ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অর্থ সংস্থানে বন্ড ॥ করোনায় আর্থিক ক্ষতি মোকাবেলায় সচেষ্ট সরকার

প্রকাশিত: ২২:৪৬, ১৮ আগস্ট ২০২০

অর্থ সংস্থানে বন্ড ॥ করোনায় আর্থিক ক্ষতি মোকাবেলায় সচেষ্ট সরকার

রহিম শেখ ॥ বর্তমানে দেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ ঋণের উৎস হিসেবে সরকারের একমাত্র ভরসা সঞ্চয়পত্র ও বাণিজ্যিক ব্যাংক। গত এক বছরে সেই সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে ৭১ শতাংশ। বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যাংক থেকেও অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণে আগ্রহী নয় সরকার। এ অবস্থায় মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থসংস্থানের বিকল্প উৎস হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ‘বন্ড’ বিক্রি বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া মহামারী করোনার ক্ষতি মোকাবেলায় বন্ডের পাশাপাশি ট্রেজারি বিল এবং ওভার ড্রাফট ইস্যু করে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি দেশে রেমিটেন্সে বিনিয়োগ বাড়াতে প্রবাসীদের জন্য তিন ধরনের বন্ড চালু করেছে কেন্দ্র্রীয় ব্যাংক। এছাড়া স্থানীয়দের মতো প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্যও ব্যাংকগুলোতে মাসিক বা ত্রৈমাসিক কিস্তিতে সঞ্চয় স্কিম চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রবাসীদের এমন বিনিয়োগে বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। জানা গেছে, বাজেটে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ৮৪ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু গত অর্থবছর শেষে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। যেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে ৭১ দশমিক ১০ শতাংশ। এটি গত ৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাতে সরকারের ঋণ কিছুটা বেড়েছে। এজন্য সামনের দিনগুলোতে ব্যাংক নির্ভরতা কমাতে সরকার ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রির ওপর বেশি জোর দিচ্ছে। যাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সহজে গবর্নমেন্ট সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করতে পারেন। এতে ব্যাংকগুলোর ওপর সরকারের ঋণের চাপ কমবে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)’র এক গবেষণায় দেখা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোর উন্নয়ন ব্যয় মেটাতে বড় অঙ্কের অর্থ আসে বন্ড থেকে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড। অর্থনীতির বিপর্যয় ঠেকাতে করোনা মহামারীতেও বন্ড বিক্রি কার্যক্রম বাড়িয়েছে ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। অর্থনীতিতে বন্ড বিক্রির পরিমাণ এখন ৬০ হাজার কোটি ইউরোর পরিবর্তে ১ দশমিক তিন পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায় ইসিবি। সংস্থাটি জানিয়েছে, বন্ড বিক্রি কার্যক্রম চলবে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত। অথচ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই তলানিতে। মূলত নীতিমালার অভাবে দেশে এখনও বন্ড মার্কেট তেমন সচল হয়নি, সীমিত আকারে বাজারে চালু রয়েছে। এগুলো লেনদেন হয় প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে। সাধারণের হাতে বন্ড আসার সুযোগ নেই। ইস্যুকৃত অধিকাংশ বন্ড ব্যাংক কর্তৃক ক্রয় ও ধারণ করা হয়। কিছুসংখ্যক ব্যক্তি এবং নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাতেও কিছু বন্ড রয়েছে। ফলে এরাই বাংলাদেশের বন্ড বাজারের প্রধান ক্রেতা। জানতে চাইলে বিআইবিএম’র অধ্যাপক ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জী বলেন, ‘সরকারের তাগিদ অবকাঠামো খাতে প্রচুর বিনিয়োগের। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে চাইলে ব্যাংকের যে ডিপোজিট আছে, তার মেয়াদ স্বল্পকালীন। সেই অর্থ দিয়ে আমরা কখনই এসব ক্ষেত্রে বেশি করে বিনিয়োগ করতে পারব না। এক্ষেত্রে আমরা যদি বন্ড ইস্যু করে দীর্ঘকালীন ফান্ড গ্রহণ করি, সেটা আমরা চমৎকারভাবে ব্যবহার করতে পারব।’ জানা গেছে, দেশে বর্তমানে পাঁচ ধরনের ট্রেজারি বন্ড ও দুই ধরনের কর্পোরেট বন্ড রয়েছে। এগুলোর মেয়াদ ২ থেকে ২০ বছর। এর আগে ১৯৮৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মাত্র তিনটি কর্পোরেট বন্ড ও ১৪ ডিবেঞ্চার ইস্যু করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় বন্ডটি ইস্যু করা হয়েছিল ২০০৭ সালে। এটির নাম ছিল, ‘আইবিবিএল মুদারাবা পারপিচুয়াল বন্ড’; যার পরিমাণ ছিল ৩০০ কোটি টাকা (প্রায় ৪ কোটি ডলার)। এটি ছিল একটি ইসলামিক বন্ড। এই বন্ডে শুধু মুনাফা দেয়া হতো এবং নীতি অনুযায়ী কোন ধরনের সুদের হার ছিল না। বর্তমানে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ২২১টি ট্রেজারি বন্ড তালিকাভুক্ত থাকলেও সেগুলোর লেনদেন হয় না। তালিকাভুক্ত বন্ডগুলোর লেনদেনে কার্যকর কোন ব্যবস্থাও এখন পর্যন্ত বিএসইসির কোন কমিশন নেয়নি। ফলে বন্ড বাজারটি শুধু রয়ে গেছে নীতি নির্ধারকদের প্রতিশ্রুতি আর মুখের বুলিতে। বর্তমানে বাজারে ইসলামী ব্যাংকের ৩০০ কোটি টাকার একটি পারপিচুয়াল বন্ড রয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি দ্য সিটি, যমুনা, ওয়ান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট এ চার ব্যাংকের ৪০০ কোটি করে মোট ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার পারপিচুয়াল বন্ডের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাবে বন্ড মার্কেট বড় হচ্ছে না ॥ বন্ড মার্কেট নিয়ে দেশে সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা নেই। আর এ কারণে বন্ড মার্কেট বড় হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, কোম্পানিগুলো মূলধন সংগ্রহে ব্যাংক ঋণের ওপর অতি বেশি নির্ভরতার কারণে এই বাজার বড় হয়নি। তবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নে বন্ড মার্কেটের বিকল্প আর কিছুই নেই। টাকার অঙ্কে বন্ডের ইউনিট ছোট ও পুঁজিবাজারে লেনদেনযোগ্য হলে বিপুল অর্থের বিনিয়োগ আসবে বন্ড মার্কেটে। কারণ বন্ড হচ্ছে এক ধরনের ঋণচুক্তিপত্র। যার মাধ্যমে কোন কোম্পানি মূলধন ঘাটতি পূরণে অন্য পক্ষের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। উন্নত বিশ্বে পুঁজিবাজারের পাশাপাশি রয়েছে বন্ড মার্কেটের শক্ত অবস্থান। বড় প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য সরকারও বন্ড ছাড়ে। আর বন্ডে নির্ধারিত হারে সুদ পাওয়া যায় বলে সাধারণ শেয়ারের তুলনায় এতে বিনিয়োগ ঝুঁকি নেই বললেই চলে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক শাহজাহান মিনা বলেন, ‘বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থেই কোন বন্ড মার্কেট সেভাবে গড়ে ওঠেনি। যেসব পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে শেয়ার বিক্রির অনুমতি দিচ্ছি তারা কিন্তু ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। তবে এই ঋণের প্রয়োজন হতো না, যদি একই সঙ্গে বন্ড ইস্যু করার কথা বলা হতো।’ বন্ড মার্কেট উন্নয়নের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক ॥ গত বছরের জুনে বাংলাদেশের বন্ড মার্কেট উন্নয়নের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেট ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মোঃ খুরশিদ আলমের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি কর্ম-কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই কমিটি সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, গোটা আর্থিক খাতে কোন ধরনের বন্ডের সম্ভাবনা রয়েছে, তা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বন্ডের বাজার সম্প্রসারণে কী কী প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এবং সেসব প্রতিবন্ধকতা কিভাবে দূর করা যাবে, তা নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। পাশাপাশি কোন কোন বন্ড ব্যবস্থাপনায় কোন কোন নিয়ন্ত্রক সংস্থা তদারকি করবে, সে বিষয়টিও সুস্পষ্ট করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংকগুলোই এখনও ঋণ-সংস্থানের সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে কাজ করছে। এর ফলে একটি পদ্ধতিগত ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। একটি কার্যকর বন্ড মার্কেট এই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়িয়েছে আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সরকারী ও কর্পোরেট দুই ধরনের বন্ডের ওপরই জোর দিতে হবে। সরকারী বন্ডের মধ্যে রয়েছে ট্রেজারি বন্ড, টি-বিল, জাতীয় সঞ্চয়পত্র প্রভৃতি। এসব সিকিউরিটিজের প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি মার্কেটও বিদ্যমান। সেকেন্ডারি মার্কেটে আবার ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি), ট্রেড ওয়ার্ক স্টেশন (টিডবিউএস), জিএসওএম ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম ও সেকেন্ডারি ট্রেডিং ভলিউম অব গবর্নমেন্ট সিকিউরিটিজ অপারেশন রয়েছে। ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিনিয়োগে ব্যাংকে আলাদা বুথ স্থাপনের নির্দেশ ॥ ট্রেজারি বিল ও বন্ড সহজে বিনিয়োগ এবং দ্রুত সেবা প্রদানের সুবিধার্থে প্রত্যেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ‘গবর্নমেন্ট সিকিউরিটিজ বিনিয়োগ উইন্ডো’ নামের আলাদা বুথ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো এবং সরকারী সিকিউরিটিজে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধকরণের লক্ষ্যে এ নির্দেশনা দিল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। আগামী তিন মাসের মধ্যে এ ডেস্ক স্থাপন করতে বলা হয়েছে। চলতি বছরের ২১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই সার্কুলারে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কার্যত সকল তফসিলী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশে নিবাসী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান (যেমনÑ বীমা কোম্পানি, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন ফান্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ইত্যাদিসহ) অনিবাসী ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীগণ সরকারী সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করতে পারে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারী সিকিউরিটিজে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধকরণে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ইতোমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যার ফলে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া মিলেছে। তাছাড়া, সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়ে তথ্য গ্রহণপূর্বক বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। সরকারী সিকিউরিটিজ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্ল্যাটফর্মে লেনদেন শুরু হলে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ অনেক গুণ বেড়ে যাবে। রেমিটেন্স বাড়াতে ভূমিকা রাখছে এনআরবি বন্ড ॥ ‘এনআরবি বন্ডে’ বিনিয়োগের মাধ্যমে পরিশ্রম ছাড়াই বিদেশে বসে বেশি মুনাফা পাওয়ার সুযোগ রেখেছে বাংলাদেশ সরকার। বিদেশে অবস্থান করেন, এমন যে কোন বাংলাদেশী চাইলেই প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগ করে ১২ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা নিতে পারেন। এর সবই বাংলাদেশ সঞ্চয় অধিদফতরের চালু করা বন্ড। ১৯৮৮ সালে চালু হওয়া পাঁচ বছর মেয়াদী ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ২০০২ সালে চালু হওয়া তিন বছর মেয়াদী ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড বিনিয়োগ করে এ সুবিধা পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত এমন তিন বন্ডে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করেছেন প্রবাসীরা। এতে বড় হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ। এসব বন্ড পাওয়া যায় বিদেশী এক্সচেঞ্জ হাউস, দেশী ব্যাংকের বিদেশী শাখা ও বাংলাদেশের ব্যাংক শাখায়। আবার এসব বন্ডের বিপরীতে দেশী ব্যাংক থেকে ঋণও পাওয়া যায়। বিনিয়োগকৃত অর্থ চাইলে আবার বিদেশেও ফেরত নেয়া যায়। এসব বন্ডের বিনিয়োগ করে সিআইপি সুবিধা পাওয়া যায়। আবার এই আয়ে করমুক্ত সুবিধাও মেলে। সঞ্চয়পত্র অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড পাঁচ বছর মেয়াদী। এ বন্ডে ২৫ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যায়। মেয়াদ শেষে মুনাফা পাওয়া যায় ১২ শতাংশ। প্রতি ছয় মাস অন্তর মুনাফা তোলার সুযোগ রয়েছে। কেউ যদি ছয় মাসে মুনাফা না তোলে, তবে মেয়াদপূর্তিতে মূল অঙ্কের সঙ্গে ষাণ¥াসিক ভিত্তিতে ১২ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে মুনাফা প্রদান করা হয়। আট কোটি টাকা বা তার চেয়ে বেশি বিনিয়োগ করলে সিআইপি সুবিধা পাওয়া যাবে। প্রবাসী ছাড়াও এ বন্ড কিনতে পারেন বিদেশে লিয়েনে কর্মরত বাংলাদেশী সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসে কর্মরত সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, যারা বৈদেশিক মুদ্রায় বেতন-ভাতা পান। মুনাফার হার বেশি হওয়ায় প্রবাসে অবস্থান করা বেশির ভাগই এ বন্ড ক্রয় করছেন। ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড চালু তিন বছর মেয়াদী। এ বন্ডে ৫০০ ডলার থেকে ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যায়। মেয়াদ শেষে মুনাফা সাড়ে ৭ শতাংশ। প্রতি ছয় মাস অন্তর সরল সুদে মুনাফা তোলা যায়। তবে মেয়াদপূর্তির আগে বন্ড ভাঙতে চাইলে ১ থেকে দেড় শতাংশ সুদ কমে যায়। আর ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডও তিন বছর মেয়াদী। এতে সাড়ে ৬ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা পাওয়া যায়। ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রবাসীদের বিনিয়োগের জন্য সরকারের তিন ধরনের বন্ড রয়েছে। ব্যাংকগুলো এ বন্ড বিক্রি করে। এর মাধ্যমে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। প্রবাসীরাও লাভবান হচ্ছেন।’ ব্যাংক থেকেও এনআরবি বন্ড কিনতে পারছেন গ্রাহকরা ॥ এতদিন ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা এনআরবি বন্ডের মুনাফা উত্তোলন ও নগদায়নের সুযোগ পেলেও নতুন করে কেনার পথ বন্ধ ছিল। তবে এখন থেকে গ্রাহকরা ব্যাংকের শাখা থেকে কেনা যাবে প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য চালু করা সব ধরনের এনআরবি বন্ড। চলতি বছরের মার্চে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে এ নির্দেশনা দেয়া হয়। এনআরবি বন্ড সম্পর্কিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিদেশ থেকে প্রেরিত রেমিটেন্সের বিপরীতে প্রবাসীদের বিনিয়োগ এবং সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে এনআরবি বন্ডসমূহের যাবতীয় লেনদেন কার্যক্রম (বিক্রয়/পুনঃবিনিয়োগ, নগদায়ন, কুপন প্রদান) চালু থাকবে। ট্রেজারি বিল এবং ওভার ড্রাফট ইস্যু করেও অর্থ সংগ্রহ ॥ মহামারী করোনায় আর্থিক ক্ষতি সামলাতে ট্রেজারি বিল এবং ওভার ড্রাফট ইস্যু করে অর্থ সংগ্রহ করছে সরকার। গত অর্থবছরে ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নেয়া হয়। এদিকে সরকারকে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণের জোগান দিতে গত ২ জুন নিলাম ডেকেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ২ বছর মেয়াদী ট্রেজারি বন্ডের ওই নিলামে বিড বা আবেদন হয়েছে ১১১টি। এ বিডে সরকারকে ৪ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা ঋণ দিতে চেয়েছে ব্যাংকগুলো। শেষ পর্যন্ত নিলাম কমিটি গ্রহণ করেছে ১৭টি বিড। এ বিডের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ঋণ পেয়েছে ৯৭৫ কোটি টাকা। বাকি ২ হাজার ২৫ কোটি টাকাই নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুই বছর মেয়াদের এ ট্রেজারি বন্ডের সুদহার (ইল্ড) ছিল ৭ দশমিক ৮ শূন্য শতাংশ। রেমিটেন্স বিনিয়োগে আনতে সঞ্চয় স্কিম চালু ॥ প্রবাসীদের পাঠানো কষ্টার্জিত অর্থের একটি অংশ দেশের উৎপাদনশীল খাতে আনতে একটি উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য ‘সঞ্চয় স্কিম’ চালুর সুযোগ করে দিতে প্রথমবারের মতো এই উদ্যোগ নেয়া হলো। এখন থেকে ব্যাংকগুলোতে মাসিক কিংবা ত্রৈমাসিক কিস্তিভিত্তিক এই সঞ্চয় স্কিম খুলতে পারবেন প্রবাসীরা। সঞ্চয় স্কিমের মেয়াদ এক বছর বা তার বেশি হতে পারবে। এই সঞ্চয় স্কিমের স্থিতি জামানত রেখে ঋণ নেয়ারও সুযোগ পাবেন প্রবাসীরা। বিশেষ প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি সাপেক্ষে জমানো টাকা বিদেশেও নেয়া যাবে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করা হয়। ওই সার্কুলারে দেশে বসবাসকারী স্থায়ী বাসিন্দাদের মতো প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্যও ব্যাংকগুলোতে মাসিক বা ত্রৈমাসিক কিস্তিভিত্তিক সঞ্চয় স্কিম চালুর অনুমতি দেয়া হয়েছে। বৈধ চ্যানেলে পাঠানো অর্থের বিপরীতে এ ধরনের হিসাব খোলা যাবে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হুমায়ুন কবির জনকণ্ঠকে বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশীদের কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগে আনতে এবং তাদের ভবিষ্যত নিরাপত্তার স্বার্থে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর ফলে প্রবাসীরা দেশে আরও বেশি রেমিটেন্স পাঠাতে উৎসাহী হবেন। তিনি বলেন, প্রবাসীদের জন্য যে তিন ধরনের বন্ড চালু আছে, তাতে যারা বেশি রেমিটেন্স পাঠান তারাই বিনিয়োগ করে থাকেন। যারা অল্প রেমিটেন্স পাঠান তারা বিনিয়োগ করেন না। এই ছোট রেমিটারদের জন্যই নতুন এই উদ্যোগ। উদাহরণ দিয়ে হুমায়ুন কবির বলেন, ধরা যাক একজন প্রবাসী সৌদি আরব থেকে প্রতি মাসে ২৫০ ডলার দেশে পাঠান। সেখান থেকে ২০০ ডলার যার নামে পাঠিয়েছেন তিনি তুলে পরিবারের প্রয়োজনে খরচ করলেন। বাকি ৫০ ডলারের সমপরিমাণ টাকা সঞ্চয়ী হিসাবে প্রবাসীর এ্যাকাউন্টে জমা থাকল। সেই সঞ্চয় থেকে তিনি মাসে মাসে মুনাফা বা সুদও পাবেন। গ্রাহকরা ব্যাংকে যেমন ডিপিএস খোলেন, ঠিক সেরকম। এতে ব্যাংকগুলোরও একটা সুবিধা হবে, তাদের ডলারের সরবরাহ বাড়বে। প্রবাসীদের এই আমানত বা সঞ্চয়ের সুদের হার কত হবে- জানতে চাইলে হুমায়ুন কবির বলেন, এটা ব্যাংকগুলো নির্ধারণ করবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে, এই সঞ্চয় স্কিমের সুদের হার যেন অবশ্যই অন্য আমানতের সুদের হারের চেয়ে বেশি হয়।
×