ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জবানবন্দীতে খুনী মাজেদ

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে পরোক্ষ মদদ ছিল জিয়ার

প্রকাশিত: ২৩:০২, ১৬ আগস্ট ২০২০

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে পরোক্ষ মদদ ছিল জিয়ার

শংকর কুমার দে ॥ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে যারা খুন করেছে সেই খুনীদের সঙ্গে বঙ্গভবনে দেখা করা, খুনীদের পদোন্নতিদান, বিদেশে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করাসহ খুনের বিচার না করার আশ্বাস দিয়েছেন, খুনের আগে-পরে যোগাযোগ রক্ষা করতেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে খুনের ঘটনার বর্ণনা করেছে খুনী ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদ। খুনী মাজেদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীটি ভিডিও করে রেখেছে গোয়েন্দা সংস্থা। তার দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী, ভিডিও রেকর্ডিংয়ের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হচ্ছে বিশেষ ডকুমেন্টারি। আবদুল মাজেদকে গ্রেফতারের সঙ্গে প্রথম থেকে যুক্ত থাকা এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে আবদুল মাজেদের জবানবন্দীর ওপর ভিত্তি করে নেপথ্যের অজানা কাহিনী নিয়ে লিখছেন একটি বই-এমনটাই গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তার দাবি। ৪৫ বছর আগে ‘৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর খুনের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে আবদুল মাজেদ বলেছে, খুনের ঘটনার পর খুনীরা সবাই আশ্রয় নেয় বঙ্গভবনে। রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের পাশের ভিআইপি স্যুটে (দ্বিতীয় তলা) তারা অবস্থান করত। জেনারেল জিয়াউর রহমান সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করতেন এবং নারকীয় এই হত্যাকাণ্ডের পুরস্কার হিসেবে একটি করে পদোন্নতি, বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে চাকরি দেয়া হয় খুনীদের। আগে থেকেই খুনীরা সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সবকিছুতে হস্তক্ষেপ করতেন। তাদের সব চাহিদা পূরণে দেখভাল করতেন খোদ জেনারেল জিয়াউর রহমান। খুনী মাজেদকে গত ১২ এপ্রিল ঢাকার কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করার আগে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী, ভিডিও রেকর্ডিংয়ে বঙ্গবন্ধু খুনের ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছে তাতে বেরিয়ে এসেছে নেপথ্যের আরও অনেক চাঞ্চল্যকর অজানা কাহিনী। খুনী ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদ জবানবন্দীতে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম এই হত্যাকা-ে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বারবার আড়াল করার চেষ্টা করে বলেছে, খুনীদের দেয়া সব ধরনের সুবিধা ভোগ করে গেছে সে। সেনেগালের রাষ্ট্রদূত করার বিষয়টি তার পছন্দ হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে মাজেদের ইচ্ছানুযায়ী দেশে ফিরিয়ে এনে উপসচিব পদমর্যাদায় বিআইডব্লিউটিসিতে পদায়ন করা হয়। সবশেষ যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ে পরিচালক করা হয় তাকে। জবানবন্দীতে সে বলেছে, খুনী মেজর (বরখাস্ত) শাহরিয়ার এক ব্যক্তির স্ত্রীকে নিয়ে লিবিয়া চলে যায়। মেজর বজলুল হুদা বিয়ে না করেই নারায়ণগঞ্জের এক নারীকে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে সেনা তত্ত্বাবধানে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র তৈরি করে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বর্ণনা করা ওই স্বীকারোক্তিতে মাজেদ উল্লেখ করেছে, অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে খুনীদের সঙ্গে ছিল। এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। রিসালদার মোসলেহউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্য সদস্যদের একে একে গুলি করে হত্যা করে। পরদিন স্টেশন সদর দফতরে গিয়ে স্টেশন কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করে ইউনিটে যোগ দিতে চাইলেও তৎকালীন কমান্ডার কর্নেল হামিদ তাকে যোগদান করতে না দিয়ে বেতার ভবনে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। জবানবন্দীতে মাজেদ বলেছে, ইতিহাসের ওই নারকীয় হত্যাকা-ে তৎকালনীর সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের পরোক্ষ সমর্থন ছিল। হত্যাযজ্ঞ শেষে পরদিন ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমান সকাল ১০টা-১১টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট অডিটোরিয়ামে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সব জওয়ান ও অফিসারকে এ্যাড্রেস করেন। ওইখানে উনি (জিয়াউর রহমান) মটিভেট করেন যে, যে ঘটনা গত রাতে ঘটে গেছে তোমরা সে সব নিয়ে কোনরকম মাথা ঘামাবে না। তোমরা সব চেন অব কমান্ডে ফিরে যাও। সবাই কাজকর্ম কর। এটা জাতির বিষয়, এটা আমাদের বিষয় নয়। জিয়াউর রহমানের বিষয়ে মাজেদ বলেছে, তখন বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সিপাহীও ক্যু’র বিষয়ে জানত না। তাদের তো কোন অফিসারও তাতে জড়িত ছিল না। তবে ওই বেঙ্গল রেজিমেন্টের দু’-তিনজন রিটায়ার্ড অফিসার ছিল। আর বাকিরা ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট, আর্মড কোরের লোক। তিনি (জিয়াউর রহমান) বক্তৃতা দিয়েছেন, মটিভেট করেছেন। সমর্থন না থাকলে আগ বাড়িয়ে উনি করতে যাবেন কেন? রেগুলার ওরাই ডিক্টেক্ট করত সবকিছু। হুকুম চালাত ওইখান থেকে। ওরা যা চাইত তাই উনি করে দিতেন। জবানবন্দীতে মাজেদ বলেছে, উনি (জিয়াউর রহমান) বঙ্গভবনে খুনীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করতেন এবং খুনীরাও তার সঙ্গে ওইখান থেকে যোগাযোগ করতেন ডাইরেক্ট এবং আর্মির চেন অব কমান্ড বলতে কিছু ছিল না। ওরাই চালাত প্র্যাকটিকালি ওইখান থেকে। মাঝখানে সেনা হেডকোয়ার্টারে একবার আমি ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে উনাকে (জিয়াউর রহমান) আমার জন্য একটি সিভিল সার্ভিসের বিষয়ে অনুরোধ করেছিলাম। ইন্টারভিউতে তিনি (জিয়াউর রহমান) প্র্যাকটিকালি এই ক্যু’র বিষয়ে পক্ষপাত সূলভ কথাবার্তা বলছেন। এতে বুঝা গেছে, ক্যু’র সমর্থকদের সঙ্গে উনার (জিয়াউর রহমান) সব ধরনের যোগাযোগ ছিল। পরবর্তীতে যখন বিদেশে যাওয়ার প্রশ্ন এল তখন তিনি (জিয়াউর রহমান) দফায় দফায় বঙ্গভবনে মিলিটারি সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। এগুলো আমরা দূরে থেকে দেখেছি। পরে (জিয়াউর রহমান) বললেন, এখানে (বঙ্গভবনে) যে সমস্ত অফিসার আছে তারা সবাই বিদেশে যাবে। তাদের কাগজপত্র তৈরি করার জন্য তৎকালীন মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার মাশহুর হককে নির্দেশ দেন। ওই সময় আমি বঙ্গভবনে স্কট ডিউটিতে ছিলাম। পরবর্তীতে আমাদের ব্যাঙ্ককে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে যাওয়ার পরই জিয়াউর রহমান সাহেব পুরো ক্ষমতা নিয়ে নেন। কিছুদিন পর আমাদের লিবিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরে আমরা শুনলাম রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে মেরে ফেলা হয়েছে। রিসালদার বলছিল, তার সঙ্গে দু’জন সিপাহীও ছিল। সিপাহীরা তো ওইখানে যাওয়ার কথা নয়। জবানবন্দীতে মাজেদ উল্লেখ করেছে, লিবিয়ায় যাওয়ার পরে বলা হলো সবার ফরেন সার্ভিস হবে। জিয়াউর রহমান ফরেন সার্ভিস দেবেন সবাইকে প্রাইজ হিসেবে। একটা করে প্রমোশনও দিয়ে দেবেন। কিছুদিন পরে (আমার এক্সাট ডেট মনে নেই) জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতিনিধি হিসেবে জেনারেল নুরুল ইসলামকে (শিশু) আমাদের কাছে পাঠানো হয়। কার কার কোথায় ফরেন পোস্টিং হবে সেই চয়েজ নিতেই তিনি গেছেন ওইখানে। ফরেন সার্ভিসে যাদের চাকরি দেয়া হয়েছিল, তাদের সেই যোগ্যতাই ছিল না জানিয়ে মাজেদ বলেছে, উনার (জিয়াউর রহমান) সরাসরি পৃষ্ঠপোষকাতার কারণেই তাদের একটা করে প্রমোশন জাম্পড এবং একটা করে ফরেন প্রাইজ পোস্টিং দেয়া হয়েছিল। তবে ওই অফিসারেরা ফরেন সার্ভিসের জন্য কোয়ালিফাইড ছিলেন না, এমনকি গ্রাজুয়েটও ছিলেন না। তাদের বেশিরভাগই স্বল্পমেয়াদী কমিশনড অফিসার ছিলেন। তাদের (ক্যু’ অফিসারের পরিবার) বঙ্গভবন থেকেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল লিবিয়াতে। অনেকে বিয়ে না করেও তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে চলে গেছে। মেজর শাহরিয়ার এক ভদ্রলোকের স্ত্রীকে নিয়ে চলে যায়। মেজর হুদা নারায়ণগঞ্জের এক মেয়েকে বিয়ে না করেই নিয়ে যায়। পরে এসব কাজের বৈধ কাগজপত্র তৈরি করে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। খুনীদের বঙ্গভবনে অবস্থানের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। তার বিষয়ে মাজেদ বলেছে, আমরা শুনেছি যে উনি (শহীদ খালেদ মোশাররফ) বলেছেন ওই মেজররা শুধু শুধু বঙ্গভবনে বসে থাকবে কেন? তারা চলে আসবে। ইউনিটে চলে আসবে। তারা কমান্ডে ফিরে আসবে। ওইটা তার (খালেদ মোশাররফের) একটা ন্যায্য দাবি। সঠিক দাবি, চেন অব কমান্ড। চেন অব কমান্ড ছাড়া ফোর্স চলে নাকি? তবে শহীদ খালেদ মোশাররফকে যারা শহীদ করছে তাদের পিছনেও ক্যু’ পার্টির সমর্থন ছিল। জিয়াউর রহমান এলে ডাইরেক্ট লিফট দিয়ে দোতলায় উঠে (ভিআইপি সুইট) যেতেন। সেখানেই তাদের কথোপকথন হতো। খুনী মাজেদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বলেছেন, ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিলিং মিশন বাস্তবায়নের বহু আগে থেকেই ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাতায়াত করত। সেরনিয়াবাদের ছোট ছেলে নাসেরের সঙ্গে বাড়ির লনে নিয়মিত ব্যাডমিন্টন খেলত। এ কারণে খুনী চক্র মাজেদকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি রেকি করার বিশেষ দায়িত্ব দেয়। ব্যাডমিন্টন খেলার ছলে সে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যসহ বাড়ির লোকজনের ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখত। মাজেদ মূলত ভারতে আত্মগোপনে থাকলেও বছরের বড় একটা সময় থাকত ইউরোপ-আমেরিকায়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়ো অঙ্গরাজ্যে ছেলের বাড়িতে তার দীর্ঘ সময় কাটে। আমেরিকায় বসবাসকারী মাজেদের ছেলের নাম রিফাত মোরশেদ চৌধুরী। সে সেখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণা করছে। রিফাত চৌধুরী আমেরিকা যাওয়ার আগে বাংলাদেশ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ইলেক্ট্রিক এ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (ইইই) স্নাতক ডিগ্রী নেয়। কিন্তু বুয়েটে পড়াকালীন কেউই তার পিতার পরিচয় জানতে পারেনি। জার্মান, ফ্রান্স ও লিবিয়াতেও সে আত্মগোপনে ছিল দীর্ঘদিন। মাজেদের চার মেয়ের মধ্যে একজন পেশায় চিকিৎসক। সে বর্তমানে ঢাকাতেই থাকে। চাকরি করে মিরপুরে একটি বেসরকারী সংস্থায়। তার স্বামীও ডাক্তার। মাজেদ শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত নয়, কারাগারে চার নেতা হত্যার সঙ্গেও জড়িত ছিল। এ দুটি ঘৃণ্য হত্যাকা-ে সে সঙ্গী হিসেবে পায় আরেক পলাতক খুনী রিসালদার মোসলেহউদ্দিনকে। বিদেশে আত্মগোপনে থাকার সময় রিসালদার মোসলেহউদ্দিনের সঙ্গেও মাজেদের নিয়মিতো যোগাযোগ ছিল। মাজেদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে মোসলেহউদ্দিনের খোঁজে ব্যাপক অনুসন্ধান তৎপরতা চালাচ্ছেন গোয়েন্দারা। এই চাঞ্চল্যকর কাহিনীতে এমন অনেক বিষয় আছে, যা আগে কোনদিন কারও জানা ছিল না। তার জিজ্ঞাসাবাদের পুরো বক্তব্য অডিও-ভিডিও আকারে ধারণ করা হয়েছে। যার ওপর ভিত্তি করে বিশেষ ডুকুমেন্টারি তৈরি করা হচ্ছে। তাকে গ্রেফতারের সঙ্গে প্রথম থেকে যুক্ত থাকা সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জবানবন্দী নিয়ে বই লেখার কাজেও হাত দিয়েছেন। খুনী মাজেদের বক্তব্য যাচাই-বাছাই করতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের তদন্ত হচ্ছে। খুনী মাজেদের জবানবন্দীর সম্পর্কিত পুরো প্রক্রিয়া শেষ হলে এটি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে; যা হবে ইতিহাসের বড় একটি দলিল। সরকারের উচ্চপর্যায়কে সবিস্তারে অবহিত করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদে অভাবনীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে খুনী মাজেদ। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনা থেকে পরবর্তী সময়গুলোর ধারাবাহিক বর্ণনা দেয় সে। এমনকি পলাতক জীবনে বাংলাদেশ থেকে কারা কিভাবে তাকে সহায়তা দেয়াসহ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করেছে, তাদের নাম-পরিচয়ও সে অকপটে স্বীকার করে। তবে মাজেদের স্বীকারোক্তি ও জিজ্ঞাসাবাদ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত অতি গোপনীয় এবং স্পর্শকাতর হওয়ায় এখনই তা জনসম্মুখে আপতত প্রকাশ করা না হলেও অধিকতর যাচাই-বাছাইসহ আরও কিছু কাজ সম্পন্ন করার পর যথাসময়ে তা প্রকাশ করা হতে পারে বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা। প্রসঙ্গত, গত বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনী ও মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকরের আগে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত পাঁচ খুনী এখনও পালিয়ে আছে। তাদের মধ্যে এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী কানাডায় ও এ এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে। অন্য তিনজন খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম ও মোসলেহউদ্দিনের অবস্থান সম্পর্কে সরকারের কাছে নিশ্চিত কোন তথ্য নেই। এছাড়া ফাঁসির দ-াদেশপ্রাপ্ত আরেক আসামি আজিজ পাশা ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যায়। বঙ্গবন্ধুর খুনী মাজেদকে ৮ এপ্রিল সোমবার গভীর রাতে রাজধানীর গাবতলী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২২ থেকে ২৩ বছর ধরে সে কলকাতায় ছিল বলে জানা যায়। খুনী মাজেদ গত ৮ এপ্রিল গভীর রাতে ঢাকার মিরপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর গত ১২ এপ্রিল মধ্যরাত ১২টা ০১ মিনিটে কার্যকর হয় তার ফাঁসি। দীর্ঘ প্রায় ৫ দিন ছিল সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে। জিজ্ঞাসাবাদ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। ৪৫ বছর আগে ‘৭৫ সালের ১৫ আগস্টের খুনের এবং খুনের পরবর্তীতে খুনীদের কুশীলবদের মধ্যে কার কি ভূমিকা ছিল তার বর্ণনা দিয়েছে সে। তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীটির ভিডিও রেকর্ড করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। ফাঁসি কার্যকর করার আগে দীর্ঘ পাঁচদিন ধরে গোয়েন্দাদের নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে ঘটনার আগে-পরের নেপথ্যের চাঞ্চল্যকর কাহিনী। খুনী মাজেদ ছিল কলকাতায়। গত ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল প্রায় ১০টা ৪ মিনিটে পার্কস্ট্রিটের বেডফোর্ড লেনের ভাড়া বাড়ি থেকে বের হয় মাজেদ। ঢাকায় গ্রেফতার হয় ৭ এপ্রিল গভীর রাতে মিরপুরে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ৪৪ বছর ৭ মাস ২৬ দিন পর খুনী মাজেদের ফাঁসি হয়, ১২ এপ্রিল রাতে। তার গ্রামের বাড়ি ভোলায় দাফনের কথা থাকলেও সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও স্থানীয়দের প্রবল আপত্তির মুখে ঝুঁকি নিতে রাজি হয়নি ভোলার প্রশাসন। শেষ পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে দাফনের সিদ্ধান্ত হয়। মাজেদের ফাঁসি কার্যকরের পর তার লাশ কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে দাফন করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার শম্ভুপুরা ইউনিয়নের হোসেনপুর এলাকায়। মাজেদের শ্বশুরবাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে শনিবার রাত ৩টার দিকে তার লাশ দাফন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনীর লাশ সোনারগাঁওয়ে দাফন করার খবর সকালে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সোনারগাঁওয়ে মাজেদের লাশ দাফন করায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ ও লাশ অপসারণের দাবি জানান।
×