ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নির্মম বিভীষিকার সেই বিকেল

প্রকাশিত: ২০:৫১, ২১ আগস্ট ২০২০

নির্মম বিভীষিকার সেই বিকেল

সেই দৃশ্যপটের দিকে এখনও চোখ মেলে তাকাতে পারি না। কী বীভৎস! কী নির্মম বিভীষিকাময় সেইসব চিত্রাবলী। রক্ত আর মানবদেহের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা খ- খ- টুকরো পুরো রাস্তাজুড়ে, আর্তনাদের দৃশ্যাবলীর পাশাপাশি পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ, আহতদের হাসপাতালে নিতে বাধা প্রদান, সরকারী হাসপাতালের গেট বন্ধ কিংবা চিকিৎসা প্রদানে অপারগ চিকিৎসক, সেবা প্রদানে অনাগ্রহী সেবকরা এমন অমানবিকতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল ১৬ বছর আগে রাজধানী ঢাকায় রাজনৈতিক নেতাকর্মী আর জনসভায় আগত শ্রোতাদের। ববর্রতার নিকৃষ্ট উদাহরণ সেদিন তৈরি হয়েছিল। প্রাণহরণের খেলায় মেতেছিল সরকার তথা রাষ্ট্র। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় চালানো হয়েছিল গণহত্যা। খুবই সুপরিকল্পিতভাবে এক সংগঠিত শক্তি সংঘটন করেছে এই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। সভ্যতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বর্বরতার আশ্রয় নেয়া শক্তি ক্ষমতার দ-মু- সেজে যে ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি করেছিল, তাতে লক্ষ্যবস্তু নিশ্চিহ্ন করা না গেলেও গণহত্যার শিকার হয়েছে অনেকে। এই পাশবিকতা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অমানবিক আচরণের উল্লম্ফন সেদিন দেখেছে দেশবাসীসহ বিশ্ববাসী। সভ্যতাকে ছিন্নভিন্ন করে অসভ্যতার বিস্তার ঘটানো হয়েছিল সরকারী উদ্যোগেই। অগণতান্ত্রিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ বুঝি এই গণহত্যা, যা ১৯৮৮ সালের চব্বিশে জানুয়ারিতে চট্টগ্রামে সংঘটিত গণহত্যাকেও হার মানিয়েছিল। শেখ হাসিনাকে হত্যার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলেও প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল ২৪ জন সাধারণ মানুষসহ রাজনৈতিক কর্মীকে। সামরিক জান্তা শাসক সরকারী বাহিনীকে ব্যবহার করেছিল। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে ট্রাকযোগে লালদীঘি ময়দানে যাচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। সেখানে জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল দলীয় উদ্যোগে। তাঁর গাড়িবহরকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছিল। সেদিন আইনজীবীরা আদালত থেকে বেরিয়ে এসে শেখ হাসিনাকে ‘কর্ডন’ করে রেখেছিলেন। এরপর শেখ হাসিনা আদালত ভবনে আইনজীবীদের উদ্দেশে ভাষণও দেন। এরশাদ সেদিন ব্যর্থ হয়েছিলেন। তার পোষ্য বাহিনী পাকিস্তানফেরত সেনা কর্মকর্তা, যিনি জান্তা শাসনকালে পুলিশে যোগ দিয়ে পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনার হয়েছিলেন। তারই নির্দেশে সংঘটিত হয়েছিল গণহত্যা, যার বিচার এখনও ঝুলন্ত। সভ্যতা সেদিনও ধুলায় লুণ্ঠিত হয়েছিল। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট বাঙালীর ইতিহাসের কলঙ্কজনক এবং মর্মান্তিক অধ্যায়ের আরেক নাম। বর্বর শাসক দল প্রশাসন এবং জঙ্গীদের সম্মিলনে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য যে পথ বেছে নিয়েছিল, তা মানবসভ্যতাকে বিদ্রƒপ করারই নামান্তর। সভ্যতা মূলত মানবজীবনের আধার। মানবতা বলতে যা বোঝায়, তারও আধার। মানুষ জানে, সভ্যতার অগ্রগতির সামগ্রিক অর্থ মানুষেরই অগ্রগতি। সভ্যতার অগ্রগতির অর্থ দাঁড়ায় পারিপাশ্বিকতার অগ্রগতি বা নিরন্তর বদল। যদিও তাতে মানবসমাজের অগ্রগতি হয় না। কোন ক্ষেত্রে অগ্রগতি কিছু মানুষের হয়, কোন ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শ্রেণীর। মানবতা জান্তা শাসক ও তার উত্তরসূরির হাতে বার বার লাঞ্ছিত হয়েছে। আইভি রহমানের পা বিহীন রক্তাক্ত সেই ছবিটির দিকে আজও তাকাতে পারি না। মাতৃসম মহীয়সী নারী ছিলেন তিনি। পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। ১৯৮০ সালে ডাকসু নির্বাচনে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে ছাত্রলীগের কাদের-চুন্নু পরিষদ থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি বাসায় ডেকে নিয়ে নিজ হাতে রান্না করা খাবার খাইয়েছিলেন। স্বামী জিল্লুর রহমানের স্নেহের ও আশীর্বাদের হাত বিগলিত করেছিল বৈকি। ১৯৮৪ সালে আওয়ামী লীগের ১৫ আগস্টের সংকলন সম্পাদনা পরিষদের সদস্য হিসেবে জিল্লুর রহমান ও আইভি রহমানের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। তারা তখন থাকতেন মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে আর আমি পৈত্রিক নিবাস বাবর রোডে। তাদের বাসার সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হতো। কত কাছের মানুষ ছিলেন দুজনে। পঁচাত্তর-পরবর্তী ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে ‘সংস্কৃতিসভা’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলাম আইভি রহমানের পরামর্শে। এই সংগঠনে তার কন্যারাও ছিলেন। আয়োজিত অনুষ্ঠানে ও রিহার্সেলে তানিয়া ও তনিমারা গাইতেন। নেত্রী সাজেদা চৌধুরী, নেতা মালেক উকিলের কন্যারাও এই সংগঠনে সক্রিয় ছিলেন। টিএসসিতে রিহার্সেল হতো। মাঝেমধ্যে জিল্লুর রহমান ও আইভি রহমান একসঙ্গে কিংবা পৃথকভাবে রিহার্সেল দেখতে আসতেন। নানা পরামর্শ দিতেন। সুন্দরের পূজারি এই নেতানেত্রীরা কর্মীদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত মানবিক ও উদার। তাদের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়াতেন। সংসার, রাজনীতি ও সমাজকর্মÑ সবকিছুই সুচারুভাবে পালন করতেন বেগম আইভি রহমান। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দানবিক, পাশবিক, অমানবিক আক্রমণের শিকার হলেন মহীয়সী নারী আইভি রহমান। হাসপাতালে তিন দিন কষ্টকঠিন অবস্থায় কাটিয়ে তিনি চলে গেলেন অনন্তলোকে। কী অদ্ভুত, হামলাকারীদের নেত্রী খালেদা জিয়া ২৩ আগস্ট বিকেলে সিএমএইচে দেখতে গিয়েছিলেন আইভি রহমানকে। তিনি বোধহয় দেখতে এসেছিলেন, বীভৎসতার স্বরূপ। সর্প হয়ে দংশন করলেও ওঝা হয়ে ঝাড়তে আসেননি। নিজের কৃতকর্মের ফলাফল তিনি দেখেছিলেন সানগ্লাসের আড়াল থেকে। এই বেগম জিয়াই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, গ্রেনেড হামলা আওয়ামী লীগ নিজেরাই ঘটিয়েছে। শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে গ্রেনেড নিয়ে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। কী নির্মম ভাষ্য তার। মিথ্যাচারে পূর্ণ এসব ঘৃণ্য ভাষ্য মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছিল। শেখ হাসিনা গ্রেনেড মারার প্রশিক্ষণ কবে নিয়েছিলেন, দেশবাসীর তা জানা নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় যে গ্রেনেড এবং সেনাবাহিনী যা ব্যবহার করে, সেই গ্রেনেড ব্যবহৃত হয়েছিল আওয়ামী লীগের জনসভায়। বিস্ফোরণের পর সভাস্থলে উপস্থিত পুলিশ আহতদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি। বরং লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয় উদ্ধারে আসা মানুষজনকে। জনসভা চলাকালে মঞ্চের পেছনে থাকা সাংবাদিকদের মধ্যে আমিও ছিলাম। ‘পূর্ণিমা’ নামক খাবার দোকানে জিলাপি খাওয়ার জন্য শ্রমিকনেতা হাবিবুর রহমান আকন্দ আমন্ত্রণ জানালে তার সঙ্গে গিয়েছিলাম বলে হামলার শিকার হইনি। আহতদের উদ্ধারে যখন দুজন এগিয়ে যাই, পুলিশের লাঠিচার্জের শিকার হই পিঠে। এরপরই টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় চোখ জ্বলতে থাকে। রুমাল ভিজিয়ে চোখ রক্ষার চেষ্টাও এক সময় ব্যর্থ হয়। চলবে... লেখক : মহাপরিচালক, প্রেস ইসস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক
×