ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর পলাতক তিন খুনী পাকিস্তানী পাসপোর্টধারী

প্রকাশিত: ২২:৫৫, ১৮ আগস্ট ২০২০

বঙ্গবন্ধুর পলাতক তিন খুনী পাকিস্তানী পাসপোর্টধারী

শংকর কুমার দে ॥ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত পলাতক পাঁচ খুনীর মধ্যে যে তিনজনের হদিস করা যাচ্ছে না তারা ব্যবহার করছে পাকিস্তানী পাসপোর্ট। যেই তিন খুনী পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়েছে তারা হচ্ছে লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম, রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেম উদ্দিন। পাকিস্তানী নাগরিকত্ব গ্রহণ করে পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়েছে তারা। পাকিস্তানী পাসপোর্ট গ্রহণকারী তিন খুনীকে সহায়তা দিচ্ছে পাকিস্তান সরকার। পাকিস্তানী পাসপোর্ট ব্যবহার করার কারণেই কোন দেশে তারা আত্মগোপন করে আছে তার হদিস করতে পারছে না সরকার। সরকারের নীতি নির্ধারক মহলের এমনটাই দাবি। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় সূত্রে জানা গেছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শোক দিবস পালনের প্রাক্কালে পলাতক পাঁচ খুনীকে ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করেছে সরকার। পলাতক পাঁচ খুনীর মধ্যে মেজর (বরখাস্ত) আবু মোহাম্মদ রাশেদ চৌধুরীর অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রে ও মেজর (বরখাস্ত) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করার খবরটি জেনে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা হয়েছে। রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীকে আইন প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনার জন্য কূটনৈতিক প্রক্রিয়া জোরদার করায় তাদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছে সরকার। কিন্তু পলাতক অপর তিন খুনীর সঠিক অবস্থান জানা না থাকায় বছরের বছর ধরে অন্ধকারে রয়েছে সরকার। পলাতক তিন খুনী রশীদ, ডালিম, মোসলেম উদ্দিন কোন দেশে আত্মগোপন করে আছে তা জানার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের কূটনীতিকদের। এমনকি বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের সাহায্য-সহযোগিতা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান সমন্বয়ক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেছেন, রশীদ, ডালিম, মোসলেম উদ্দিন- পলাতক এই তিন খুনী পাকিস্তানী পাসপোর্ট ব্যবহার করায় তারা সঠিক কোন দেশে অবস্থান করছে তা খুঁজে বের করতে দেখা দিয়েছে জটিলতা। পাকিস্তান তাদের শেল্টার দিচ্ছে। ফলে সরকার তাদের অবস্থান জানলেও বলতে পারছে না। ফেরানোর কোন উদ্যোগও নিতে পারছে না। এমনকি আন্তর্জাতিক পুলিশী সংস্থা- ইন্টারপোলও পলাতক তিন খুনীর অবস্থান অবহিত। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বর্তমান অবস্থান নিয়ে বলতে গিয়ে এমন তথ্য জানিয়েছেন ওয়ালিউর রহমান যিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে দীর্ঘদিন খুনীদের ফিরিয়ে আনতে কাজ করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, খুনী এ এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং এনএইচএম বি নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছে- এটা জানেন মোটামুটি সবাই। অপর তিনজন খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন এখন কোথায় সেটা অনেকেই জানেন না। পলাতক তিন খুনীই পাকিস্তানী পাসপোর্ট ব্যবহার করছে। এর মধ্যে ডালিম কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে আছে। আর রশিদ ও মোসলেম উদ্দিন আছে লিবিয়ার বেনগাজিতে। গাদ্দাফি জীবিত থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর এই খুনীদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। এরা দু’জন পাকিস্তান-বেনগাজি নিয়মিত আসা-যাওয়া করে- এমনটাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্মকর্তার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, চার মাস আগে ভারতীয় কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রচার হয়, ভারতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মোসলেম উদ্দিন। কিন্তু ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে তার আটকের খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেনি। এমনকি বাংলাদেশকেও কিছুই জানায়নি। ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা অফিসের প্রধান (এনসিবি) ও পুলিশের সহকারী উপ-মহাপরিদর্শক (এআইজি) মহিউল হক বলেছেন, গণমাধ্যমেই আমরা বঙ্গবন্ধুর খুনী মোসলেম উদ্দিনের গ্রেফতারের বিষয়টি জানতে পারি। এরপর আমরা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভারতীয় এনসিবির কাছে চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু গত চার মাসেও আমরা ওই চিঠির কোন জবাব পাইনি। এমনকি কিছুদিন আগেও আমরা তাগাদা দিয়ে আরেকটি চিঠি দিয়েছি। কিন্তু সে চিঠিরও কোন জবাব পাইনি। ফলে আমরা নিশ্চিত নই আসলে মোসলেম উদ্দিন গ্রেফতার হয়েছে কিনা তা জানা যায়নি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আমরা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি, মোসলেম উদ্দিন গ্রেফতার হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান সমন্বয়ক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমানও বলেছেন, মোসলেম উদ্দিন ভারতে থাকার কোন তথ্য তার কাছেও নেই। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনী আবদুর রশীদ পাকিস্তানের পাসপোর্ট ব্যবহার করছে এটা ধারণা করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। কারণ বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করলে নবায়নের জন্য তাকে আবেদন করতে হতো। বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পর খুনীদের শেল্টার দিয়েছে তখনকার পাকিস্তান সরকার। ধারণা করা হয়, রশিদ পাকিস্তান বা আফ্রিকার কোন দেশে পালিয়ে আছে তবে এর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনী ডালিমও পাকিস্তানের পাসপোর্ট ব্যবহার করছে বলে মনে করা হয়। কারণ রশীদ, ডালিম ও মোসলেম উদ্দিন একই সময়ে পাকিস্তানে অবস্থান করেছে। তবে ১৯৯৫ সালে কেনিয়াতে রাষ্ট্রদূত থাকাকালে অবসরে যায় ডালিম। বর্তমানে তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার। পাকিস্তান, লিবিয়া বা স্পেনে থাকতে পারে ডালিম। ড. এ কে আবদুল মোমেন ভার্চুয়াল সভায় বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর পাঁচজন খুনী এখনও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পলাতক আছে। আমরা এরই মধ্যে দু’জনের অবস্থান জানতে পেরেছি। এসব খুনীর অবস্থান নির্ণয় ও দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকরে সহায়তার জন্য সকল বন্ধুরাষ্ট্রের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এসব খুনীকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। প্রসঙ্গত, জাতির পিতার হত্যা মামলার রায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ১২ আসামির মধ্যে পাঁচজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয় ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারিতে। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে যে পাঁচজনের মৃত্যুদ-াদেশ কার্যকর করা হয় তারা হচ্ছে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার), এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিনের (আর্টিলারি)। এরপর মুজিববর্ষে গত ১১ এপ্রিল ফাঁসি কার্যকর করা হয় ক্যাপ্টেন (অব) আবদুল মাজেদের। আবদুল মাজেদ ভারত থেকে পালিয়ে ঢাকায় আসার পর গ্রেফতার হওয়ার পর তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ২০০১ সালের জুনে পলাতক অবস্থায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত অপর আসামি মেজর (অব) আবদুল আজিজ পাশা মারা যায় জিম্বাবুইয়েতে। পলাতক পাঁচ খুনীর মধ্যে ২ খুনী রাশেদ চৌধুরী আছে যুক্তরাষ্ট্রে এবং কানাডায় আছে নূর চৌধুরী। অপর ৩ খুনীর অবস্থান খুঁজে বের করতে রেড নোটিস জারির পর তা নবায়ন করেছে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল। ২০০৯ সালে এই নোটিস জারির পর পাঁচ বছর পরপর নবায়ন করা হচ্ছে। শোকের মাস আগস্টে, বিদেশে পলাতক খুনীদের ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিকভাবে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া জোরদার করতে কাজ করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সরকার গঠিত টাস্কফোর্স।
×