ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

জনপ্রিয়তার অপরাধ...

প্রকাশিত: ২০:৫২, ১৯ আগস্ট ২০২০

জনপ্রিয়তার অপরাধ...

লেখক বা কথাসাহিত্যিকদের জনপ্রিয়তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মাঝে মাঝেই সরব হয়ে ওঠে। এ সময়ের দুয়েকজন তরুণ লেখকের লেখা এবং তাদের জনপ্রিয়তার এ মুহূর্তে ব্যবচ্ছেদ চলছে। অতীতেও জনপ্রিয় ধারার লেখকরা নানাভাবে কটাক্ষ, ব্যঙ্গ বিদ্রƒপের শিকার হয়েছেন। প্রবোধ চন্দ্র সান্যাল এবং তার সমসাময়িক অনেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শরৎচন্দ্রের লেখার কঠোর সমালোচক ছিলেন। ‘চরিত্রহীন’ নিন্দার ঝড় তুলেছিল। উপন্যাসটিকে বলা হতো ইম্্মর‌্যাল, লেখককে লম্পট। তার উপাধিই হয়ে গিয়েছিল ‘চরিত্রহীন’। ‘শেষ প্রশ্ন’ও কম আক্রান্ত হয়নি। ‘শেষ শ্রাদ্ধ’ নামে ব্যঙ্গ কৌতুক কার্টুন ছেপেছে শনিবারের চিঠি। তুলনায় হুমায়ূন আহমেদের পথ ছিল কুসুমাস্তীর্ণ। এত তীব্র সমালোচনার মুখে তাকে পড়তে হয়নি। সমালোচকের চেয়ে তার ভক্ত ও পারিতোষকের সংখ্যা বেশি ছিল বলেই হয়ত। তার বইয়ের মনোপলি এত শক্তিশালী ছিল যে, তার লেখার সমালোচনা করার অসুবিধাও ছিল। প্রথমত সমালোচকের উল্টো আক্রমণের শিকার হওয়া- হুমায়ূনের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত, নিজের অক্ষমতা থেকে বিষোদ্গারণ ইত্যাদি জাতীয় মন্তব্যে। ঈর্ষা থেকে সমালোচনা যে হয়নি তা নয়। তবে সাহিত্য বিচারের দিক থেকে যারা সত্যিকারের সমালোচনা করতে পারতেন তাদের অনেকেই হুমায়ূন বলয়ে এত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন যে, তাদের পক্ষে ও কাজ করা সম্ভব হয়নি। তারপরও সমালোচনা তো হয়েছেই এবং স্বাভাবিকভাবে তা তাকে স্পর্শও করেছে। ‘আমি’ বইয়ে ‘যদ্যপি আমার গুরু’ লেখাতে শরৎচন্দ্রকে সমর্থন করতে গিয়ে নিজেকেই যেন উপস্থাপিত করেন হুমায়ূন, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ফিরে যাই। তাকে সম্মান দেখানোর আতিশয্যে এক প্রবন্ধকার লিখেছেন, সস্তা ধারার জনপ্রিয় লেখক শরৎচন্দ্রকে পেছনে ফেলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এগিয়ে গেছেন কত দূর। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা মানেই পরাবাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা ইত্যাদি। ... বেচারা শরৎচন্দ্রের সমস্যা, তার রচনা সব বাঙালী মেয়েরা চোখের জল ফেলতে ফেলতে পড়ে। আমাদের ধারণা বহুলোক যা পছন্দ করে তা মধ্যম মাত্রার হবে। কারণ বেশিরভাগ মানুষের মেধা মধ্যম মাত্রার। বাংলা ভাষার ঔপন্যাসিকদের প্রচুর ইন্টারভিউ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একটি প্রশ্ন বেশিরভাগ সময়ই থাকে- আপনার প্রিয় ঔপন্যাসিক কে? প্রশ্নের উত্তরে কেউ কখনও শরৎচন্দ্রের নাম দেন না। হয়ত ভয় করেন এই নাম দিলে নিজে মিডিওকার খাতায় নাম উঠাবেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু কঠিন গলায় শরৎচন্দ্রের নাম বলতে দ্বিধাবোধ করেননি, কারণ তিনি ভালমতোই জানতেন তিনি যাই বলেন না কেন তাকে ‘মিডওকার’ ভাবার কোন কারণ নেই।’ শরৎচন্দ্রের লেখা ‘বাঙালী মেয়েরা চোখের জল ফেলতে ফেলতে’ পড়েছে। হুমায়ূনের লেখা হয়ত একালের তরুণরা হাসতে হাসতে কিংবা কৌতুক করে পড়ছে। তবে চোখের জল আর হাস্যকৌতুকের বিনিময় মূল্যের মধ্যে পার্থক্য অনেক। তুমুল জনপ্রিয় হয়েও শরৎচন্দ্র আজীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস করেছেন। আর হুমায়ূন আহমেদের প্রতি লক্ষ্মীর উদার হস্তের কথা সর্বজনবিদিত। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদ স্মারক গ্রন্থে প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম বলছেন, ‘সেটা ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। ‘অন্যদিন’-এর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘অন্যপ্রকাশ’। ‘সৃজনশীল প্রকাশনার উৎকর্ষের সন্ধানে’ সেøাগানে যাত্রা শুরু ১৯৯৭ সালের একুশের বইমেলায়। শুরু থেকেই নানাভাবে আমরা চেষ্টা করছিলাম কী করে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের বই প্রকাশ করা যায়। সাবের ভাইয়ের সহযোগিতায় আমাদের আগ্রহের কথা জানানো হলো হুমায়ূন আহমেদকে। বই প্রকাশের জন্য তিনি অগ্রিম রয়্যালিটি হিসেবে দশ লাখ টাকা প্রদানের কথা বললেন। আসলে তার বই দেয়ার ইচ্ছে ছিল না বলেই এ রকম কঠিন শর্ত দিয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন ওই পরিমাণ অর্থ সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পেরুনো এই তরুণেরা দিতে পারবে না, তাই এদের বইও দিতে হবে না। পরে তিনি এ কথাটা বহুবার বলেছিলেন।’ এই ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’র খবর সেকালের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পাননি। কালীপ্রসন্ন সিংহ, প্যারীচাঁদ মিত্র, দীনবন্ধু মিত্র, মধুসূদন দত্ত পেরিয়ে বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ হয়ে তিনি তখন গ্রামবাংলার শান্ত সমাজের ব্যবচ্ছেদ করছেন। প্যারীচাঁদ, দীনবন্ধুরা সামন্ত সমাজের ক্ষয়ের দিকটা তুলে এনেছেন। একটি নতুন সমাজ বিকাশের সম্ভাবনা দেখা দেয়া ও তার বিকাশের ধারার সঙ্গে এরপর এলো প্রথম সফল উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য একজন সমাজসচেতন মানুষ, ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দর্শন জ্ঞান-বিজ্ঞানে আলোকিত বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাসে গেছেন মূলত সামন্ত। ‘সাম্য’ বা ‘বঙ্গদর্শন’-এর ক্ষমতাধর লেখক, আধুনিক বুর্জোয়া মানুষটি উপন্যাসে একেবারেই অনুপস্থিত। সেখানে তিনি কথক বা কাহিনীকার। সমাজের বাস্তব বিকশিত রূপ বা গতিশীল ধারাটিকে তিনি সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। তার চরিত্ররা তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবিকশিত। তারা উপন্যাসের শুরুতে যেমন শেষ পর্যন্ত প্রায় তাই থাকে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে সমসাময়িক সমাজ বাস্তবতার চিত্র কেমন? কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলছেন, ‘সমাজের ছবি বেশ ছড়ানো রয়েছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে। বাংলার গ্রামে বর্ণহিন্দু সমাজের অনেক খুঁটিনাটি তার লেখায় বেশ উজ্জ্বল রেখায় উঠে এসেছে। তাদের ছোটলোকামি, তাদের কোন্দল, তাদের রেষারেষি শরৎচন্দ্রের আগে বাংলা উপন্যাসে অনুপস্থিত। কিন্তু এ সমাজ অনড় ও অচল, এর মধ্যে কলহ আছে কিন্তু গতি নেই, এই সমাজ কোলাহলময়, কিন্তু স্পন্দনহীন। শরৎচন্দ্রের প্রেক্ষিত তাই গ্রামবাংলার স্থিরচিত্র। শরৎচন্দ্র আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে একটির পর একটি চরিত্র সৃষ্টি করেন, সমাজের স্থিরচিত্রে সেইসব চরিত্র সমাজের ভেতরকার স্র্রোতধারাকে নিয়ে আসতে পারে না। এ কথা খুবই সত্যি যে, তার গল্পে নির্যাতিত চাষীর সশ্রম পদার্পণ ঘটেছে, কিন্তু তার বিপুল শিল্প সৃষ্টিতে কী শিল্পমানে, কী পরিমাণে তাদের উপস্থিতি গুরুত্বহীন। যেসব সংস্কার এই সমাজে বিশ্বাসের অনুচিত মর্যাদা বলে গৃহীত সেগুলোর অন্তঃসারশূন্যতা ধরতে পারেন না তিনি। বরং তাদের প্রতি তার অনুমোদন রয়েছে। মনু যেসব বিধান দিয়ে গেছেন, বল্লাল সেন যেসব বালাই বাধিয়ে দিয়ে গেছেন তারই মর্যাদা আরও প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হন শরৎচন্দ্র। কিন্তু মনু তো চিরস্থায়ী নন, বল্লাল সেনের রাজত্বের অবসান ঘটেছে অনেক আগে। সমাজ কি ওই আমলেই থাকবে? না আছে? সেইসব বিধান ও সেইসব বালাইকে গৌরব দিতে গিয়ে শরৎচন্দ্র তার চরিত্রকে খাটো করে ফেলেন। বস্তুনিষ্ঠ থাকা আর সম্ভব হয় না। তাই সমাজবাস্তবতা যাকে বলি তা তার ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেল।’ তিনি সম্ভবত ইচ্ছে করেই নিজেকে এর বাইরে রেখেছিলেন। হয়ত জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে বলেছেন, ‘সমাজ সংস্কারের কোন দুরভিসন্ধি আমার নাই। তাই বইয়ের মধ্যে আমার মানুষের দুঃখ বেদনার বিবরণ আছে, সমস্যাও হয়ত আছে, কিন্তু সমাধান নেই। ও কাজ অপরের, আমি শুধু গল্প লেখক, তাছাড়া আর কিছুই নই।’ হুমায়ূন আহমেদ অনেকটা এ রকমই। তার চরিত্ররা জীবনযাপনের মধ্যেই সীমিত। তাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করে না। তিনিও বলেছেন, ‘আমি লিখি নিজের খুশিতে। আমার লেখায় সমাজ, রাজনীতি, কাল, মহান বোধ [!] এই সব অতি প্রয়োজনীয় [?] বিষয়গুলো এসেছে কি আসেনি, তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাইনি। ইদানীং মনে হয়, আমার কোন সমস্যা হয়েছে। হয়তবা ব্রেনের কোথাও শর্টসার্কিট হয়েছে। যে কোন লেখায় হাত দিলে মনে হয় চেষ্টা করে দেখি, সময়টাকে ধরা যায় কিনা। ‘মধ্যাহ্নে’ও একই ব্যাপার হয়েছে। ১৯০৫ সালে কাহিনী শুরু করে এগোতে চেষ্টা করেছি। পাঠকরা চমকে উঠবেন না। আমি ইতিহাসের বই লিখছি না। গল্পকার হিসেবে গল্পই বলছি। তারপরও ...’। বোঝা যাচ্ছে জনপ্রিয়তা ধরে রাখার ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক তিনি। ভুলেও যেন পাঠক ঘোর লাগা থেকে ছুটে না যায় সে জন্য উদগ্রীব হয়ে বলে রাখেন- ‘চমকে উঠবেন না।’ তবে শেষদিকে সময়কে ধরার ইচ্ছেটা সম্ভবত উঁকি দিচ্ছিল তার মধ্যে। যেসব বিষয় নিয়ে ‘মাথা ঘামাইনি’ বলেছিলেন তা নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছিলেন হয়ত। সময়কে ধরার চেষ্টা থেকে ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে তিনি ফিরে যান উনিশ শ’ পাঁচে। মৃত্যুর এত বছর পরও জনপ্রিয় শরৎচন্দ্র যেভাবে বেঁচে আছেন হুমায়ূন আহমেদের পক্ষে কি সম্ভব অতটা দীর্ঘায়ু হওয়া? কি জাদু ছিল তার হাতে? রহস্য জানতে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় হাজির হয়েছিলেন শরৎচন্দ্রের দ্বারে। কথাসাহিত্যিক শংকর জানাচ্ছেন সে কথাÑ‘কয়েকদিন ঘুরিয়ে শরৎচন্দ্র অবশেষে তরুণ লেখককে মন্ত্রগুপ্তি দিয়েছিলেন-লিখে যদি টিকে থাকতে চাও এবং টু পাইস করতে চাও, তা হলে কখনও মা লক্ষ্মীদের চটিয়ো না। রসিক শরদিন্দু বহু বছর পরে আমাকে একবার চুপিচুপি বলেছিলেন, এই উপমহাদেশে সাকসেসফুল লেখক হওয়ার টিপটা টপ সিক্রেট! মেয়েরা যা পছন্দ করে এদেশের পুরুষরাও শেষ পর্যন্ত তাই মনেপ্রাণে গ্রহণ করে থাকে, আর সেটা বুঝেছিলেন বলেই শরৎচন্দ্র অপরাজেয়।’ এ মন্তব্য হয়ত শংকর তার স্বভাবসুলভ রসবোধ থেকে করেছিলেন। তবে জনপ্রিয়তার কারণ যাই হোক, প্রতিটি ভাষায় সৃজনশীল বা সিরিয়াস ধারার সাহিত্যের পাশাপাশি জনপ্রিয় ধারার সাহিত্য থাকাও জরুরী। সাহিত্যের সুষম বিকাশের জন্য।
×