ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিরিজ বোমা হামলার পনেরো বছর পূর্তি আজ

ক্ষমতার পালা বদল না হলে এতদিনে পাকিস্তান আফগানিস্তান হতো দেশ ॥ থেমে নেই জঙ্গী তৎপরতা

প্রকাশিত: ২১:৫৫, ১৭ আগস্ট ২০২০

ক্ষমতার পালা বদল না হলে এতদিনে পাকিস্তান আফগানিস্তান হতো দেশ ॥ থেমে নেই জঙ্গী তৎপরতা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সিরিজ বোমা হামলার পনেরো বছর পেরিয়ে গেলেও জঙ্গীদের তৎপরতা থেমে নেই। সাঁড়াশি অভিযানের মুখে জঙ্গীবাদের ঝুঁকি কমে এসেছে। তবে পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। হালে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবি, আনসার আল ইসলাম, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও আল্লাহর দলের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এরা অন্যান্য জঙ্গী সংগঠনকে এককাতারে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে। জঙ্গীবাদ নিয়ে কাজ করা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গীবাদের ভীত এতটাই শক্ত যে, আগামী দশ বছর সারাদেশে ধারাবাহিক সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রাখলেও, জঙ্গীবাদ পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হবে না। অভিযানের কারণে জঙ্গীবাদের ঝুঁকির মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। শুধু অভিযান নয়, প্রযুক্তির ক্ষেত্র ও বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীদেরও সঠিক মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। জঙ্গীবাদ ইস্যু সামনে রেখে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে রাষ্ট্রকে। আর নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, সিরিজ বোমা হামলার পর ক্ষমতার পালাবদল না হলে দেশ এতদিনে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক বা সিরিয়ার মতো জঙ্গী অধ্যুষিত দেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিতি পেয়ে যাওয়া বিচিত্র ছিল না। ভবিষ্যতে দেশের জঙ্গীবাদ কোন পর্যায়ে যাবে তা নির্ভর করছে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় কারা থাকছেন, তার উপর। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতা নেয়ার পর দেশে ভয়াবহ জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনাসহ দলের সিনিয়র নেতাদের হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করতেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলা চালায় জঙ্গীরা। দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্য নিয়ে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সিরিজ বোমা হামলায় চালা জেএমবি। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) বেলা এগারোটার দিকে সিরিজ বোমা হামলা চালায় জামা’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ জেএমবি। মাত্র আধঘণ্টার ব্যবধানে দেশের পাঁচ শ’ স্থানে চালানো সেই হামলায় অন্তত ৫ শতাধিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। হামলায় দু’জন নিহত হন। আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। হামলা চালানো হয় হাইকোর্ট, সুপ্রীমকোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, বাংলাদেশে থাকা মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেসক্লাব ও সরকারী আধাসরকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কাছে। পুলিশ সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স শাখার তথ্য মোতাবেক, সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সারাদেশের বিভিন্ন থানায় ১৫৯ মামলা দায়ের করে পুলিশ। এরমধ্যে ১০টি মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। বাকি ১৪৯ মামলায় চার্জশীট দেয়া হয়। এসব মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামি হিসেবে গ্রেফতার হয়েছে এক হাজারের বেশি আসামি। আসামিদের মধ্যে ৩৩৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। আর ২৭ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। পলাতক আসামিদের মধ্যে কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম জেএমবির শীর্ষ নেতা হাত কাটা মাহফুজ। তাকে ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশ ভারত-স্থল সীমান্তের কাছ থেকে গ্রেফতার করে ঢাকায় আনা হয়। পলাতক অন্যদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, জেএমবি বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে গড়ে ওঠে। সিরিজ বোমা হামলার পরেও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করে। এমন সুযোগে ভেতরে ভেতরে আরও বেপরোয়া হয়ে সংগঠিত হতে থাকে জঙ্গীরা। এমন সুযোগে ২০১৭ সালেই চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট ও গাজীপুরে আত্মঘাতী হামলায় ২ জঙ্গীসহ ১৬ জন নিহত ও দুই শতাধিক মানুষ আহত হন। ঝালকাঠিতে বোমা হামলায় নিহত হন সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহমেদ চৌধুরী ও জগন্নাথ পাড়ে। ঝালাকাঠিতে দুই বিচারক হত্যায় ২০০৬ সালের ৩০ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, আব্দুল আউয়াল, মাসুম, খালিদ, সাইফুল্লাহসহ সাত শীর্ষ জঙ্গীর ফাঁসি হয়। আতাউর রহমান সানির বরাত দিয়ে একজন দায়িত্বশীল গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, জেএমজেবি (জাগ্রত মুসলিম জনতা অব বাংলাদেশ) গঠনের সময় মধ্যপ্রাচ্যের একটি মুসলিম দেশ একসঙ্গে ২ কোটি টাকা অর্থায়ন করে। আর সিরিজ বোমা হামলা চালাতে পুরো দেশে নেটওয়ার্ক তৈরিসহ হামলা চালাতে ব্যয় হয়েছিল ১২শ’ কোটি টাকা। এসব টাকার সিংহভাগ এসেছে বিদেশ থেকে। যার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের অনেক এনজিও এরসঙ্গে জড়িত। এছাড়া স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠীও নানাভাবে জড়িত। পুলিশ সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স শাখার তথ্য মোতাবেক, এত কিছুর পরেও থেমে নেই জঙ্গীদের তৎপরতা। ভবিষ্যতে জঙ্গীবাদ কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে তা নির্ভর করছে রাষ্ট্রের পলিসির উপর। জঙ্গীবাদ ইস্যুতে সরকার জিরোটলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে জঙ্গীবাদের ঝুঁকি কমিয়ে প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। জঙ্গীবাদের ঝুঁকি কমাতে রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে। পাশাপাশি পরিবার, পিতামাতা, আলেম-ওলামাসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। যে পর্যায়ে অভিযান চলছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে। এতে করে জঙ্গীরা নতুন করে মাঠপর্যায়ে কাজ করার সুযোগ পাবে না। হালের জঙ্গীরা প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ায় এখাতে আরও মনিটরিং বাড়ানো প্রয়োজন। পুলিশ ও র‌্যাবসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিদেশে থাকা বাংলাদেশীদের উপর নজরদারি বাড়াতে হবে। তারা জঙ্গী হয়ে দেশে প্রবেশ করে জঙ্গীবাদে মদদ দিচ্ছে কিনা সেটি গভীরভাবে মনিটরিং করা প্রয়োজন। এজন্য বিদেশে বাংলাদেশের থাকা অন্তত ১০ দেশের দূতাবাসে জঙ্গীবাদ নিয়ে কাজ করা দক্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা প্রয়োজন। র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম জনকণ্ঠকে বলেন, র‌্যাব সৃষ্টিই হয়েছে জঙ্গী দমনে। তারা সারাবছর ধরেই জঙ্গীবিরোধী অভিযান অব্যাহত রেখেছে। সৃষ্টির পর থেকে এখন পর্যন্ত তারা দুই হাজারের বেশি জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছে। যদিও তাদের অনেকেই জামিনে ছাড়া পেয়ে গেছে। জামিনে ছাড়া জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়াদের আবারও গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। জঙ্গী নির্মূলে র‌্যাব প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে। অভিযানের কারণে জঙ্গীদের শক্তিমত্তা কমে গেছে। তাদের আর বড় ধরনের কোন নাশকতা চালানোর সক্ষমতা নেই। তারপরেও বিষয়টিকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান এবং ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ডিআইজি মোঃ মনিরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, তখন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতার ঘাটতির কারণেই পনেরো বছর আগে জেএমবি জঙ্গীরা সিরিজ বোমা হামলা চালাতে পেরেছিল। সামনের দিনগুলোতে জঙ্গীরা আর তেমন কিছুই ঘটাতে পারবে না। হালে নব্য জেএমবিসহ কয়েকটি জঙ্গী সংগঠনের যতসামান্য তৎপরতা লক্ষ্য করা গেলেও তাদের মধ্যে কোন্দল আছে। নানা কোন্দলে বিভক্ত হওয়া এবং ধারাবাহিক অভিযানের কারণে জঙ্গীদের আর বড় ধরনের কোন নাশকতা চালানোর সক্ষমতা নেই। পুলিশের এন্টি টেররিজম বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মোঃ কামরুল আহসান জনকণ্ঠকে বলেন, জঙ্গীরা এখন প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছে। তারা প্রযুক্তির মাধ্যমে জঙ্গীবাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। সেদিকে আরও নজর দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত আছে। প্রায়ই জঙ্গীরা গ্রেফতারও হচ্ছে। উচ্চশিক্ষিত যুবকদের জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আব্দুর রশীদ জনকণ্ঠকে বলেন, জঙ্গীবাদের তৎপরতা থেমে যায় না। সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়। সর্বশেষ গুলশানে হলি আর্টিজানের ঘটনায় সেটি প্রমাণ হয়েছে। জঙ্গীবাদ বর্তমানে আর মাথা চাড়া দিয়ে ওঠতে পারবে না। তবে জঙ্গীবাদের মতাদর্শ এখনও রয়েছে। আর পেছনে রয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী। জঙ্গী তৈরিতে এ দলটি ছাড়াও পাকিস্তানের মদদ থাকার বিষয়টি দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। তাই জঙ্গীবাদ দমন করতে মতাদর্শগত তৎপরতা চালানোর পাশাপাশি পাকিস্তানের বিষয়ে আরও নজর রাখতে হবে সরকারকে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জঙ্গীবাদ কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে তা নির্ভর করছে দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় কারা থাকছেন, তার উপর। কারণ যুদ্ধাপরাধী বা জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী দল। তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকলে, স্বাভাবিকভাবেই আবার দেশে জঙ্গীবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। সিরিজ বোমা হামলার পর ক্ষমতার পালাবদল না হলে দেশ এত দিনে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক বা সিরিয়ার মতো জঙ্গী অধ্যুষিত দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি পাওয়া বিচিত্র ছিল না।
×