডার দিয়েছিলেন তারাও অপারগ হয়ে বাতিল করে দেন। নিজেরা যা করেছিলাম, তা দিয়ে এখন ঘর ভর্তি। অথচ হাতে কোন টাকা নেই। করোনা পরিস্থিতি কবে ঠিক হবে তাও জানি না। তাহলে সামনের দিনগুলো কী করে চলবে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, সত্যি কথা বলতে আমরা নিজেরাও জানি না!
×