ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মো. শহীদুর রহমান খান

বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় কৃষি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০০:৪৭, ১৬ আগস্ট ২০২০

বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় কৃষি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ

কৃষিই কৃষ্টি। কৃষি কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাংলার আবহমানকালের ঐতিহ্য। আজও দেশের সিংহভাগ মানুষের জীবন ও জীবিকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকে আবর্তন করেই পরিচালিত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম গোপালগঞ্জের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তিনি শৈশব ও কৈশর কাটিয়েছেন মধুমতি নদীর তীরের বিস্তীর্ণ জনপদে। তিনি বাল্যকালেই কৃষিকে অবলম্বন করে আধপেটা-একপেটা কৃষকের দারিদ্র্যপীড়িত জীবনকে খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় শেখ মুজিব টকবগে এক যুবক। দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা দেখে বুভুক্ষু মানুষের অন্নসংস্থানে খাদ্য সংগ্রহ করতে চষে বেরিয়েছেন গ্রামান্তরে। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে দেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে আপোসহীন লড়াই সংগ্রাম করেছেন। তিনি যে অবস্থাতেই থাকতেন সবর্দা শ্রমজীবী তথা কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের কথা চিন্তা করতেন। বঙ্গবন্ধু রচিত বিভিন্ন গ্রন্থে এর বহু প্রমাণ রয়েছে। ১৯৫২ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে চীনে আয়োজিত শান্তি সম্মেলনে অংশ নিতে চীন সফর করেন। সম্মেলনের পাশাপাশি অল্প সময়ে নয়া চীনের অর্থনীতির উন্নয়নের মূলসূত্র অনুসন্ধান করেন। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ, তাদের জীবনযাত্রা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদাগুলো মিটাতে বিপ্লবের পর চীন সরকার কিভাবে কাজ করেছে এবং মানুষের আচরনের পরিবর্তনে কি কাজ করেছে তাও জানার চেষ্টা করেন। সম্মেলনের পাশাপাশি গভীরভাবে চীনকে পর্যক্ষেণ করেন। কৃষকের বাড়ি, শ্রমিকের বাড়ি, তাদের কর্মসংস্থান ও জীবনযাত্রা সবই দেখেন। চীন সরকারের কৃষিনীতি, বাজার ব্যবস্থা, মূল্য নিয়ন্ত্রণের সার্বিক বিষয়ে বিস্তর ধারণা নিয়ে আসেন। বাংলার মানুষকে ক্ষুধা, দ্রারিদ্র্যমুক্ত খাদ্যে শস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর সোনার বাংলার স্বপ্নের ভিত রচনা করেন। তিনি চেয়েছিলেন চীনসহ বিভিন্ন দেশের দ্রুত উন্নয়নের নীতিকে অনুসরণ করে বাংলার কৃষি ও কৃষকের জীবনমান উন্নয়নের। সেই স্বপ্ন নিয়ে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় কৃষি ও সমবায় মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু পশ্চিমাদের দুষ্টচক্রান্তে তা বাস্তবায়ন কার সম্ভব হয়নি। ১৯৫৭ সালে শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দফতরের মন্ত্রিত্ব পেলেও তার চিন্তার বাস্তবায়নের সুযোগ দেয়া হয়নি। তারপর দীর্ঘ শোষন, দুঃসাশনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেন। বঙ্গবন্ধুর জন্য সুযোগ আসে স্বাধীনভাবে দেশের কল্যাণে কাজ করার। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণে কৃষির উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি এবং কৃষকের উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করেন। নবজাতক দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে বঙ্গবন্ধু একের পর এক কৃষিবান্ধব পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলোÑ ভূমি সংস্কার আইন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, সম্পদের সুষম বণ্টন, এক ব্যক্তির নামে সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা জমি নির্ধারণ, অতিরিক্ত জমি ভূমিহীনদের মাঝে বণ্টন, কৃষকদের জন্য সুদমুক্ত ঋণ প্রদান, প্রায় ২২ লাখের অধিক কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসন, কৃষিখাতে ভর্তুকি, বিনামূল্যে কীটনাশক ও সার সরবরাহ, ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মী নিয়োগ, কৃষিপণ্যের বিশেষ করে ধান, পাট, তামাক আখের দাম নির্ধারণ, সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন, বন্যা ও খরার হাত কৃষকের ফসলকে রক্ষা করতে বাঁধ ও সেচ প্রকল্প, সরকারী ইজারাদারি প্রথা বিলুপ্ত, গরিব কৃষকদের জন্য রেশনের ব্যবস্থাসহ কৃষি ও কৃষকবন্ধাব অজস্র কর্মসূচী। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে কৃষি খাতে সর্বোচ্চ ১০১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখেন। বঙ্গবন্ধু তার দূরদর্শী চিন্তায় অনুধাবন করেছিলেন শুধু কৃষকের সাময়িক সমস্যার সমাধান করলে চলবে না। কৃষি ও কৃষকের স্থায়ী উন্নয়নে কৃষিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। তিনি এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ হাতে নিয়ে কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন, সংস্কার, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় মনোনিবেশ করেন। স্বাধীনতার অল্প দিনের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি করেন। বঙ্গবন্ধু গভীরচিত্তে উপলব্ধি করতেন ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে কৃষি শিক্ষা, গবেষণায় যুক্তদের জীবন ও মান উন্নয়নের প্রয়োজন। সেই দূরদর্শী চিন্তা ও কৃষি বিপ্লবকে বাস্তবরূপ দিতে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা প্রদান করেন। এ সময় তিনি সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘শুধু কাগজে-কলমে আর বই পড়েই কৃষি শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে না। বই পড়ে তোমরা যা শিখবে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তা সমন্বয় করবে। যতই লেখাপড়া কর না কেন প্যান্ট-শার্ট-কোট ছেড়ে মাঠে না নামলে কৃষি বিপ্লব হবে না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি অর্থনীতিকে গণমুখী করতে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে নজর দিতে বলেন। সঙ্গে সঙ্গে কৃষিপণ্য উৎপাদনে কৃষকদের মাঝে প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে কৃষি উন্নয়নে জাতীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় পুরস্কারের প্রচলন করেন। কৃষকদের মধ্যে কৃষি ঋণ বিতরণ সহজ করতে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। ১৯৭২-৭৫ শাসন আমলেই তিনি দেশের অর্থনীতিক উন্নয়নে কৃষিবান্ধব প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। বঙ্গবন্ধু সবসময় ভাবতেন সবার আগে মানুষের দরকার খাদ্যের। আর আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে। খাদ্যের নিশ্চয়তা না দিতে পারলে সব উন্নয়ন কার্যক্রম বিফলে যাবে। এই বোধটুকু বঙ্গবন্ধু জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে বাংলার আপাময় জনসাধারণ। ঠিক সেই সময়ে দেশী-বিদেশী মহল তাদের নীলনকশা বাস্তবায়ন করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে ধানম-ির বাসভবনে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। দেশজুড়ে শুরু হয় বিচারহীন অনিয়ম ও অবৈধ দখলদারি। এসব থেকে বাদ যায়নি বঙ্গবন্ধুর সুদক্ষ নিপুণ হাতে সাজানো কৃষি সেক্টরও। স্বাধীনতাবিরোধীরা কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার, অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার ফলে বিগত দিনগুলোতে বিপুল সম্ভাবনাময় কৃষি খাতে উন্নয়নের হাওয়া তো লাগেনি বরং খাদ্যের জন্য দেশ ক্রমশ হয়ে পরে পরনির্ভরশীল। দুঃশাসনের ২১ বছর পর প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্যকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। ততদিনে বাংলার খেটে খাওয়া, নির্যাতিত মানুষ প্রায় ভুলতে বসেছিল খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতিকভাবে উন্নত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নকে। ঠিক সেই সময়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বঙ্গবন্ধুর লালিত ‘সোনার বাংলার’ স্বপ্নকে উজ্জীবিত করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে কৃষি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করেন। খাদ্য-শস্য ও কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুষ্টি উন্নয়ন, মহিলাদের কৃষিতে অংশগ্রহণসহ আপাময় জনগণের দারিদ্র্য দূরীকরণে বিস্তর কর্মসূচী হাতে নেন। কৃষিতে আবার নবজোয়ারের সৃষ্টি হয়। ক্ষমতার পালাবদলে পরবর্তী কয়েকটি বছর আবার কৃষি খাতের উন্নয়ন থমকে থাকলেও ২০০৮ সালে আবারও কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সম্ভাবনার আরও এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
×