ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুর্তজা বশীরের প্রস্থান

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ১৮ আগস্ট ২০২০

মুর্তজা বশীরের প্রস্থান

নন্দনতত্ত্বের এক দুঃসাহসী পথিকৃৎ মুর্তজা বশীরের চিরতরে চলে যাওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। শিল্পকর্মের অনন্য সৃজনকর্তা রঙতুলি আর পাথরের চমৎকার সংমিশ্রণে সৃষ্টির যে ব্যঞ্জনা তুলেছিলেন তার চিরস্থায়ী নান্দলিক রূপ ক্ষণস্থায়ী জীবনের মতো নয়। সঙ্গত কারণেই সৃষ্টিশীল সাধকরা কখনও চিরবিদায় নেন না। কালের সাক্ষী হয়ে যুগ থেকে যুগান্তরে তার নন্দনতত্ত্বকে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে থাকেন। শিল্পী মুর্তজা বশীরও তেমন মাপেরই একজন অঙ্কনযোদ্ধা যিনি তার সাবলীল চিত্রকর্মে দেশ, মাটি, মানুষ আর সংগ্রামী ঐতিহ্যকে চির অম্লান করে রাখবেন। ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট জন্ম নেয়া এই কালজয়ী শিল্পী ৮৭ বছর বয়সে ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট মারা যান। এক ঐতিহ্যিক পারিবারিক বলয়ে জন্ম নেয়া মুর্তজা বশীর বহু ভাষাবিদ ডক্টর মোঃ শহীদুল্লাহর কনিষ্ঠতম সন্তান। অনাকাক্সিক্ষত পাক-ভারত কর্তনের চরম দুঃসময়ে এই গুণী ব্যক্তিত্ব তার শিক্ষাজীবনের পথ চলায় চিত্রকর্মের প্রতি আবিষ্ট হয়ে পড়েন। দেশের চিত্রশিল্প যাদের হাত দিয়ে তার বহুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে মুর্তজা বশীর সেই প্রজন্মেরই একজন পথিকৃৎ শিল্পী। যার দীর্ঘ বর্ণাঢ্য অঙ্গনে ঐতিহ্যিক শিল্পদ্যোতনায় যেভাবে পরিপূর্ণ হয়েছে তেমন গতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন হরেকরকম ঐতিহাসিক আন্দোলন ও লড়াকু অভিঘাতে। শিল্পচর্চা আর প্রতিদিনের জীবনপ্রবাহ অবিচ্ছিন্ন সূত্রে গাঁথা পাশাপাশি সাধারণ মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাপঞ্জিও তাকে অনুক্ষণ প্রাণিত করত। দেশে চারুকলা চর্চার প্রথম প্রজন্মের এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জীবনভর শৈল্পিক অঙ্গনে বিচরণকারী এক অপরাজেয় স্রষ্টা, যিনি সময়ের গ-ি পেরিয়ে আরও বহুদূর যাত্রায় নিজের মহিমাকে অম্লান করে যাবেন। দৃঢ়চেতা, আত্মপ্রত্যয়ী আর জীবনবোধের নিবিষ্ট কারিগর বাঁচার সাহস আর প্রেরণা পেতেন আপন কর্মনৈপুণ্যের বহুমাত্রিক সাধনায়। অনুপ্রাণিত হতেন পিতা বহু ভাষাবিদ ড. মোঃ শহীদুল্লাহর বর্ণাঢ্য জীবন থেকে। খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের অকৃত্রিম যোগাযোগ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুনীতি কুমার এবং যতীন্দ্র মোহন বাগচির সঙ্গে বাবার পরিচয় তাকে অল্প বয়স থেকে বিমুগ্ধ করে দিত। ভ্রমণপ্রিয় এই শিল্পাচার্য অল্প বয়সেই উপমহাদেশের দর্শনীয় জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। ঘুরে বেড়ানোর পরম তৃপ্তি থেকেই চিত্রশিল্পের মনোরম আখ্যানগুলো অন্তস্থলে গাঁথা হয়ে যেত, যা কোন এক সময়ে চারুশিল্পের ভা-ারকে পরিপূর্ণ করতে নিয়ামক শক্তির অবদান রাখে। ‘একুশে পদক’, ‘স্বাধীনতা’ পুরস্কার এমন সব অর্জনের পরও বলা যায় পুরস্কার শিল্পদ্যোতনার যথাযথ প্রাপ্তি নয়। দর্শকপ্রিয়তা গণমুগ্ধ ভক্তের অবারিত ভালবাসাই শিল্পীজীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আর এই সর্বোত্তম অর্জনই তাকে চিরকালের দ্যুতিময় আসনে বসিয়ে রাখবে।
×