ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

বন্ধ স্কুলের শিশুর শিক্ষা ও কিশোর হত্যা

প্রকাশিত: ২০:৫১, ২০ আগস্ট ২০২০

বন্ধ স্কুলের শিশুর শিক্ষা ও কিশোর হত্যা

আমরা ব্যক্তিগতভাবে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত যাদের আর্থিক সহায়তা করেছি, তাদের মধ্যে একটি অংশ হচ্ছে বেসরকারী কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারী নন এমপিও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আয় হারানো শিক্ষক পরিবার। কিন্তু এমন স্কুল তো সারাদেশে হাজার হাজার, যাতে ভর্তি হওয়া শিশুর সংখ্যা কয়েক লাখ তো হবেই, যারা বাবা-মা উপার্জনহীন হয়ে পড়াতে স্কুলের বেতন দিতে অপারগ। স্কুলের বেতন পাওয়া না গেলে শিক্ষকের বেতন হয় না, স্কুল কর্তৃপক্ষ বিশাল বিপদে পড়ে। তা ছাড়া অনেক স্কুল বসে ভাড়া বাড়িতে, যে ভাড়া দেয়ার সামর্থ্যও স্কুল কর্তৃপক্ষের নেই। একটা নতুন ধরনের আর্থিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে, যেটি শিক্ষা, শিশু, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের একই সঙ্গে বড় ধরনের সঙ্কটে ফেলেছেÑ সেটি শেষ পর্যন্ত জাতীয় অসংখ্য নতুন সমস্যার মধ্যে অন্যতম বলা যায় এবং অন্য অনেক সঙ্কটের চাইতে বেশি গুরুত্ব বহন করছে। ভাবছি, এই শিশুরা যদি জানে তাদের প্রিয় স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেছে বা বিক্রি হয়ে গেছে, তখন কি বিশাল এক শূনতা ওই ছোট মনগুলোতে ছড়িয়ে পড়বে! তখন ওদের কতটা মানসিক কষ্ট বইতে হবে। স্কুল হঠাৎ হারিয়ে যায়- এ কথা ভাবা যায় না, ভাবা যায় না স্কুল ব্যাগ, ফ্লাস্ক নিয়ে আমার জন্য একটি কক্ষ অপেক্ষায় নেই। নেই শিক্ষকÑ যিনি বই খাতা, ব্ল্যাকবোর্ড দিয়ে শিক্ষা দিতেন। নেই বন্ধু-সহপাঠীরাÑ যাদের সঙ্গে পড়াশোনা, খেলাধুলা, হৈচৈ, অনুষ্ঠান করার মধুর সাহচর্য! তার ওপর শিশুদের জন্য ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক ঘটনা যে ঘটবে- ছোট শিশুরা তাদের অর্জিত শিক্ষার মৌলিক দক্ষতা ও জ্ঞান অনুশীলনের অভাবে ভুলে যাবে। আমরা শিক্ষা নিয়ে কাজ করা পেশাজীবীরা জানি, শিশুরা যেমন দ্রুত শেখে, তেমনি অনুশীলনে না থাকলে দ্রুত ভোলেও। জানি না, শিক্ষামন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তা, মধ্যম স্তরের কর্মকর্তা, শিক্ষা অধিদফতর, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষকরা এই বিশাল জাতীয় সঙ্কটের বিষয়টি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছেন কিনা। তবে, এ বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা করে দ্রুত এর একটি বা একাধিক সমাধান সন্ধান করতে হবে। আর যাই হোক, স্বাস্থ্যের পাশাপাশি শিক্ষা মানবসম্পদ তৈরিতে কিছুমাত্র কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেটি ব্যক্তির জীবন-জীবিকার উন্নয়নে যেমন প্রধান উপাদান, তেমনি জাতীয় উন্নয়নে মানব সম্পদ তৈরিতে সমান তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতির নিয়ামক। কথা হচ্ছে, এসব বেসরকারী কিন্ডারগার্টেন নামের ভাল-মন্দ, চলনসই এদের সম্পর্কে। এমন নানা রকম ক্যাটাগরির স্কুল আছে সারাদেশে, সব জেলাতে ও উপজেলাতে। অনেক ক্ষেত্রে, এর জন্য দায়ী কিছুটা আমরাও। অর্থাৎ, আমাদের মতো অভিভাবকরাÑ যারা দেখতে পাচ্ছে, তাদের জন্য আদর্শ ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে নানা পেশাজীবীসহ সরকারী কর্মকর্তারাও তাদের সন্তানদের ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে পড়াচ্ছে এবং মনে করা হচ্ছেÑ ইংরেজী শেখাটা, ইংরেজীতে কথা বলতে পারাটা শিক্ষার প্রধান একটি উদ্দেশ্য এবং এই ছেলেমেয়েরাই ভবিষ্যতে ভাল জীবিকা লাভ করবে। এর ফল বা পরিণতি যেটাই হোক, অভিভাবকদের এক বিশাল অংশের চাহিদাপূরণ করতেই লক্ষাধিক কিন্ডারগার্টেন জন্ম নিয়েছে। আসলে করোনার প্রকোপ হ্রাসের পাশাপাশি সরকারের দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে উন্নয়ন ঘটানো সহজসাধ্য হবে। একটি তো শিক্ষিত মানুষ বলেই চলেছেন যে, জন্মহার হ্রাসের লক্ষ্যে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম না নিলে প্রতিবছর নতুন করে লাখ লাখ শিশু জন্ম নিয়ে খাদ্য, স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষাÑ সব কিছুর ওপর প্রচ- চাপ তৈরি করবে, যা এক্ষুণি অন্তত চীনের মতো এক সন্তান নীতি প্রবর্তন না করলেও শূন্য জন্মহারের, অর্থাৎ, দুই সন্তানের মধ্যে সন্তান সংখ্যা সীমিত রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করতেই হবে। নতুবা ষোলো কোটি থেকে আঠারো কোটি জনসংখ্যা হলো কেন? আমরা পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীকে কারা স্থানীয় তৃণমূল পর্যায়ে ব্যর্থ করানোর জন্য কাজ করছে, তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করে ওই স্থানে দক্ষ ও আন্তরিক মাঠকর্মী নিয়োগ করে প্রতি উপজেলা, জেলার মাসওয়ারী জন্মহার মনিটর করার প্রস্তাব করছি এবং দুই সন্তান নীতিসহ বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করার ওপর জোর দিতে আহ্বান করছি। উন্নয়ন জনসংখ্যার প্রেক্ষিতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সীমিত না করা হলে জনসংখ্যার ভারে ক্ষুদ্র আয়তনের দেশ, তার ওপর নদী ভাঙ্গনে ভূমি হারানো সমুদ্র কর্তৃক ভূমিগ্রাস এসবের দ্বারা উন্নয়নের ধারা ধরে রাখা ও অব্যাহত রাখা অসম্ভব হয়ে উঠবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাসের পাশে গুণগত মানসম্মত শিক্ষাÑসব শিশু-ধনী-গরিব, সবার জন্য নিশ্চিত করা সরকারের জন্য অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এটি না করে কোন উপায় নেই। সে জন্য সারাদেশের লক্ষাধিক কিন্ডারগার্টেনে পড়া শিশুদের এবং শিক্ষকদের কিভাবে শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা করতে হবে, কোন কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্ধ হওয়া কিন্ডারগার্টেনের শিশুদের ভর্তি করে সে সব স্কুলে কর্মহীন শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া, অনেক কিন্ডারগার্টেনকে সরকারীকরণ করে নিয়ে শিশুদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগটি অব্যাহত রাখতে পারে। প্রস্তুত অবকাঠামো ও শিক্ষক প্রস্তুত থাকায় এ কাজটি সহজ হবে। যেসব স্কুল সরকারীকরণ চাইবে না, তাদের বাদ দিতে হবে। স্কুল শিক্ষক বেতন পাচ্ছেন না, তাই চলতে পারছেন না। আবার শিশুর অভিভাবকরা আয়হীন হয়ে পড়ায় স্কুল-ফি দিতে পারছেন না- বিষয়টি দাবি ছাড়া এ দুষ্ট চক্র ভাঙ্গা সম্ভব হবে না। নিশ্চয় সরকার এ বিষয়ে ভাবছে। তবে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে। এবার আসি যশোরে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিনজন শিশুর অকাল, অযৌক্তিক মৃত্যু প্রসঙ্গে। এ ধরনের কিশোর সংশোধনাগারে আমি অনেক আগে থেকে লক্ষ্য করেছি, এখানে নিযুক্ত প্রশাসক বা শিক্ষকরা বড়ই দয়ামায়াহীন, নির্দয় মনমানসিকতাই প্রদর্শন করে থাকে। লক্ষ্য করেছি এতিমখানাতেও শিশুদের সঙ্গে প্রায়ই সহানুভূতিহীন, মায়া মমতাহীন আচরণ করে বিশেষত পুরুষ কর্মকর্তা প্রশাসক শিক্ষকরা। অথচ সমাজে অবহেলিত, প্রায়শই দরিদ্র পরিবারের শিশু-কিশোররা এসব সংশোধনাগার বা উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকতে বাধ্য হয়। আর অনাথ বা আরও দরিদ্রদের ছেলেমেয়ে এতিমখানাগুলোতে থাকে। এখানে রাখা ছেলেমেয়েদের প্রধান উদ্দেশ্য শিক্ষা লাভ এবং পাশে কিছু কারিগরি শিক্ষা অর্জন, যা তাদের ভবিষ্যত জীবিকার সুযোগ করে দেবে। যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ঘটনার শুরু যদি হয় চুল কাটা নিয়ে, তাহলে বলতেই হয় যে, চুল কাটার প্রশিক্ষণ শুধু একজন কিশোরকেই দেয়া হয়েছে, এমনটা হতে পারে না। তাহলে একজন কিশোর সবার চুল কাটতে বাধ্য হচ্ছে কেন? তা ছাড়া সব আবাসিকের চুল একই দিনে কাটতে হবেই বা কেন? সবকিছুর ওপরে প্রশ্ন হচ্ছে, ‘দলাদলি’ নামক প্রশাসকপন্থী এবং সাধারণ কিশোর যারা দলে থাকে না, তাদের মধ্যে মারামারি হওয়ার সূচনাতেই কি প্রশাসক-শিক্ষকরা সেটি বন্ধ করতে হস্তক্ষেপ করবে না? নাকি, মা, বাবার সান্নিধ্য সহায়তা ও ভালবাসা বঞ্চিত কিশোরদের হাত-পা বেঁধে পেটাতে পেটাতে অর্ধমৃত করে ফেলে রাখা যায়? যদি, কোন শিক্ষক ক্রোধবশত কোন ছাত্রকে দু-এক ঘা লাগায়, তারপর তো তার নিজের মনস্তাপ হওয়ার কথা। মার খেয়ে জ্ঞানহারা কিশোরদের জ্ঞান ফেরার পর আবার মারধর করে ফেলে রাখা, তিন তিনজন কিশোর বিনা অপরাধে বিনা চিকিৎসায় একতরফা মারধরের ফলে মারা যেতে পারেÑ এ কেমন নির্দয় প্রশাসকদের অধীনে মা-বাবা ছাড়া শিশু-কিশোররা বাস করছিল? এমনকি, তাদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে সহায়তা করার শিক্ষকও এই বর্বরতার সঙ্গে যুক্ত ছিল! আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছি যে, এই ঘটনার পর এই কেন্দ্রে ছেলেদের রেখে বাবা, মায়েরা কতটা স্বস্তিতে থাকবেন? অনেক আগে একবার এক কিশোর সংশোধনাগারে মারামারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে লিখেছিলাম যে, এসব কেন্দ্রে বয়স্ক নারীদের তত্ত্বাবধায়ক প্রশিক্ষক ও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলে ফল ভাল হবে। কিছু কারিগরি শিক্ষার বিষয়ে পড়ানোর জন্য প্রয়োজনে পুরুষ শিক্ষক প্রশিক্ষণ দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু প্রধান কর্তাব্যক্তি, লেখাপড়া শেখানোর কাজটি বয়স্ক নারীরা করলে এসব সংশোধনাগার অনেক বেশি মানবিক হয়ে উঠবে। ওই পুরুষ শিক্ষকরাও নারী সহকর্মীদের সাহচর্জে নমনীয় ও মানবিক হয়ে উঠবে। পৃথিবীতে করোনাভাইরাস জানা নতুন একটি বিষয়। পুরুষ যে অনেক বেশি নির্মম-নির্দয়, মায়া-দয়াহীন, তা সে আবার প্রমাণ করেছে। যে কারণে লকডাউনের সময়ে নারী-স্ত্রী হত্যা, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল, মেক্সিকোতে হাজার হাজার নারীর নিখোঁজ হওয়ার খবর জানা যাচ্ছে। ভাবছি বেগম রোকেয়ার স্বপ্নযদি সব দেশের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী নারী হতো, তাহলে পৃথিবী যে সবুজ ও সুন্দর হতো, জলবায়ু সমস্যায় পড়ত না, দারিদ্র্য কমে যেত, যুদ্ধ বন্ধ হতো, পুরুষসহ পরিবার ও পৃথিবী হতো শান্তিপূর্ণ আবাসÑ তা কি হবে কোনদিন? আমাদের মহা জ্যোতিষী স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলে ফেললেন, করোনা নিজেই চলে যাবে, আমাদের আর টিকা লাগবে না! কদিন আগে রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি অনুষ্ঠানে মন্ত্রী, সচিবসহ স্বাস্থ্য খাতের বড় বড় কর্মকর্তা উপস্থিত থেকে হাস্যমুখে মহাপ্রতারক সাহেদের সঙ্গে যখন ছবি তোলেন, তখন মনে প্রশ্ন জাগে, সাহেদের সান্নিধ্যে ওনারা এত আনন্দিত কেন? কোথায় সাহেদ, সাবরিনার আশ্রয় প্রশ্রয় দাতার নাম? সিন্হা হত্যা ঠা-া মাথার কাজÑ তাহলে গণশুনানি ‘বদ্ধ ঘরে’ হয় কি কারণে? পুলিশ কর্মকর্তারা সিনহার ডকুমেন্টারি তৈরির সহযোগী একজন ছাত্রীকে ফেসবুকে ট্রল করলে বা কোন অনাকাক্সিক্ষত মন্তব্য করলে, তারা আইসিটি আইনে দোষী সাব্যস্ত হচ্ছে না কেন? কোন সরকারী কর্মকর্তা এমন বেআইনী কাজ করতে পারে না। তাদের আইসিটি আইনে শীঘ্র উপযুক্ত শাস্তি দিন। নতুবা আইসিটি আইন নিরপেক্ষতা হারাবে। যারা ওসি প্রদীপ, খুনী লিয়াকতের সুবিধা গ্রহণকারী, তারা ছাড়া অন্যদের এত বড় ঝুঁকি নেয়ার কথা নয়। দুদক মহাপ্রতারক মিঠুকে সম্পত্তির হিসাব দিতে পত্র দিয়ে তিন বছর নীরবতা অবলম্বন করেই বা কেন? এসব প্রশ্ন জনগণকে খুব অস্বস্তিতে ফেলেছে। কারণ বঙ্গবন্ধু যেমন, তেমনি শেখ হাসিনাও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সনীতি ঘোষণা করেছেন। তাঁর দিকে সবাই তাকিয়ে আছে! লেখক : শিক্ষাবিদ
×