ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চাঞ্চল্যকর সিনহা হত্যা ৩ এপিবিএন সদস্য র‌্যাব হেফাজতে

সিনহা হত্যা পরিকল্পিত, না হিট অব দ্য মোমেন্ট?

প্রকাশিত: ২২:৪১, ২৩ আগস্ট ২০২০

সিনহা হত্যা পরিকল্পিত, না হিট অব দ্য মোমেন্ট?

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যার ২২ দিন অতিক্রম হয়েছে শনিবার। একটি চেকপোস্টে আটকিয়ে পুলিশের একজন এসআই সিনহাকে কেন হত্যা করলেন- বিষয়টি কি পরিকল্পিত না হিট অব দ্য মোমেন্ট। এ নিয়ে ঘুরপাকেই রয়েছে তদন্ত। এখনও ক্রিস্টাল ক্লিয়ার হয়নি হত্যার মোটিভ। আর নেপথ্যের চিত্র উদঘাটনেই তদন্ত সংস্থা র‌্যাব সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি খাইরুল ইসলামকে তদন্তের স্বার্থে নানাভাবে সহযোগিতা দিচ্ছেন র‌্যাবের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা। এর মধ্যে ঢাকা থেকে কক্সবাজার আসা কর্মকর্তাও রয়েছেন। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র শনিবার জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, হত্যাকা- নিয়ে তারা একটি পরিষ্কার ধারণা ইতোমধ্যে পেয়েছেন। ওসি প্রদীপ, কিলার লিয়াকতসহ এ পর্যন্ত সাতজনকে জিজ্ঞাসাবাদে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে একটি পরিষ্কার ধারণা মিলেছে। এতে যে চিত্র উদ্ঘাটিত হয়েছে তা নিয়ে শুক্রবার ঘটনাস্থলে প্রধান তিন আসামি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তাসহ র‌্যাব কর্মকর্তারা একটি মহড়ার আয়োজন করেন। এটি ঘটনাস্থলের মানচিত্র, খসড়া বা স্ক্যাচম্যাপ চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়াও বলা যায়। আইনী ভাষায় যাকে ক্রাইম সিন রিহার্সেল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এছাড়া তদন্ত কর্মকর্তা এ হত্যাকা-ের অধিকাংশ আলামত যেমন নিজ হেফাজতে এনেছেন, অনুরূপভাবে প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের জবানিও গ্রহণ করেছেন। এদিকে এ ঘটনার নেপথ্যে নতুন একটি তথ্য মিলেছে-যা হচ্ছে টেকনাফ থানার এসআই যিনি বর্তমানে এ মামলায় গ্রেফতার হয়ে র‌্যাবের রিমান্ডে রয়েছে তার আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েই নাকি এসআই লিয়াকত গুলি করেছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে। ফলে ৩১ জুলাই রাত সোয়া ৯টার দিকে ঘটনাস্থলে এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত কেন এসেছিলেন, কেনইবা তিনি তার আগ্নেয়াস্ত্র এসআই লিয়াকতকে ব্যবহারের জন্য দিলেন এসব নিয়ে নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এছাড়া আগেই তথ্য মিলেছে যে, সিনহাকে হত্যার দশ মিনিটের মধ্যেই টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ঘটনাস্থলেই পৌঁছান। লিয়াকতের গুলিতে তখন সিনহা মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত অতিক্রম করছিলেন। এ অবস্থায় ওসি প্রদীপ নাকি সিনহার শরীরে লাথিও মারেন। এ ঘটনা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা রয়েছে প্রদীপ কি ঘটনাস্থলের অনতিদূরে ছিলেন। আর এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত ঘটনাস্থলে ছিলেন নাকি আগেই তিনি তার আগ্নেয়াস্ত্র এসআই লিয়াকতকে দিয়ে রাখেন। তাহলে বিষয়টি কি দাঁড়ায়। এসব প্রশ্নের উত্তর যেমন চায় আগ্রহী মহল, তেমনি তদন্ত সংস্থাও উদ্ঘাটনে তৎপর। আর গুলির ঘটনাটি যদি হিট অব দ্য মোমেন্ট হয়ে থাকে তাহলে এমনকি দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে যে এসআই লিয়াকত সিনহাকে লক্ষ্য করে প্রথমে একটি এবং পরে আরও তিনটি গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করলেন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের প্রশ্ন, লিয়াকত কি বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে আত্মরক্ষার্থে গুলি করেছেন। এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আত্মরক্ষার্থে গুলি করার কোন তথ্য মেলেনি। কারণ এ পর্যন্ত প্রত্যক্ষদর্শী এবং সব ক’জন সাক্ষ্য প্রদানকারী বলেছেন, সিনহার পিস্তলটি ছিল তার প্রাইভেটকারের পেছনে। আর তিনি লিয়াকতের নির্দেশে দুহাত তুলে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসা মাত্রই গুলির শিকার হন। এক্ষেত্রে লিয়াকতের আত্মরক্ষা বা রাইট অব প্রাইভেট ডিফেন্ট-এর কথাটি ধোপে টিকে না। সূত্র জানিয়েছে, পুলিশের পক্ষে তিন কারণে গুলি করার আইনী অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমত, বিক্ষুব্ধ বা উত্তাল জনতাকে হঠাতে গুলি করা যায়। দ্বিতীয়, আত্মরক্ষার জন্য গুলি করা যায়। তৃতীয়ত, সরকারী সহায় সম্পদ রক্ষার্থে এবং আশপাশের কাউকে রক্ষার্থে গুলি করা যায়। সিনহা হত্যার ঘটনায় এ ধরনের কিছু হয়েছে বলে এ পর্যন্ত কোন তথ্য উপাত্ত মিলেনি। তা হলে কি ধরে নেয়া যায়-এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকা-। আর পরিকল্পিত হত্যাকা- হলে তা মেরিন ড্রাইভ বা কক্সবাজারের প্রধান সড়কে কেন ঘটবে সেটাও বড় একটি প্রশ্নবোধক হয়ে আছে। এদিকে তদন্ত সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, সিনহাকে হত্যার পেছনে কি রয়েছে তার একটি স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া গেছে। সর্বোচ্চ দুই মিনিটের মধ্যে এ ধরনের একটি হত্যাকা- ঘটেছে বলে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার গত শুক্রবার সাংবাদিকদের জানান দিয়েছেন। এমন বক্তব্যের পর প্রশ্ন উঠেছে, এমনকি ঘটনা সিনহা ও লিয়াকতের মধ্যে সৃষ্টি হল যে, নিমিষেই লিয়াকত একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে গুলি করলেন। আবার মৃত্যু নিশ্চিত করতে উপর্যুপরি আরও তিনটি গুলি করলেন। এরই মধ্যে নতুন আরও একটি তথ্য মিলেছে, সেটি হচ্ছে টেকনাফ থানা পুলিশের অনেকেই সন্ধ্যার পর মদ্যপ হয়ে বেসামাল অবস্থায় থাকেন। এসআই লিয়াকত তাদের মধ্যে অন্যতম। ওসি প্রদীপও এর বাইরে নন। কিন্তু ওই দিনের ঘটনার পর ওসি প্রদীপ এবং এসআই লিয়াকত পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের সঙ্গে টেলিফোনে যে কথোপকথন তাতে তাদের কোন অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যায়নি। এসব বিষয় নিয়ে সিনহা হত্যার তদন্ত এখনও ঘুরপাকেই রয়েছে। ইতোমধ্যে তারা ওসি প্রদীপসহ সাত পুলিশের বক্তব্য পেয়েছেন। তিন সাক্ষী গ্রেফতার হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। গ্রেফতারকৃত এপিবিএনের ৩ সদস্যকে শনিবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র‌্যাব হেফাজতে নেয়া হয়েছে। এ তিনজনকে আগেই ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। তিন সাক্ষী ও তিন এপিবিএন সদস্য গ্রেফতার নিয়ে ধোঁয়াশা ॥ সিনহা হত্যা মামলায় যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে তিনজন হলেন ঘটনার পর পুলিশের দায়ের করা মামলার সাক্ষী। অপর তিনজন হলেন ঘটনাস্থল অর্থাৎ চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকারী এপিবিএনের তিন সদস্য। বিশেষজ্ঞ সূত্রে বলা হচ্ছে, এ ছয়জনকে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ তদন্তের জন্য প্লাস না মাইনাস? কেননা, গ্রেফতার করায় এরা অজানা আশঙ্কায় এখন প্রকৃত তথ্য জানাবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে। যেহেতু হত্যাকা-ের পর পুলিশের পক্ষে একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে এবং সে মামলায় তিনজনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এরপর নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস যে মামলা করেছেন সেটি মূল মামলায় পরিণত হয়েছে। পুলিশের দায়ের করা মামলাটি কথিত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ফলে পুলিশী মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্য মূল মামলার জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া চেকপোস্টে দায়িত্বরত এপিবিএনের তিন সদস্য এ হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত বলে তথ্য দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কেউ গুলিবর্ষণের ঘটনায় জড়িত নন। এক্ষেত্রে তাদের কেন গ্রেফতার করা হল সেটিও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এরা হতে পারত ঘটনার সাক্ষীদের অন্যতম। এখন হয়েছে আসামি। তফাৎ হয়ে গেছে আকাশ পাতালসম। এরপরও বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন সূত্রের ধারণা, তদন্ত সংস্থা র‌্যাব যেভাবে আটঘাটভাবে নেমেছেন সেক্ষেত্রে রহস্য উদঘাটনে সফলতা আসার সম্ভাবনাই বেশি। অপরদিকে যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এসআই লিয়াকত আলী মেজর সিনহাকে গুলি করেছেন সে আগ্নেয়াস্ত্র শনিবার পুলিশ সুপারের অফিস থেকে তদন্ত সংস্থা র‌্যাব তাদের হেফাজতে নিয়েছে। এর আগে র‌্যাব গ্রহণ করেছে সিনহার ব্যবহৃত গাড়ি। সিনহার সহযোগী সিফাত ও শিপ্রার যেসব ডিভাইস রামু থানা জব্ধ করেছিল সেগুলোও র‌্যাব হেফাজতে নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রিমান্ডে নেয়া তিন এপিবিএন সদস্যকে প্রধান তিন আসামির মুখোমুখি করা হবে এবং তাদের বক্তব্যের মিল-অমিল নিয়ে বিশ্লেষণ করা হবে। এদিকে সিনহার সহকর্মী শিপ্রা রানী দেবনাথের বিভিন্ন ডিভাইস কেন জব্দ করা হয়েছে সে নিয়ে রামু থানার ওসি আবুল খায়েরকে আদালতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার আদেশ দিয়েছেন কক্সবাজারের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মোঃ হেলাল উদ্দিন। সাত কার্যদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা দেয়ার সময় দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, সিনহা হত্যাকা-ের পর রিসোর্ট নীলিমায় অভিযান চালিয়ে শ্রিপার কক্ষ থেকে ২৯ পদের ইলেকট্রনিকস ডিভাইস জব্দ করে রামু থানা পুলিশ। আদালতের নির্দেশে এসব ডিভাইস ইতোমধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। এপিবিএনের এ তিন সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় নেয়ার আগে র‌্যাব তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে নেয়। যা আগের আসামিদের ক্ষেত্রেও হয়েছে। র‌্যাব সূত্র বলেছে, হাইকোর্টের একটি নির্দেশনা থাকার কারণে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর বিষয়টি রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের আগে বাধ্যতামূলক। শনিবার সকাল ১০টায় র‌্যাবের একটি দল জেলা কারাগারে গিয়ে এ তিনজনকে জেলা হাসপাতালে নিয়ে যায়। স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর র‌্যাবের হেফাজতে নেয়া হয়। এ তিন সদস্য হলেন সাব ইন্সপেক্টর শাহজাহান, কনস্টেবল মোঃ রাজিব ও কনস্টেবল মোঃ আবদুল্লাহ। এরা এপিবিএনের হয়ে ওইদিন শাপলাপুর চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনরত ছিলেন এবং তাদের সামনেই হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটেছে। জানা গেছে, এদের জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়ায় ওসি প্রদীপ, এসআই লিয়াকত ও এসআই নন্দদুলাল রক্ষিতের মুখোমুখি করা হবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, টেকনাফের মারিসবুনিয়া পাহাড়ে ভিডিও চিত্র ধারণ করে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে হিমছড়ি এলাকার নীলিমা রিসোর্টে ফেরার পথে শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে এসআই লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনা নিয়ে পুলিশ পক্ষ থেকে তিনটি মামলা হয়েছে। এর দুটি টেকনাফ থানায় আরেকটি রামু থানায়। শেষ মামলাটি হয়েছে ৪ আগস্ট নিহত সিনহার বড় বোন বাদী হয়ে টেকনাফ থানায়। এ মামলায় ওসি প্রদীপসহ ৯ পুলিশকে আসামি করা হয়েছে। মামলার পর ৯ জনকে তাদের কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার এবং সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। পরে এই নয়জনের মধ্যে সাতজন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। অপর দুজনের কোন খোঁজ এখনও মিলেনি। এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফা নামের এই দুই আসামি পুলিশ সদস্য নন বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে জানান দেয়া হয়েছে। ঘটনার পর সিনহার সহযোগী সিফাত ও শিপ্রাকে গ্রেফতার করা হলেও পরে দু’জনই জামিনে মুক্ত হন। এ মামলায় এ পর্যন্ত আসামি হয়েছে ১৫, আর গ্রেফতার হয়েছে ১৩ জন। এদের মধ্যে ৪ পুলিশসহ ৭ সদস্যকে রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
×