ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জেল গেটে প্রধান তিন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ

সিনহা হত্যার স্পট পরিদর্শন র‌্যাব মহাপরিচালকের

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ১৮ আগস্ট ২০২০

সিনহা হত্যার স্পট পরিদর্শন র‌্যাব মহাপরিচালকের

চট্টগ্রাম অফিস, স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ॥ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকা- নিয়ে মামলার তদন্তে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। তদন্ত সংস্থা র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সোমবার কক্সবাজারে যান এবং সিনহা হত্যার ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে উপস্থিত আগ্রহীদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে সাংবাদিকদের জানান, এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তে যা প্রয়োজন তাই করা হচ্ছে, এর অংশ হিসেবে তিনি নিজে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসেছেন। তদন্তে অগ্রগতি হচ্ছে। অপরদিকে, এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান তিন আসামি ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, কিলার এসআই লিয়াকত আলী ও পুলিশের মিথ্যা মামলার বাদী নন্দ দুলাল রক্ষিতকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এদিকে, সিনহা হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি খাইরুল ইসলাম তদন্ত কার্যক্রমে ব্যস্ততম সময় অতিবাহিত করছেন। ইতোমধ্যে তিনি ঘটনাস্থল এবং টেকনাফ থানা পরিদর্শন করেছেন। এই অবস্থায় এলেন র‌্যাবের মহাপরিচালক। অপরদিকে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির ৪ সদস্য সকাল ১১টায় কক্সবাজার জেলা কারাগারে গমন করেন। কারাগার কর্তৃপক্ষ সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছে, তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমান, চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মোঃ জাকির হোসেন, কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ শাজাহান আলী ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের স্বরাষ্ট্র বাহিনী বিভাগে প্রতিনিধি লে. কর্নেল সাজ্জাদ হোসেন পৃথক পৃথকভাবে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, কিলার এসআই লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেন। তদন্ত কমিটি অপর ৭ আসামিকেও সহসা জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে জানা গেছে। এই ৭ আসামি হলেন বরখাস্ত হওয়া এসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আবদুল্লাহ আল মামুন। এছাড়া অপর ৩ আসামি হলেন হত্যাকা-ের পর পুলিশের দায়ের করা মামলার সাক্ষী মারিশবুনিয়ার মোঃ নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও মোঃ আয়াছ। গত শুক্রবার থেকে এই ৭ জনকে র‌্যাব রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। আদালত তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। এছাড়া অপর তিন প্রধান আসামি প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলী ও নন্দ দুলাল রক্ষিতকেও জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা আছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আসামির তালিকা ৭ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করার পর প্রধান তিন আসামি প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলী ও নন্দ দুলাল রক্ষিতকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। অনুরূপভাবে তদন্ত কমিটির পক্ষে সোমবার প্রধান তিন আসামিকে জেল ফটকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অবশিষ্ট আসামিদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে তদন্ত কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এদিকে, র‌্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সোমবার বিকেলে সিনহা হত্যাকা-ের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি বাহারছড়া মেরিন ড্রাইভ সড়কে পুলিশ তল্লাশি চৌকিতে গিয়ে সরেজমিন পরিদর্শনের পর আশপাশ এলাকার লোকজনের কথা শোনেন। আগ্রহী কিছু ব্যক্তি র‌্যাবের মহাপরিচালককে ওই দিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বক্তব্য দেন। এ সময় র‌্যাব-১৫ এর কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, র‌্যাব পেশাদারিত্ব বজায় রেখে সিনহা হত্যা মামলার নিরপেক্ষ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। তদন্ত কার্যক্রম সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে যা প্রয়োজন, তাই করা হচ্ছে। তদন্তের অংশ হিসেবে র‌্যাবের প্রধান হিসেবে তিনি নিজেই ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসেছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি নিজেই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এই মামলার তদারকি করছি, পেশাদারিত্ব নিয়ে সিনহা হত্যা মামলা তদন্ত কার্যক্রম চলছে। এর আগে বিকেল সাড়ে ৪টা নাগাদ র‌্যাবের মহাপরিচারক হত্যাকা-ের স্পট শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়িতে যান, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। আরও আগে বিকেল ৪টার দিকে তিনি হেলিকপ্টারযোগে কক্সবাজার বিমান বন্দরে পৌঁছান। এরপর যান শামলাপুরে। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন র‌্যাবের মিডিয়া পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহসহ কয়েক উর্ধতন কর্মকর্তা। ঘটনাস্থলে র‌্যাব কর্মকর্তারা সংস্থার মহাপরিচালককে সিনহা গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে প্রাপ্ত প্রয়োজনীয় তথ্যাদি উপস্থাপন করেন। তিনি সেখানে ঘণ্টাখানেক অবস্থান করেন। এরপর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় র‌্যাবের মহাপরিচালক জানান, হত্যাকা-ে তদন্তে অগ্রগতি হচ্ছে। সব বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তদন্ত কমিটি অব্যাহত রেখেছি। ঘটনার সময় সিনহা পুলিশকে লক্ষ্য করে তার নিজ অস্ত্র তাক করেছিলেন কিনা জানতে চাওয়া হলে, তিনি জানান, এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তে সব কিছু বেরিয়ে আসবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ৩১ জুলাই রাত অনুমান সোয়া ৯টার দিকে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে বাহারছড়া শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে গুলি করে হত্যা করেন বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকত আলী। হত্যার সময় সিনহার নিজ গাড়িতে ছিলেন সিফাত। এছাড়া হোটেল নীলিমায় ছিলেন অপর দুই সহযোগী শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নুর। হত্যাকা-ের পর শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আদালত তাদের মুক্তি দেয়। সিনহা হত্যাকা-কে নিয়ে দেশব্যাপী রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এমন একটি হত্যাকা- পুলিশ কীভাবে ঘটালো তা নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন জন্ম দিয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে মানব ও মাদকবিরোধী অভিযানের নামে একের পর এক ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভকে পরিণত করা হয় কিলিং জোনে। প্রায় ২২ মাস টেকনাফ থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রদীপ কুমার দাশ ১৪৪টি এনকাউন্টারের ঘটনা ঘটিয়েছেন। এসব ঘটনায় মারা গেছেন ২০৪ জন। এদের মধ্যে অপরাধীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সংখ্যা বেশি হলেও নিরপরাধ অনেককে টাকার জন্য হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে ৩১ জুলাই রাতে কেন হত্যা করা হয়েছে তা নিয়ে মামলার তদন্তের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন ওসি প্রদীপ, কিলার লিয়াকতসহ ১০ জন। এ পর্যন্ত তদন্ত সঠিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। অপরদিকে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তদন্ত কমিটি তাদের তদন্ত কার্যক্রম অনেকাংশে গুছিয়ে এনেছে। আগামী ২৩ আগস্টের মধ্যে কমিটির রিপোর্ট দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রদীপসহ তিন আসামিকে টানা ৮ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ ॥ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ হত্যা মামলার আসামি টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই লিয়াকত আলী ও এএসআই নন্দদুলাল রক্ষিতকে টানা ৮ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি। সোমবার বেলা ১১টায় শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগার ত্যাগ করেছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। তবে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাংবাদিকদের কোন ধরনের ব্রিফ করেনি তদন্ত কমিটি। কক্সবাজার জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক মোকাম্মেল হোসেন জানান, তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোঃ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে সকাল ১১টার দিকে তদন্ত দল কারাগারের ফটকে অবস্থান করেন। এরপর থেকে বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ, এসআই লিয়াকত ও এএসআই নন্দদুলালকে পৃথক পৃথক জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে তদন্ত কমিটির সদস্যরা। দুপুরে কিছুটা সময় বিরতি দিয়ে টানা ৮ ঘণ্টা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তদন্ত দল সন্ধ্যায় কারাগার ত্যাগ করেন। সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি মেজর (অব) সিনহা মোঃ রাশেদ খান হত্যা তদন্ত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গ্রেফতার ওসি প্রদীপসহ ১০ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রথম দিনে কারাগারে থাকা বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ, এসআই লিয়াকত ও এএসআই নন্দদুলাল রক্ষিতকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, মেজর (অব) সিনহা মোঃ রাশেদ খান হত্যার ঘটনায় তদন্ত কমিটি বিশদ পরিসরে তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তদন্তের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে টেকনাফ থানা পুলিশ, বাহারছড়া ফাঁড়ি পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী আর্মড পুলিশের সদস্য, গাড়ি চালকসহ ৬০ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। বৃহৎ পরিসরে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্যই গণশুনানিরও আয়োজন করা হয়। সাংবাদিকদের দেয়া এক ব্রিফিংয়ে কমিটির প্রধান চট্টগ্রাম অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, তদন্ত কার্যক্রম প্রায় শেষের পথে। অবশিষ্ট কার্যক্রম শেষ করে আগামী ২৩ আগস্ট নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই মেজর (অব) সিনহা মোঃ রাশেদ খান হত্যার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জমা দেয়া হবে।
×