ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মামলা হয় না ৮০ ভাগ দুর্ঘটনায় ২/৩ ভাগ মামলায় দ্রুত রায় হলেও আইনী জটিলতায় বাস্তবায়ন ঝুলে যায়

দুর্ঘটনায় ৯০ ভাগ মামলায় শাস্তি হয় না ॥ নিরাপদ হয়নি সড়ক মহাসড়ক

প্রকাশিত: ২২:৫২, ১৮ আগস্ট ২০২০

দুর্ঘটনায় ৯০ ভাগ মামলায় শাস্তি হয় না ॥ নিরাপদ হয়নি সড়ক মহাসড়ক

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দেশজুড়ে নানা আলোচনা সমালোচনা হলেও বাস্তবে তা কমেনি। কোন বছর কিছুটা কম থাকলেও পরবর্তী বছর বাড়ছে। গতানুগতিক মামলা ও দায়সারা গোছের প্রতিবেদনের কারণে সড়ক দুর্ঘটনার ৯০ ভাগ মামলার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়না। সাধারণ মামলা সব সময়ই কম গুরুত্ব পায়। দুই থেকে মাত্র তিন ভাগ আলোচিত মামলার ক্ষেত্রে অপরাধীরা সাজা পেলেও নানা রকম আইনী জটিলতায় অনেক সময় এর বাস্তবায়ন কঠিন হয়। নি¤œ আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত ঘুরতে ঘুরতে বিচারপ্রার্থীরা এক সময় ক্লান্ত হয়ে নিরুৎসাহিত হন। ফলে মামলা তদারকি কমে যায়। প্রকৃত অর্থে সুবিধা পায় অপরাধীরা। তাছাড়া ৮০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনায় কোন মামলা হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করার পাশাপাশি সড়কে সব রকমের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করতে হবে। সড়ক নির্মাণে সঠিক ডিজাইন নিশ্চিত করতে হবে। আনফিট যান চলাচল বন্ধের পাশাপাশি মহাসড়কে স্বল্প গতির নিষিদ্ধ যান চলাচল যে কোন মূল্যে রোধ করতে হবে। কম গতির যান চলাচলে পৃথক লেন মহাসড়কগুলোতে নির্মাণ জরুরী। সেই সঙ্গে যেসব রুটে রোড ডিভাইডার নেই সেখানে তা নির্মাণ করতে হবে। ফলে মুখোমুখি সংঘর্ষ কমবে। এসব কিছু বাদ রেখে মুখের কথায় ম্যাজিকের মতো সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসার সম্ভাবনা নেই বলেও মনে করেন তারা। এদিকে নতুন করে সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করার পর বাধার মুখে পড়ে সরকার। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের আপত্তিসহ তীব্র আন্দোলনের মুখে বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে আটকে যায় আইনের বাস্তবায়ন। গত বছর সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয় আপত্তির বিষয়গুলো নিয়ে গঠিত কমিটি কাজ করবে। তাদের প্রতিবেদন দেয়া শেষ হলে চলতি বছরের এক জুলাই থেকে পুরোপুরি সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর শুরু হবে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে আইনটি পুরোপুরি কার্যকর করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি ব্রিফিংয়ে আইনটি কার্যকর করার তাগিদ দিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আইনটি কার্যকর করতে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সহযোগিতার প্রয়োজন আছে। তাছাড়া সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনে আইনটি কার্যকর করার কোন বিকল্প নেই। যাত্রীকল্যাণ সমিতির সাম্প্রতিক হিসাব বলছে, ৮০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনায় কোন মামলা হয় না। বাকি ২০ শতাংশে মামলা হলেও শতকরা ৯৯ ভাগ আসামি খালাস পেয়ে যায়। গত পবিত্র ঈদ-উল আজহায় সীমিত আকারে যাতায়াত হলেও সড়ক দুর্ঘটনা কমেনি। এবারের ঈদে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ২০১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪২ জন নিহত ৩৩১ জন আহত হয়েছেন। সড়ক, রেল ও নৌ-পথে ২৩৮টি দুর্ঘটনায় ৩১৭ জন নিহত ও ৩৭০ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮৫৫ জন মারা গেছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন ১৩ হাজার ৩৩০ জন। গত বছর সড়ক, রেল ও নৌপথে ৬ হাজার ২০১টি দুর্ঘটনায় মোট ৮ হাজার ৫৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। জানতে চাইলে বুয়েটের এ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আলোচিত কেউ মারা গেলে গণমাধ্যমে খবর আসে। ফলে সব খানে বিষয়টি আলোচিত হয়। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে মিডিয়াতে আসে না। ফলে সব সময় আলোচিত দুর্ঘটনার খবর গুরুত্ব পায়। এতে দেখা যায় সাধারণ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে তদন্ত প্রতিবেদন দুর্বল হয়। তিনি বলেন, সকল দুর্ঘটনায় দায়ীদের আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। আইনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সাজা নিশ্চিত করা না গেলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হতে পারে। তিনি বলেন, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসার পাশাপাশি চালকরা বেশি সচেতন হবেন। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগের পরামর্শ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, সড়কে প্রকৌশলগত বিষয়গুলো দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে অনেকটা সহায়ক। দুর্ঘটনা রোধে সড়কে যেসব পদক্ষেপ নিশ্চিত করা জরুরী তা যে কোন মূল্যে করতে হবে। অন্যথায় ম্যাজিকের মতো সড়ক নিরাপদ হয়ে যাবে এমন ভাবনা ভেবে কোন লাভ হবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে সঠিক তদারকি নেই। কাগুজে বাঘ হিসেবে রয়েছে পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিআরটিএ। জনবল সঙ্কটের মুখে প্রতিষ্ঠানটি যানবাহন শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। তেমনি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তবে নতুন যানবাহনের লাইসেন্স দিয়েই যাচ্ছে। জানতে চাইলে বিআরটিএ একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করছি। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় জাতি সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত সড়কে যে হারে মানুষ মারা যাচ্ছে এবং আহত বা পঙ্গু হচ্ছে, তাতে দেশ জাতীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনায় মামলা হয় না। কিছু মামলা হলেও আইনী দুর্বলতায় বেশিরভাগ আসামি খালাস পেয়ে যায়। এ থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে মামলা হবে, দ্রুত রায় হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তরাও ক্ষতিপূরণ পাবেন। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে একটি বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে মাইক্রোবাস আরোহী তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। দুর্ঘটনার সময় এই গাড়িতেই ছিলেন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর। এই ঘটনায় একমাত্র আসামি ছিলেন বাসের চালক। আলোচিত এই সড়ক দুর্ঘটনার পর সারাদেশে তীব্র আন্দোলন হয়। মামলায় পাঁচটি ধারায় অধিযোগ আনা হয় চালকের বিরুদ্ধে। ২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি চালকের যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় ঘোষণা করে আদালত। এরপর শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের দুই শিক্ষার্থী চাপচাপায় নিহত হওয়ার ঘটনা ও বসুন্ধরায় এক সেনা কর্মকর্তার ছেলে নিহতের ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনা সৃষ্টি করে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে জনসচেতনতা তৈরিতে সেই গাড়ি দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘সড়ক দুর্ঘটনা স্মৃতি স্থাপনা’। আলোচিত এসব ঘটনায় মামলা ও বিচারের বিষয়টি স্পষ্ট হলেও অনেক ঘটনা আড়ালে চলে যায়। মুক্তির গান ও মাটির ময়না চলচ্চিত্রের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্র্রশংসিত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ তখন তার নতুন ছবি ‘কাগজের ফুল’ এর শূটিং শুরুর কাজ করছিলেন। সাংবাদিকতার সাবেক শিক্ষক মিশুক মুনীর তখন টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ‘কাগজের ফুল’ এর লোকেশন দেখতেই তারা মানিকগঞ্জে গিয়েছিলেন। সড়ক দুর্ঘটনায় দুই ব্যক্তিসহ পাঁচজনের মৃত্যর ওই ঘটনা পুরো দেশকে নাড়া দিয়ে যায়। এরপর উচ্চ আদালতে এই ঘটনায় তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেনি আপীল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত। ফলে ক্ষতিপূরণ দিতে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে। মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের মৃত্যু ঘটনায় তার পরিবারকে চার কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ চেয়ে তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদের করা এক মামলায় এই রায় দেয় উচ্চ আদালত। এর আগে ১৯৮৯ সালে মিনিট্রাকের চাপায় দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু নিহত হওয়ার ঘটনায় ২০১০ সালে ২ কোটি ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের রায় দিয়েছিল হাইকোর্ট। তবে এরকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় যাবজ্জীবন দ-িত বাসচালক জামির হোসেন গত এক আগস্ট সকালে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় ডিলাক্স পরিবহনের এই চালক ছিলেন একমাত্র আসামি। নানা আলোচনা সমালোচনা ও পদক্ষেপের পর সড়ক দুর্ঘটনা প্রকৃত অর্থে কি কমেছে। কি বলছেন গবেষকরা। জানতে চাইলে নৌ সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, ৯০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে গতানুগতিক মামলা ও পুলিশ দায়সারা প্রতিবেদন দাখিল করে। ফলে নিহতের পরিবারগুলো বিচার পায় না। মামলা তদন্ত কাজে যারা নিয়োজিত থাকেন তারা একের পর এক ঘটনায় ব্যস্ত থাকেন। ফলে পুরনো ঘটনাগুলো ফাইলচাপা পড়ে। এক পর্যন্ত সেসব ঘটনার দায়সারা গোছের প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তিনি বলেন, ২/৩ ভাগ আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক সাজা হলেও আইনী দীর্ঘসূত্রতার কারণে এর বাস্তবায়ন ঝুলে যায়। এক পর্যায়ে বিচার প্রার্থীরা ক্লান্ত হয়ে তদারকি কমিয়ে দেন।
×