ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ॥ জাতির বিক্ষত বিবেক

প্রকাশিত: ২১:১২, ২৩ আগস্ট ২০২০

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ॥ জাতির বিক্ষত বিবেক

সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যা সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর ৪টা থেকে ৫টার দিকে। এই হত্যাকা-ের ওপর এজাহার ঢাকা নগরীর ধানম-ি থানায় ২ অক্টোবর ’৯৬ সালে দায়ের করেন বঙ্গবন্ধুর বাসস্থানে ’৭৫ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট তারিখে কর্মরত তার ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম। এর আগে ’৯৬-এর ২৩ জুন দেশে ঐ সালের ১২ জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ভিত্তিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। নিজ জীবনের নিরাপত্তার বিষয়ে শঙ্কা ও নানাবিধ ‘প্রতিকূল অবস্থার’ কারণে এই এজাহার দিতে বিলম্ব হয় বলে মুহিতুল ইসলাম এজাহারের শেষাংশে উল্লেখ করেন। প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে প্রধান ছিল ’৭৫ সালের দায়মুক্তি অধ্যাদেশ। বঙ্গবন্ধুর হত্যার ৪১ দিন পর ’৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বেআইনীভাবে দেশের প্রেসিডেন্টের পদ দখলকার খন্দকার মোশতাক আহমদ কর্তৃক জারিকৃত এই অধ্যাদেশে একই সালের ১৫ আগস্টে ‘সরকার পরিবর্তন’ করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ও কৃত ‘সকল কর্ম ও পদক্ষেপকে’ যে কোন অপরাধ থেকে দায়মুক্ত রাখা হয়েছিল। ’৯৬ সালের দায়মুক্তি (প্রত্যাহার) আইন (আইন নং ২১) দিয়ে সংসদ ’৭৫ সালের সেই কালো দায়মুক্তি অধ্যাদেশ রহিত করে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের দায় নির্ধারন, বিচারকরন ও শাস্তি প্রদানের দৃশ্যত আইনী প্রতিবন্ধকতা দূর করে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর যে বৈরী জান্তা ও গোষ্ঠী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল, তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার হত্যার বিষয়ে কোন এজাহার সংশ্লিষ্ট থানায় আইনানুগভাবে গ্রন্থিত হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছিল। বঙ্গবন্ধুর ৪ প্রধান সহযোগীকে জেলে অন্তরীণাবস্থায় খুন করিয়ে, হন্তক সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশের বিদেশী মিশনে কূটনৈতিক নিরাপত্তা ও মর্যাদার মোড়কে পদোন্নত পদে নিযুক্ত করে, বঙ্গবন্ধুকে যে ভবনে খুন করা হয়েছিল তা সরকারী দখলে রেখে, তার সহকর্মী ও সহযোগীদের জেলে ঢুকিয়ে কিংবা তাদের প্রতিকূলে রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে নির্যাতন মূলক পদক্ষেপ নিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী স্বৈরতান্ত্রিক জান্তা ঐ সময়ে তার হত্যার বিষয়ে এজাহার দেয়া ও বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করা অসম্ভব করে রেখেছিল। স্বৈরশাসক এরশাদের সময়ে এই হত্যার অন্যতম নায়ক কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও নেমেছিল। ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে একই কর্নেল ফারুক আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাকে ইচ্ছা করলে ৫ মিনিটে খুন করার সক্ষমতা তার আছে বলে জনসম্মুখে ঘোষণাও করেছিল। হত্যার ক্ষেত্রে খুনীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বাদী হয়ে মামলা চালনার বিধান ও দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও ’৯০-এ স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতনের পর খালেদার নেতৃত্বে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বিএনপি সরকার এই হত্যাকা-ের তদন্ত বা বিচারকরণ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এজাহার দেয়ার আগে ’৯৬ এর ১৩ আগস্ট রাতে হত্যাকা-ের অন্যতম মূল আসামি লেঃ কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানকে তার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। আরেক মূল আসামি কর্নেল খন্দকার রশীদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের গাফিলতির কারণে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কর্নেল রশীদকে ’৭৫ পরবর্তী সামরিক জান্তা লিবিয়ায় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক রফতানির ব্যবসা ও নির্মাণ ঠিকাদারিতে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করে। বঙ্গবন্ধুর খুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিদেশে বাংলাদেশের মিশনসমূহে পদায়িত ১২ সেনা অফিসার তাদের নিযুক্ত পদ ও স্থান থেকে ’৯৬-এর জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে জুলাইর দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে আত্মগোপন করে। লেঃ কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ছাড়া দেশে অবস্থিত লেঃ কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিষয়ে এজাহার দায়েরের আগে ’৯৬ এর আগস্ট ১৩-এ গ্রেফতার করা হয়। এজাহার দায়েরের পর লেঃ কর্নেল মহিউদ্দিন (আর্টিলারী) ২ নভেম্বর (’৯৬) ও আনারারী ক্যাপ্টেন আবদুল ওহাব জোয়ারদার (আর্টিলারী) ২০ অক্টোবর (‘৯৬) পুলিশের জালে ধরা পড়ে। বঙ্গবন্ধুকে খুন করার রাত পর্যন্ত সেনাবাহিনীর এসব অফিসারগণ এক পদবী নীচে নিযুক্ত ছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর প্রাথমিক পুরস্কার হিসেবে তাদের তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান এক ধাপের উঁচু পদবীতে উন্নীত করে। পদায়নের স্বাভাবিক সময়ের আগেই ক্যাপ্টেন হয় মেজর, মেজরকে করা হয় লেঃ কর্নেল। সাবেক মন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেফতার করা হয় ’৯৬-এর অক্টোবর ৩-এ। এজাহারে বিবৃত অপরাধ সমূহের ঘটনাদির বিস্তারিত তদন্ত সম্পন্ন করে সিআইডি পুলিশের সহকারী সুপার আবদুল কাহার আকন্দ ’৯৭-এর ১৫ জানুয়ারি অভিযোগপত্র বা চার্জশীট আদালতে দাখিল করেন। অনধিক ৩ মাসের মধ্যে বিস্তারিত তদন্ত শেষ করে সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ প্রশংসনীয় মাত্রায় নিষ্ঠা, সততা ও নির্ভীকতার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। অভিযোগপত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে দ-বিধির ১২০খ (রাষ্ট্রদ্রোহ), ৩০২ (হত্যা), ১৪৯ (বেআইনী সমাবেশ), ৩৪ (সাধারণ অপরাধমূলক লক্ষ্য অর্জনে সামষ্টিক তৎপরতা), ২০৯ (আদালতে মিথ্যা দাবি করা), ৩৮০ (বাসগৃহে চুরি) এবং ১০৯ (অপরাধে সহযোগিতা) ধারায় বর্ণিত অপরাধের জন্য দায় বিধৃত করা হয়। তদন্তের মাধ্যমে পর্যাপ্ত পরিমাণ সাক্ষ্য প্রমাণাদি না পাওয়ায় অভিযোগ পত্রে ৩ জন আসামিÑনায়েক মোঃ ইউনুস আলী, ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা ও মোঃ আবু মুসা মজুমদারকে অপরাধের দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ইতোমধ্যে মৃত হওয়ার কারণে ৩ জনÑখন্দকার মোশতাক আহমদ, মাহবুব আলম চাষী ও রিসালদার সৈয়দ সারোয়ার হোসেনকে কৃত হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকা সত্ত্বেও বিচারে সোপর্দ করা যায়নি। তদন্তে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের নেপথ্যে মূল রাজনৈতিক সন্দীপক ও পোষক হিসেবে খন্দকার মোশতাক আহমদ ও সাতিশয় ইচ্ছুক সহায়তাকারী হিসেবে মাহবুব আলম চাষী কুখ্যাতি পেয়েছিল। রিসালদার সরোয়ার হোসেনের ভূমিকা ছিল সংঘটিত হত্যার সঙ্গে প্রান্তিক সংশ্লিষ্টতার। অভিযোগপত্রে এদের বাইরে ২০ জনকে সুনির্দিষ্ট অপরাধের জন্য বিচারে সোপর্দ করা হয়। এরা হলো: (১) লেঃ কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশীদ, (২) মেজর মোঃ বজলুল হুদা, (৩) লেঃ কর্নেল নূর চৌধুরী, (৪) লেঃ কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, (৫) লেঃ কর্নেল মোঃ আজিজ পাশা, (৬) লেঃ কর্নেল রাশেদ চৌধুরী, (৭) মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমদ, (৮) রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন, (৯) মেজর আহম্মদ শরফুল হোসেন, (১০) ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম, (১১) ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসার, (১২) ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ, (১৩) দফাদার মারফত আলী শাহ্, (১৪) মোঃ আবদুল হাসেম, (১৫) লেঃ কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, (১৬) লেঃ কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, (১৭) লেঃ কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ (আর্টিলারী), (১৮) অনারারী ক্যাপ্টেন আবদুল ওহাব জোয়ারদার, (১৯) জোবায়দা রশীদ এবং (২০) প্রাক্তন তথ্যমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। এদের মধ্যে পরে সুপ্রীম কোর্ট (হাইকোর্ট ডিভিশন) জোবায়দা রশীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নাকচ করে দিলে মোট ১৯ জনের বিচার চলে। এই ১৯ জনের মধ্যে প্রথম ১৪ জন পলাতক থাকায় তাদের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্র কর্তৃক তাদের পক্ষে নিযুক্ত আইনবিদদের উপস্থিতি ও সহায়তায় তাদের বিচার অনুষ্ঠিত হয়। বিচারের রায় প্রদানের দিন অর্থাৎ, ’৯৮-এর ৮ নবেম্বর পলাতক আসামি মেজর বজলুল হুদাকে ব্যাঙ্কক থেকে গ্রেফতার করে এনে আদালতে হাজির ও রায় ঘোষণার পর ঢাকা জেলে অন্তরীণ করা হয়। অভিযোগ পত্রে সর্বমোট ৭৪ জন সাক্ষী এবং ৪৬টি দলিল ও জিনিসপত্র অপরাধের আলামত হিসেবে উল্লিখিত হয়। বাদী মুহিতুল ইসলাম ছাড়া সাক্ষীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পুলিশ সুপার (অবঃ) নুরুল ইসলাম, মেজর জেনারেল (অবঃ) মোঃ আবদুর রব, মেজর জেনারেল (অবঃ) কে এম সফিউল্লাহ্, এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) এ কে খন্দকার, এডমিরাল (অবঃ) মোশারফ হোসেন খান, মেজর জেনারেল (অবঃ) খলিলুর রহমান, লেঃ জেনারেল (অবঃ) নুরউদ্দীন খান, সৈয়দ সিদ্দিকুর রহমান, ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) এ কে এম শাহজাহান, মেজর (অবঃ) এ এইচ জিয়াউদ্দিন আহমদ, কমোডর (অবঃ) গোলাম রব্বানী, মোঃ সেলিম (ওরফে আবদুল), মহাপরিচালক (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) আবদুল্লাহ আল হাসান, অধ্যাপক খোরশেদ আলম ও আবদুর রহমান শেখ ওরফে রমা প্রমুখ। আলামত হিসেবে উপস্থাপিত জিনিসপত্রের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাস ভবনের পাঠাগারের ৫টি বুলেটবিদ্ধ বই, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধুর গুলিবদ্ধ যুগল ছবি, বঙ্গবন্ধুর পরিহিত ৫টি গুলির ছিদ্রসহ রক্তমাখা ১টি লুঙ্গি, ১টি রক্তমাখা ও ১২টি গুলির ছিদ্রসহ কুর্তা, ১টি কালোফ্রেমের চশমা, বেগম মুজিবের পরিহিত রক্তমাখা লালপেড়ে সাদা শাড়ি ও ১৩টি গুলির ছিদ্রসহ ১টি ব্লাউজ ও শেখ রাসেলের ব্যবহৃত রক্তমাখা আকাশী রঙের ১টি শার্ট ছিল। বুলেট বিদ্ধ বইগুলোর মধ্যে ছিল ভবেশ চন্দ্র সেনের ‘উড়ো জাহাজের কয়েদী’ এবং হুমায়ূন আহমেদের ‘তোমাদের জন্য ভালবাসা’। অভিযোগ পত্র অনুযায়ী ’৯৭-এর ৩ মার্চ ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল আসামিদের বিরুদ্ধে মামলাটির বিচারকার্য গ্রহণ করেন। সংবিধানে বিধৃত আইনের চোখে সকল নাগরিকের সমতা ও সকলের জন্য আইনের সমান প্রয়োগ ও আইনী আচরণের অধিকারের আলোকে সরকার বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যার বিচারের জন্য কোন বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল গঠন করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পক্ষপাতবিহীন প্রক্রিয়ায় দেশের সাধারণ আইনের আওতায় আইনের শাসনের সূত্র-অনুসারে সব অপরাধীর সাধারণ আদালতে বিচার অনুষ্ঠিত করার পক্ষে ছিলেন। দেশের প্রচলিত সাধারণ আদালতে এই হত্যার বিচার সম্পাদন করার অনুকূলে অন্যদের মধ্যে মত দিয়েছিলেন তখনকার আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু, এ্যাটর্নি জেনারেল কে এস নবী, কৃতবিদ্য আইনবিদ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ও এ্যাডভোকেট সবিতা রঞ্জন পাল। দেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধিরাও দেশের সাধারণ আদালতে এই হত্যার বিচার হলে তা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মত দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন যে, দেশের সাধারণ আদালতে বিচার সম্পন্ন হলে বিদেশে পলাতক আসামিদেও দেশে প্রত্যার্পণ সম্ভব ও সহজ হবে। প্রায় বিরতিহীনভাবে ১৬৩ দিন ধরে সাক্ষ্য প্রমাণাদি গ্রহণ ও বিবেচনা এবং আসামিপক্ষের আর্জি ও আপত্তিসমূহ নিষ্পত্তি করে ’৯৮-এর ৮ নবেম্বর জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল এই হত্যা মামলার রায় দেন। এই প্রক্রিয়ায় বিচারক গোলাম রসুল ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার আওতায় ৭ জনের বিবৃতি, ৭ জনের দোষের স্বীকারোক্তি, ১৯ জন আসামির (মৌখিক) পরীক্ষা, ৬৩টি প্রদর্শনী বা এক্সিভিট, ২টি প্রদর্শনীর আওতায় ৯টি জব্দকৃত দলিলপত্র ও ভিডিও ক্যাসেট এবং সংশ্লিষ্ট কাগজাদির বীক্ষণ সমাপন করেন। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে ২১ মে ’৯১ সালে চেন্নাইর শ্রীপেরুমবুডুরে হত্যা করা হয়। সে হত্যাকা-ের এজাহারদাতা ছিলেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ পরিদর্শক। হত্যা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ বলে এই দুই দেশেই আইনানুগভাবে গণ্য। সেজন্য হত্যা মামলায় রাষ্ট্র বাদী হওয়ার বিধান থাকায় সেদেশে হত্যার বিষয়ে কোন বেসরকারী ব্যক্তিকে এজাহার দেয়া পর্যন্ত পুলিশকে বসে থাকতে হয়নি। একই আইনী বিধান এদেশে থাকা সত্ত্বেও পুলিশ বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিষয়ে পুলিশ নয় এমন ব্যক্তি হতে এজাহার পাওয়া পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেয়নি। এই বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ অফিসার-নুরুল ইসলাম কোন এজাহার ঘটনার পর দেয়নি; হত্যার ঘটনাটি সংশ্লিষ্ট থানার (তখন লালবাগ থানা) সাধারণ ডায়েরিতে ভুক্ত হয়নি। দেশে বলবতাধীন ও অনুসরণীয় (বঙ্গীয়) পুলিশ বিধানাবলী অনুযায়ী থানাস্থিত এলাকায় ঘটিত, দৃষ্ট বা শ্রুত যে কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দৈনিক (পুলিশের) সাধারণ ডায়েরি বা দিনলিপিতে অলঙ্ঘনীয় বিধান বলে গ্রন্থিত। এই প্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কর্তব্য পালনে অবহেলা কিংবা বিচার বাধাগ্রস্ত করার দায়ে কোন অভিযোগ কিংবা মামলা হয়নি। রাজীব গান্ধী হত্যা মামলায় এক বছরের মধ্যে বিস্তারিত তদন্ত সম্পন্ন করে পুলিশ আদালতে চার্জশীট বা অভিযোগপত্র ২৬ জন আসামির বিরুদ্ধে উপস্থাপিত করে। প্রাথমিক শুনানির পর ’৯৩-এর ২৪ নবেম্বর ২৬ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। সাক্ষ্য প্রমাণাদির বিবেচনা শেষ করে ’৯৭-এর ৫ নবেম্বর চূড়ান্ত শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। বিচারক থীরু নবনীথাম উপস্থাপিত সকল সাক্ষ্য, প্রমাণ ও শুনানি বিবেচনা করে ’৯৮-এর ২৮ জানুয়ারি রায় প্রদান করে ২৬ জন আসামিকে শাস্তি প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় রাজীব গান্ধীর হত্যার তদন্ত ও বিচারের তুলনায় কম সময় নেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়ায় বিচারক কাজী গোলাম রসুল রাজীব গান্ধী হত্যার বিচারক (চেন্নাইর অতিরিক্ত বেসামরিক ও দায়রা বিচারক) থীরু নবনীথামের মতই প্রশংসনীয় ধৈর্য, আইনী জ্ঞান, অন্তর্দৃষ্টি ও নিরপেক্ষতা প্রদর্শন করেন। বিচারের মূল সূত্র হিসেবে বিচারক গোলাম রসুল তার রায়ের প্রথমেই উল্লেখ করেন যে, ন্যায় বিচার সংশ্লিষ্ট ঘটনার বিষয়ে ব্যক্তিগত নৈতিক বিশ্বাসে প্রভাবিত না হয়ে কেবলমাত্র বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সম্পাদনীয়। তার উল্লিখিত সূত্র নিঃসন্দেহে দেশের সকল বিচারক কর্তৃক অনুসরণীয়। বিচার প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের তরফ থেকে মামলা পরিচালনা করেন সর্বএ্যাডভোকেট মোঃ সিরাজুল হক, মোঃ রমজান আলী খান, সৈয়দ রেজাউর রহমান, মোশারফ হোসেন কাজল, প্রয়াত সাহারা খাতুন (সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী), কামরুল ইসলাম (পরবর্তীকালে খাদ্যমন্ত্রী), নুরুল ইসলাম খান ও আনিসুল হক (এখনকার আইনমন্ত্রী)। আসামি পক্ষে ছিলেন সর্বএ্যাডভোকেট খান সাইফুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক খান, এ বি এম শরীফ উদ্দিন খান মুকুল ও টি এম আকবর এবং পলাতক আসামিদের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োজিত আরও ১৪ জন আইনজীবী। চলবে... লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী
×