ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঘাতকদের ট্রেনিং, আর্জেস গ্রেনেড ও আশ্রয় পাকিস্তানে

প্রকাশিত: ২২:৩৯, ২০ আগস্ট ২০২০

ঘাতকদের ট্রেনিং, আর্জেস গ্রেনেড ও আশ্রয় পাকিস্তানে

শংকর কুমার দে ॥ দেশে রাজনৈতিক দল, জঙ্গী সংগঠন ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে গ্রেনেড হামলার নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছে পাকিস্তান। একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলার তদন্ত প্রতিবেদন, গুরুত্বপূর্ণ নথি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং আসামিদের জবানবন্দী বিশ্লেষণে পাকিস্তানের এই ধরনের ভূমিকার কথা তুলে ধরা হয়েছে আদালতে। শত শত পৃষ্ঠার দলিল বিশ্লেষণ করে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের পেছনে ছিল প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা, কয়েকজন শীর্ষ জঙ্গী নেতা আর পাকিস্তানের ভূমিকার প্রসঙ্গ আদালতে তুলে ধরেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট মোশারফ হোসেন কাজল। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আদালতে তুলে ধরা তদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষ্য গ্রহণ ও মামলার রায়ের সাজাদান ও পর্যবেক্ষণে এসব তথ্য প্রমাণে সক্ষম হয়েছে বলে রাষ্ট্রপক্ষের দাবি। আদালত, রাষ্ট্রপক্ষ, তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ সূত্রে এ খবর জানা গেছে। অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির তদন্তে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করতে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ইতিহাসের নৃশংসতম এ গ্রেনেড হামলা চালায় বিএনপি-জামায়াত তথা চার দলীয় জোট সরকার। দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বহুল আলোচিত গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। একুশে আগস্ট মামলার তদন্ত প্রতিবেদন, গুরুত্বপূর্ণ নথি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং আসামিদের জবানবন্দী বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশের একাধিক রাজনৈতিক দল, জঙ্গী সংগঠন ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার উদেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে অনুষ্ঠিত জনসভায়। একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলার নেপথ্যে ছিল পাকিস্তান আর দেশের একাধিক রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদ, জঙ্গী সংগঠন এবং গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে পরিকল্পনা করে ওই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট মোশারফ হোসেন কাজল বলেছেন, অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির দেয়া শত শত পৃষ্ঠার দলিল বিশ্লেষণ করে তা তুলে ধরা হয়েছে আদালতে। মূলত এই হামলার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের পেছনে ছিল পাকিস্তান। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে ’৭৫’র ১৫ আগস্ট সপরিবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকা-ের পরিকল্পনা এবং লক্ষ্যের মিল পেয়েছেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের মতোই ২১ আগস্টের হামলার ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করা হয়েছিল বলে দাবি করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। আদালতে তুলে ধরা রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্যে বলা হয়েছে, ২০০৪ সালের কিছু সামরিক কর্মকর্তা আর জঙ্গী নেতাদের নিয়ে হাওয়া ভবনে বসে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সবকিছু চূড়ান্ত করেন। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়ে আসামিরা বলেছেন, হামলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতর (ডিজিএফআই) ওই সময়ের পরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) মহাপরিচালক আব্দুর রহিম, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, জঙ্গী নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা ফরিদ, মুফতি আব্দুল হান্নান, হুজির সাবেক আমির মাওলানা আবদুস সালাম এবং কাশ্মীরী জঙ্গী আব্দুল মাজেদ বাট। হামলায় অংশ নেয়া ব্যক্তিদের পাকিস্তানে ট্রেনিং দেয়া হয়। ট্রেনিংয়ের পর তাদের আর্জেস গ্রেনেডও সরবরাহ করে পাকিস্তান। হামলা শেষে পাকিস্তান তাদের আশ্রয়ও দেয়। আদালতে বলা হয়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং সেসময়ের বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ নিহত হন ২৪ জন নেতাকর্মী। গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা মামলায় ৪৯১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত ১৭৬ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। সপরিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য এবং শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে হাওয়া ভবন আর সাবেক মন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর বাসভবনে বসে ষড়যন্ত্র করা হয়। সেই ষড়যন্ত্র অনুয়ায়ী মুফতি হান্নানসহ আরও কয়েকজন দুষ্কৃতকারী এ নারকীয় হামলা চালায়। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপন করা বক্তব্যে বলা হয়, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় যে আর্জেস গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছে তা শুধু পাকিস্তানই উৎপাদন করে। বিশ্বের অন্য কোন দেশ এই আর্জেস গ্রেনেড বানায় না। সুতরাং যে গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছে তা নিশ্চিত পাকিস্তান থেকে এসেছে। মামলায় আটক হওয়া কয়েকজন আসামির ঘন ঘন পাকিস্তানে আসা-যাওয়া আর সেখানে দীর্ঘদিন অবস্থান করার প্রমাণ আছে যা আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। হামলার পরপরই ঘটনাস্থলের পাশ থেকে সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি দ্রুত চলে যায়। এরপর কারাগারে পাওয়া যায় অব্যবহৃত তাজা গ্রেনেড। আর হামলায় যে ধরনের কৌশল ব্যবহার করা হয় সেটা একমাত্র সামরিক বাহিনীতে দেখা যায়। হামলাকারীদের দীর্ঘদিন ধরে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। রাাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট মোশারফ হোসেন কাজল আদালতকে বলেছেন, তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার এই হত্যাকা-ের তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে জজ মিয়া নাটক সাজিয়েছিল। এরপর ২০০৮ সালের ১১ জুন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ৩ জুলাই অধিকতর তদন্তের পর তারেক রহমান, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করে মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন সিআইডির বিশেষ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাক্ষী ডিজিএফআই-এর জঙ্গী দমন সংক্রান্ত ব্যুরোর তৎকালীন কর্মকর্তা লেফটেনেন্ট কমান্ডার মিজানুর রহমান আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে বলেছেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর লেফটেনেন্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার (বর্তমানে বরখাস্ত ও পলাতক) তার উর্ধতন কর্মকর্তা ও অন্য কারো সম্পৃক্ততার কথা গোপন করার জন্য মাওলানা তাজউদ্দিনকে ২০০৬ সালের অক্টোবরে সুকৌশলে পাঠিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানে। অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল গঠন, জঙ্গী তৎপরতায় মদদদান, গ্রেনেড হামলার মতো নাশকতার ঘটনাগুলোর নেপথ্যে পাকিস্তান যে কলকাঠি নেড়েছে তা একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার তদন্তে, সাক্ষ্যে, আলামতে উঠে এসেছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির সহায়তায় পাকিস্তান প্রতিশোধ নেয়ার যে চেষ্টা করে যাচ্ছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি রায় কার্যকরের পর পাকিস্তানের বাংলাদেশ বিরোধী প্রতিক্রিয়ায়।
×