ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু ॥ বজ্রকণ্ঠের মহীরুহ

প্রকাশিত: ২২:৩৭, ১৭ আগস্ট ২০২০

বঙ্গবন্ধু ॥ বজ্রকণ্ঠের মহীরুহ

ক’দিন আগে শুরু হয়েছে আগস্ট মাস। শোকের মাস। অন্য এক বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হই এই আগস্টে। কত কিছু মনে হয়। কত কিছু লিখতে ইচ্ছে হয় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। বিচারিক কর্মের বাইরে অবসরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা গ্রন্থাদি পড়ে আরও জানতে চেষ্টা করি বঙ্গবন্ধুর কর্ম, দর্শন ও ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য। আজ এই শোকের মাসে শ্রদ্ধাবনত ও বিনম্র চিত্তে বজ্রকণ্ঠের সাহসী মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর কিছু ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলছি। আমরা জানি, নানা ধ্যান ধারণা ও দর্শন পুষ্ট মানুষ সব সমাজেই রয়েছে। আমাদের সমাজেও অনেক ধরনের মানুষ দেখা যায়। বদমেজাজ, গম্ভীর স্বভাব, প্রাণখোলা চরিত্র- মূলত এসবই সমাজে অনেক ধরনের মানুষের মাঝে দৃশ্যমান। সমাজে এক ধরনের কথা প্রচলিত আছে যে, ‘তিনি একজন ভদ্রলোক কিন্তু খুব রাগী, সৎ মানুষ তো তাই।’ এ কথার অর্থ কি এটিই যে, একজন মানুষ সৎ ও নৈতিক হলেই তাকে গুমরো মুখো হতে হবে বা বদরাগী হতে হবে বা গম্ভীর স্বভাবের হতে হবে? সদালাপী, প্রাণখোলা একজন মানুষ কি সৎ ও নৈতিক হতে পারে না? একজন সৎ ও নৈতিক মানুষ কি বিনয়ী বা ভদ্র স্বভাবের হন না। আসলে ব্যাপারটি এরকম নয়। সাহস ও সততার সঙ্গে ভদ্র ও নম্র স্বভাবের মিলন হতেই পারে। পৃথিবীর প্রায় সব মহামানবের মাঝেই ছিল এই দুটো বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণ। মানব জাতির দিক নির্দেশনার জন্য মহান সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রেরিত ইসলাম ধর্মের নবী, রাসুল বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অবতারদের মধ্যেও এই গুণটি পরিলক্ষিত হয়। ¯্রষ্টার সৃষ্টি একজন মানুষ নিজ চেষ্টায় অনুশীলনে নম্র ও ভদ্র হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে পারে। কিন্তু তারপরও নম্রতা ভদ্রতা মহান সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত একটি বিশেষ গুণ। কারণ, অনেকেই এই গুণ অর্জনে সক্ষম হয় না। আমার বিশ্বাস, কর্মে ও কথায় এর অনুশীলন হয়ে থাকে। সেই কর্ম ও কথা হতে হবে মানবিক ও মানব কল্যাণমুখী। আর এই গুণটি বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মে, কথায়, আদর্শে, দর্শনে। ইতোপূর্বে প্রকাশিত আমার কিছু লেখায় উল্লেখ করেছি যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্বন্ধে কোন কিছু বলতে গেলে বা লিখতে গেলে খুব ভয় হয়। পাছে কোন ভুল করে ফেলি কিনা। কেননা, এই দুই মহান বাঙালী সম্পর্কে বাঙালীরা বা অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর মানুষ এত বেশি আলোচনা, গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন যে, তাঁদের সম্পর্কে কিছু লিখতে গেলেই শুধু মনে হয়, আমি Plagiarism বা লেখা চুরির দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ছি কিনা। তারপরও চেষ্টা করি তাঁদের জীবন দর্শন ও কর্ম সম্ভারে ঘুরে নিজের অর্জিত ভাবনাকে প্রকাশ করতে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তো আমার দেখার প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু জাতির জনক স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। আমার শৈশবে তাঁকে সেই দেখার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর মতো হিমালয়তুল্য একজন মানুষকে মূল্যায়ন করা তো আর সম্ভব নয়। তাই বিভিন্ন লেখকের লেখায় নিবিষ্ট হয়ে তাঁর সম্বন্ধে মনোজগতে সৃষ্ট আমার ভাবনাটিই প্রকাশ করতে পারি মাত্র। মনে পড়ে, ১৯৭০ সালের নবেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধুকে আমার প্রথম স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়। পৈতৃক আবাসস্থল মোহনগঞ্জের লোহিয়ার মাঠে আব্দুল মমিন ও আমার বাবা ডাঃ আখ্লাকুল হোসাইন আহমেদের এক নির্বাচনী সভায়। দীর্ঘদেহী সৌম্য দর্শন বঙ্গবন্ধুকে ঐ বালক বয়সে দেখে আমার মনে হয়েছিল আমাদের নেতা তো চেহারা ছবিতে আইয়ুব খান বা ইয়াহিয়া খানের চেয়ে কম নন। ঐ রকম লম্বা সুদর্শন বাঙালী পুরুষ আমাদের সমাজে আসলেও খুব একটা দেখা যায় না। সেদিনের পর শারীরিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে দ্বিতীয় বার দেখি ১৯৭২ সালে। নাখালপাড়াস্থ সংসদ ভবনে। ৭, মার্চ, ১৯৭১ সালে তাঁকে অন্তর আত্মা দিয়ে সমগ্র বাঙালী জাতি যেভাবে দেখতে পেয়েছিল, আমিও রেডিওতে তাঁর বজ্রকণ্ঠের সেই ভাষণ শুনে খুবই উদ্বেলিত হই। রাজনীতির কবির সেদিনের সেই ভাষণ শুনে আনন্দ অনুভব করছিলাম এই ভেবে যে, আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন তার জবাব ইয়াহিয়া খান দিতে পারবে না। বালক বয়সেই ঐ ভাষণ ও ভাষণে উচ্চারিত সাহসী বচনগুলো আমার মনে এক ধরনের বীরত্বের অনুভূতি সৃষ্টি করে। যদিও রাজনীতির অনেক কিছুই তখন বুঝতাম না। ততদিনে আমার বাবা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে রাজনৈতিকভাবে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন। আমার বাবা তখন নিয়তই ঢাকায় কি হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু কি নির্দেশ দিচ্ছেন এসব আলোচনা করতেন বাসায় কর্মীদের নিয়ে। কর্মীদের দিতেন নির্দেশনা। তখন সেই পরিবেশে আমি আমার ছোট ভাই বোনদের সঙ্গে এসব নিয়ে অনেক কথা বলতাম। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দর্শন, আদর্শ ও বৈশিষ্ট্য জানার আগ্রহ তখন থেকেই। যা হোক, যে কথাগুলো আজ এই পরিণত বয়সে বলতে চাই তা হলো বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন সাহসী, আপোসহীন, সংগ্রামী পুরুষ, ঠিক তেমনি তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক এবং বিনয়ী ও মানবিক স্বভাবের মানুষ। ৭ মার্চের পটভূমী আমরা বাঙালীরা সবাই আজ কমবেশি জানি। ঐ রকম একটি বৈরী ও বৈষম্যমূলক পরিবেশের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রতি কোনরূপ অবজ্ঞার সুরে কথা বলেননি। যদিও তাঁর প্রতিটি কথায় ছিল দৃঢ়তা। বাঙলীর অধিকার নিশ্চিতে অনঢ় প্রতিজ্ঞা। বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতায় ইয়াহিয়া খান সম্বন্ধে বলেছেন- ‘১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পর যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়হিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাঁকে অনুরোধ করলাম, ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা।’ ঐ বক্তৃতায় জুলফিকার আলী ভুট্টো সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু বলেছেন- ‘ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন যে, আলোচনার দরজা বন্ধ নয়, আরও আলোচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করলাম আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ আলোচনা করে শাসনতন্ত্র তৈরি করব।’ ঐ ভাষণে বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খান এর উদ্দেশ্যে আরও বলেছিলেন, ‘টেলিফোনে আমার সঙ্গে তাঁর (ইয়াহিয়া খানের) কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরিবের ওপর আমার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।’ ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো উভয়েই বাঙালীর বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে, এ কথা বঙ্গবন্ধু সম্যক উপলব্ধি করার পরও বক্তৃতার সময় তাদের প্রতি একটিও অশালীন শব্দ বা অবজ্ঞাসূচক শব্দ উচ্চারণ করেননি। যদি তিনি তা করতেনও জনগণ তা স্বাভাবিকভাবেই নিত। কিন্তু শত উত্তেজনার মধ্যেও উত্তাল জনসমুদ্রের সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু Temper lose করেননি। এমন বিরল গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য কেবল পৃথিবীর বড় মাপের মানুষদের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্বের বড় মাপের মানুষদের একজন। বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত তাঁর রাজনীতি ও দর্শন। সেজন্যই এই ধরনের গুণাবলী তাঁর মধ্যে ছিল। যার স্বীকৃতি হিসাবে কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন ‘I haven’t seen Himalayas but have seen Sheikh Mujib. In personality and in courage, this man is the Himalayas. I have thus had the experience of witnessing the Himalayas. Personality শব্দটির অর্থ একটু ব্যাপক। কোন কোন অভিধানে personality কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে it’s a characteristic sets of behaviors’, cognitions and emotional patterns that evolve from biological and environmental factors. বাংলায় বলা যায়, এটি এমন একটি বৈশিষ্ট্য যা ধীশক্তি ও চারিত্র্যিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষের উৎকৃষ্ট উদাহরণ, যা সেই মানুষটি জন্মগতভাবে অর্থাৎ, পরিবার থেকে ও যে পরিবেশে সে বেড়ে ওঠে সেখান থেকেও পেয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মন্তব্যটি শুধু বঙ্গবন্ধুকেই মহিমান্বিত করেনি, ঐ মন্তব্যটি অনিবার্যভাবে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে বাঙালী জাতিকে ও বাংলাদেশকে, যে দেশটির স্বপ্নদ্রষ্টা ও জাতির জনক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর ওপর লিখিত অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। আমার পঠিত অনেক বইয়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী অন্যতম। এ বইটি বাংলাদেশে বহুল পঠিত বইয়ের একটি। বইটি লেখার শুরুতে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যটি এভাবে বিবৃত হয়েছে— বন্ধুবান্ধবরা বলে, ‘তোমার জীবনী লেখ’। সহকর্মীরা বলে, ‘রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলো লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।’ আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।’ বললাম, ‘লিখতে যে পারি না, আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়। আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জনসাধারণের কি কোন কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’ এই বইতে পাকিস্তানের অনেক নেতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। শের-ই-বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল হাশিম প্রমুখের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু অনেক কাজ করেছেন। তাঁদের নীতি আদর্শের সঙ্গে তখনকার রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু অনেক সময়ই সহমত পোষণ করেছেন। তাঁদের তিনি শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন বলে বইটির বহু জায়গায় উল্লিখিত আছে। কিন্তু যে বিষয়টি লক্ষণীয় সেটি হলো, যাঁদের সঙ্গে তাঁর আদর্শগত মিল ছিল না যেমন, খাজা নাজিমুদ্দিন, খাজা শাহাবুদ্দিন, ফজলুল কাদের চৌধুরী, বগুড়ার ফজলুল বারী, খুলনার সবুর খাঁন তাঁদের সম্বন্ধেও লিখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু সম্মানের সঙ্গে তাঁদের নাম উচ্চারণ করেছেন। তাঁদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শের কোন মিল ছিল না। কিন্তু তারপরও ব্যক্তিগত কোন বিরোধ ছিল না। তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে বঙ্গবন্ধু কখনও কার্পণ্য করেছেন এ কথা তাঁর শত্রুরাও বলবে না। এটি বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক শিক্ষা। তাঁর ধৈর্যশীল পিতা শেখ লুৎফর রহমানের শিক্ষা। ড. সুনিল কান্তি দে কর্তৃক সম্পাদিত বই ‘বঙ্গবন্ধুর অপ্রকাশিত চিঠিপত্র’ এর ২২৭ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর মরহুম পিতা শেখ লুৎফর রহমানের ৩১.৩.১৯৬২ এর চিঠিটি পড়ে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু তাঁর পিতার নিকট থেকে কি ধরনের ধৈর্যের তালিম পেয়েছেন এবং সেটির চর্চায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাবা লিখছেন- বাবা খোকা, ‘শুরুতেই দোয়া জানিবা। ... তোমাকে আটক করিয়া রাখার অর্থ হইতেছে আমাদের মতন বৃদ্ধ পিতা মাতা, ও নাবালক ছেলে মেয়েদের এবং স্ত্রীর উপর নানারূপ অত্যাচার করা। আমরা উপায়হীন সহ্য করিতে বাধ্য কিন্তু খোদা তায়ালা নিশ্চয়ই সহ্য করিবেন না। চিন্তা করিবা না সব কিছু খোদাতায়ালার উপর নির্ভর। তিনি যাহা করেন মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন। সত্যের জয় হইবেই। ...সব সময় দোয়া করিতেছি এবং খোদার দরগায় প্রার্থনা যে তিনি যেন তোমাদের মঙ্গল করুক। ৮০ বছর বয়সের বৃদ্ধ ব্যক্তির পক্ষে এমন লেখা খুব কঠিন। তাই খুব ধীরে লিখিতে হয় এবং লিখিতে একটু দেরি হয়। তোমার আব্বা।’ চিঠিটি পড়ে বোঝা যায়, একজন অশীতিপর বৃদ্ধ পিতা তাঁর সন্তানের ন্যায্য আন্দোলনের প্রতি কিভাবে দৃঢ় সমর্থন দিয়ে গেছেন এবং তাঁর প্রিয় খোকাকে ধৈর্য ধারণ করার কি শিক্ষাই না দিয়েছেন! পিতার আদর্শ ও শিক্ষায় শিক্ষিত ধৈর্য শক্তিতে বলীয়ান বঙ্গবন্ধু তাঁর কর্মী ও সহকর্মীদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। তৎকালীন ছাত্রনেতা ময়মনসিংহের খালেক নেওয়াজ খান যখন জেলে, তখন ৬/৭/১৯৫২ তারিখে বঙ্গবন্ধু খালেক নেওয়াজ খান সাহেবের মাকে ‘আম্মা’ সম্বোধন করে নিচে উল্লিখিত চিঠিটি লিখেছিলেন- ‘আম্মা, আমার ভক্তিপূর্ণ ছালাম নিবেন। আপনি আমায় জানেন না তবুও আজ লিখতে বাধ্য হচ্ছি। আপনার ছেলে খালেক নেওয়াজ আজ জেলখানায়। এতে দুঃখ করার কারণ নাই। আমিও দীর্ঘ আড়াই বছর কারাগারে কাটাতে বাধ্য হয়েছি। দেশের ও জনগণের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্যই সে আজ জেলখানায়। দুঃখ না করে গৌরব করাই আপনার কর্তব্য। যদি কোন কিছুর দরকার হয়, তবে আমায় জানাতে ভুলবেন না। আমি আপনার ছেলের মতো। খালেক নেওয়াজ ভাল আছে। জেলখানা থেকেই পরীক্ষা দিচ্ছে। সে মওলানা ভাসানী সাহেবের সঙ্গে আছে। আপনার স্নেহের (s/d) শেখ মুজিবুর রহমান’ খালেক নেওয়াজ খানের মাকে ‘আম্মা’ সম্বোধন করে লেখা এই চিঠি থেকে এটি প্রতিফলিত হয় যে, কি মাত্রার সংবেদনশীল মানসিকতার মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সহকর্মীর মাকে নিজের মায়ের স্থানে এনে বঙ্গবন্ধু এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। সিংহ হৃদয়ের মানুষ না হলে সহকর্মীর মাকে মাতৃজ্ঞান করা সম্ভব নয়। আর বঙ্গবন্ধুকে সিংহ হৃদয়বান, সহানুভূতিশীল মায়া মমত্ববোধ সম্পন্ন বিনয়ী অথচ দৃঢ়চেতা হয়ে ওঠার শিক্ষাটা দিয়েছিলেন তাঁর পিতা ও মাতা। মূলত পরিবার থেকেই তিনি এই শিক্ষা পেয়েছিলেন। কারাগারের রোজনামচা বইয়ের ১৭৯ পৃষ্ঠার ২৪ জুলাই ১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধুর লেখা ডাইরির পাতা থেকে উদ্ধৃত কিছু অংশ তুলে ধরছি, যেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর পিতার বৈশিষ্ট্য ও ভাবনা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। বঙ্গবন্ধু লিখছেন- ‘আমার বাবা খুব শান্ত প্রকৃতির লোক। সকল সময়ই গাম্ভীর্য নিয়ে থাকেন। তাঁকে আমরা ভাই বোনরা ছোট্টকালে ভালবাসতাম এবং ভয়ও পেতাম। আমার মা আমাদের না দেখলেই কাঁদতেন। তাঁর মধ্যে আবেগ খুব বেশি। কিন্তু আমার বাবার সহ্যশক্তি অসম্ভব। জীবনে মুখ কালো করতে আমি দেখিনি। বোধ হয় একটু চঞ্চল প্রকৃতির ছিলাম বলে বাবা আমাকেই খুব বেশি স্নেহ করতেন। আব্বা এক জায়গায় লিখেছেন, তোমার গত ১৯/৬/৬৬ এবং ১/৭/৬৬ তারিখের চিঠি দুইখানা গতকাল পাইয়া তোমার কুশল জানিতে পারলাম। তবে আমাদের জন্য যে সব সময় চিন্তিত থাক তাও বেশ বুঝিলাম। কখনও আমাদের জন্য চিন্তা করিবা না, খোদার মর্জিতে আমাদের মতন সুখী লোক বোধ হয় নাই, থাকিলেও খুব কম। আমার সহ্য শক্তিও আছে, বিপদে আপদে কখনও বিচলিত হই না, তাহা তোমার ভালভাবে জানা আছে।’ বঙ্গবন্ধু আরো লিখেছেন- ‘বারবার আমার আব্বা ও মার কথা মনে পড়তে থাকে। মায়ের সঙ্গে কি আবার দেখা হবে? অনেকক্ষণ খবরের কাগজ ও বই নিয়ে থাকলাম কিন্তু মন থেকে কিছুই মুছতে পারি না, ভালও লাগছে না। অনেকক্ষণ ফুলের বাগানের কাজ করেছি আজ। মনে মনে কবিগুরুর কথাগুলো স্মরণ করে একটু শান্তি পেলাম। বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’ পরম সহিষ্ণু পিতার ধৈর্যশীল বিনয়ী ও সাহসী সন্তান ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। আমাদের অনেকের ধৈর্য্য আছে, কিন্তু সাহস নেই। আবার আমরা কেউ বিনয়ী, কিন্তু ধৈর্য বা সাহস কোনটাই নেই। অনেকে আবার সাহসী, কিন্তু তার মধ্যে ধৈর্য বা বিনয়ের অভাব দৃশ্যমান। ধৈর্য, বিনয় ও সাহসের সংমিশ্রণ যার মধ্যে আছে, সাধারণত সেই মানুষটিই সততা ও মানবিকতার পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ধৈর্য, বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা ও সাহসের সংমিশ্রণ ছিল বলেই তিনি একজন সৎ মানুষের প্রতিভূ। পর্বততুল্য ব্যক্তিত্বের একজন মানুষ। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। কবি নির্মলেন্দু গুণের বই ‘মুজিব সমগ্রতে বঙ্গবন্ধুর সততা সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ আছে (পৃষ্ঠা-৫৪), যেখানে তিনি লিখেছেন- ‘আমি মৌলানা শেখ আব্দুল হালিমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বঙ্গবন্ধুকে তো আপনি খুব ছোট বেলা থেকে দেখেছেন। জেনেছেন। তাঁর সম্পর্কে এমন কোন ঘটনার কথা কি আপনি আমাকে বলবেন, যে ঘটনাটি আপনার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল, তাঁর সম্পর্কে ভাবতে গেলে যে ঘটনাটির কথা আপনার খুব মনে পড়ে? যে ঘটনাটি আপনি ছাড়া অন্য কেউ জানে না? মৌলানা হালিম আমার প্রশ্নটি গভীর মনোযোগ সহকারে শুনলেন। তারপর চোখ বন্ধ করে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন। মনে হলো তিনি স্মৃতির সমুদ্রে ডুব দিয়েছেন। আমি চুপ করে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তাঁর কপালে চিন্তার বলিরেখা। ঠোঁট দুটি কাঁপছে তাঁর। তিনি চোখ মেললেন। আধো আলো আধো অন্ধকারে আমি লক্ষ্য করলাম, তাঁর চোখের পাতায় অশ্রু জমেছে। তাঁকে সহজ হতে সাহায্য করে আমি বললাম, কিছু কি মনে পড়ল? আপনার চোখে জল কেন? তিনি বললেন, একটা ঘটনার কথা আমার খুব মনে পড়ে। আর সেই ঘটনাটির কথা মনে পড়লেই আমার কষ্ট হয়, আমার চোখে পানি এসে যায়। আমি তাঁর মুখ থেকে ঐ ঘটনাটি শুনবার জন্য কিছুটা উত্তেজনা বোধ করি। বলি, বলুন শুনি ঐ ঘটনাটির কথা। আমার বিশ্বাস ঐ ঘটনটির কথা, যা আপনি গোপনে বয়ে চলেছেন আপনার বুকের ভিতরে, সেই ঘটনাটির কথা আমার কাছে প্রকাশ করলে আপনার বুকটা হালকা হবে। চলবে... লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান,আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২
×