ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর

প্রকাশিত: ২৩:০০, ১৬ আগস্ট ২০২০

চলে গেলেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বর্ণাঢ্য এক জীবন। সেই বর্ণিল জীবনে রং-তুলির আঁচড়ে গতিময় হয়েছে দেশের চারুশিল্প ভুবন। সৃষ্টিশীলতার মাধ্যম হিসেবে শুধু ছবি আঁকাই নয়, লিখেছেন উপন্যাস। দীর্ঘদিন অধ্যাপনার পাশাপাশি গবেষণা, অনুবাদ এবং চিত্রনাট্য রচনার কাজটিও করেছেন সুচারুভাবে। স্বদেশের প্রতি দায়বদ্ধতায় অংশ নিয়েছেন ভাষা আন্দোলনে। আপন কীর্তির আলোয় উজ্জ্বল সেই মানুষটি পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। শনিবার সকাল ৯টা দশ মিনিটে বরেণ্য চিত্রশিল্পী ও ভাষাসংগ্রামী মুর্তজা বশীর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। রেখে গেছেন দুই মেয়ে মুনীরা বশীর ও মনিজা বশীর এবং এক ছেলে মেরাজ বশীরসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী, স্বজন ও অনুরাগীকে। অনেকদিন ধরেই হৃদ্রোগ, ফুসফুস ও কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন মুর্তজা বশীর। বৃহস্পতিবার রাতে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে নেয়া হয়। তিনি সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। শুক্রবার তার করোনা পরীক্ষা করা হলে ফল পজিটিভ আসে। এদিন থেকে তার পালস পাওয়া যাচ্ছিল না। শনিবার সকাল ৯টা ১০ মিনিটে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। দুপুর একটায় এভারকেয়ার হাসপাতালে রহমতে আলম সমাজ সেবা সংস্থার ব্যবস্থাপনায় করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে মুর্তজা বশীরে মরদেহের গোসল সম্পন্ন করা হয়। এর পর শবদেহ নিয়ে আসা হয় তার মনিপুরীপাড়ার বাসায়। সেখানেই হাউজিং সোসাইটির ব্যবস্থাপনায় তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর পর বাদ আছর বনানী কবরস্থানে স্ত্রী আমিনা বশীরের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হয় শিল্পীকে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দাফন সম্পন্ন করা হয়। মুর্তজা বশীরের মৃত্যুর সংবাদে শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গনেও নেমে আসে শোকের ছায়া। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, সংস্কৃতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের সভাপতিম-লীর চেয়ারম্যান পান্না কায়সার, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, হাবীবুল্লাহ সিরাজীসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, মুর্তজা বশীরের মৃত্যু দেশের শিল্প ও সংস্কৃতি জগতের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তার সৃষ্টি ও কর্ম তরুণ প্রজন্মের জন্য চিরকাল অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশের চিত্রকলার বিকাশে মুর্তজা বশীর যে অনন্য অবদান রেখেছেন তা ভবিষ্যত প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাবে। শিল্পীর মেয়ে মুনিরা বশীর বলেন, আমার বাবা সুন্দর জীবন যাপন করে গেছেন। যারা তাকে চেনেন, জানেন তারা সবাই শ্রদ্ধা-ভালবাসায় তাকে পরিপূর্ণ করেছেন। তিনি নিজ যোগ্যতায় এই পর্যায়ে এসেছিলেন। তিনি সবসময় বলতেন, কীর্তির মাধ্যমেই মৃত্যুর পরও তিনি বেঁচে থাকতে চান। তাকে বাঁচিয়ে রাখার এই দায়িত্ব নতুন প্রজন্মের। শিল্পীর জীবনকথা ॥ বহু ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ছোট ছেলে মুর্তজা বশীর ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকার রমনায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা গবর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টসে (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট) দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি চারুকলা শিক্ষা শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে প্রথম বিভাগে পাস করেন। ১৯৫৫ সালে নবাবপুর সরকারী স্কুলে ড্রইং শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৬ সালে তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য ইতালির ফ্লোরেন্স যান এবং ১৯৫৮ সালের শেষদিকে লন্ডন হয়ে দেশে ফেরেন। ১৯৭৩ সালের আগস্টে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। এর পর অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেন ১৯৯৮ সালে। চিত্রকলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮০ সালে একুশে পদক পান মুর্তজা বশীর। একই কাজে স্বাধীনতা পুরস্কার পান ২০১৯ সালে। বাংলাদেশে বিমূর্ত ধারার চিত্রকলার পথিকৃৎ শিল্পী মুর্তজা বশীরের ‘দেয়াল’, ‘শহীদ শিরোনাম’, ‘পাখা’, ‘রক্তাক্ত ২১শে’ শিরোনামের চিত্রকর্মগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৮ সালের ২৯ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল ‘লা পার্মান্যান্ট’ গ্যালারিতে মুর্তজা বশীরের প্রথম একক প্রদর্শনী হয়। ১৯৬০-৬১ সাল থেকে লাহোরে বসে তিনি এঁকেছেন সিরিজ ছবি ‘দেয়াল’। ক্ষুব্ধ ও কম্পমান ভঙ্গুর রেখা ও রঙের নানা ক্যারিশমায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ব্যবস্থার কথা। আর ১৯৭৫ সালে আঁকেন ‘শহীদ শিরোনাম’ মুক্তিযুদ্ধে নিহত নাম না জানা শহীদদের উদ্দেশে নিবেদিত চিত্রমালা। এর পর ১৯৭৪ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে ইটের টুকরোর মোজাইকে আঁকেন দেয়ালচিত্র ‘শহীদ বৃক্ষ’। জীবনের নানান প্রান্তে ক্যানভাসে নানা বিষয় নিয়ে এঁকেছেন তিনি। কোন রং-রেখা আলাদাভাবে ব্যবহার না করে শুধু কাগজের টুকরো জোড়া দিয়ে কখনও আবার তৈরি করেছেন নানা কোলাজ। বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার অন্যতম পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী ও ভাষাসংগ্রামী মুর্তজা বশীর পেন্টিং ছাড়াও ম্যুরাল, ছাপচিত্রসহ চিত্রকলার বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন। ফিগারেটিভ চিত্রকলায় স্বতন্ত্র ভাষা তৈরি করলেও ‘জ্যোতি’ ও ‘কালেমা তাইয়্যেবা’ শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ চিত্রমালা তিনি এঁকেছেন। লিনোকাট মাধ্যমে ‘রক্তাক্ত ২১শে’ শীর্ষক তার আঁকা ছবিটি ভাষা আন্দোলন বিষয়ক প্রথম চিত্রকর্ম বলে গণ্য করা হয়। টেরাকোটা, মুদ্রা ও শিলালিপি নিয়েও গবেষণা করেছেন এই শিল্পী। চিত্রকলা ছাড়াও তার বিচরণক্ষেত্র ছিল সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র অঙ্গনে। লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, কবিতা থেকে শুরু করে আত্মজৈবনিক গ্রন্থ। ১৯৬৩ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘কারোয়া’র কাহিনী ও চিত্রনাট্য রচনা করেন। ১৯৬৪ সালে হুমায়ুন কবিরের উপন্যাস ‘নদী ও নারী’র চিত্রনাট্যে আনেন প্রশংসনীয় পরিবর্তন। একই সঙ্গে নদী ও নারী চলচ্চিত্রের শিল্প নির্দেশক এবং প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘ক্যায়সে কাহু’র শিল্প নির্দেশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। লেখক মুর্তজা বশীরের জন্ম হয়েছিল সেই ১৯৫০ সালের কারাবাসে, আর ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় তার গল্পগ্রন্থ ‘কাঁচের পাখির গান’ এবং ১৯৭৬ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ত্রসরেণু’, ১৯৭৯ সালে ‘ ‘তোমাকেই শুধু’, ১৯৮৫ সালে ‘এসো ফিরে অনসূয়া’ ও ১৯৭৯ সালে উপন্যাস ‘আল্টামেরিন’ এবং ২০০১ সালে নির্বাচিত রচনাবলী নিয়ে ‘মুর্তজা বশীর :মূর্ত ও বিমূর্র্ত’ প্রকাশিত হয়। ১৯৪৭ সালে নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন মুর্তজা বশীর। কমিউনিস্ট পার্টি অফিসের জন্য মার্কস-অ্যাঙ্গেলস-লেনিনের ছবি আঁকতে আঁকতে অঙ্কনে হাতেখড়ি হয় তার। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি বগুড়া শহরে আন্দোলনের জন্য মিছিল-মিটিংয়ে উদ্যোক্তার ভূমিকা রাখেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শিল্পী ঐতিহাসিক আমতলার মিটিংয়ে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। পরের দিনের ভাষাশহীদদের স্মরণে গায়েবানা জানাজাতেও অংশ নেন। সেই সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করার চেষ্টা করলে তিনি পালাতে বাধ্য হন। তিনি আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের পাশাপাশি অনেক কার্টুন ও ফেস্টুন এঁকেছিলেন। তার কার্টুনগুলো দেশ ও ভাষার জন্য লড়াই এবং ত্যাগের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
×