ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্নের টেকসই অর্থনীতি আজ বিশ্বস্বীকৃত সব সূচকেই অসামান্য অগ্রগতি

মাত্র সাড়ে ৩ বছরেই শূন্য অর্থনীতির দেশকে প্রতিষ্ঠিত করে যান বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ২৩:০০, ১৬ আগস্ট ২০২০

মাত্র সাড়ে ৩ বছরেই শূন্য অর্থনীতির দেশকে প্রতিষ্ঠিত করে যান বঙ্গবন্ধু

রহিম শেখ ॥ স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মাত্র সাড়ে ৩ বছর পেয়েছিল বাংলাদেশ। এই কম সময়ের শাসনামলেই প্রায় শূন্য অর্থনীতির দেশকে আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে যান বঙ্গবন্ধু। দেশের মানুষ যাতে আর কোন দিন অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার না হয়, গ্রামপ্রধান-কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের মেহনতি মানুষ যাতে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে সেজন্য তিনি সংবিধান রচনা করান চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও তিনি প্রাধান্য দেন সুষম একটি অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার ওপর। দারিদ্র্য জয় করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের রফতানি আয় গত অর্থবছর শেষে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এই মুহূর্তে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ। শুধু রফতানি কিংবা জিডিপি নয়, দেশের বাজেটের আকার, সরকারী-বেসরকারী বিনিয়োগ, রাজস্ব আয়, রেমিটেন্স আহরণ, দারিদ্র্য নিরসন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো তৈরি ও উন্নয়ন, বিদ্যুত উৎপাদন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসেছে সফলতা। বাংলাদেশের অর্থনীতির এমন অর্জনকে বিস্ময়কর বলেছেন পৃথিবী বিখ্যাত অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশের এ উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে এসেছে বিশ্বস্বীকৃতিও। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন ফিরলেন তখন বাংলাদেশের সম্পদ বলতে অবশিষ্ট কেবল তার জন্য বাঙালীর ভালবাসা। পাকিস্তানীরা বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাসহ এদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কাঠামো এমনভাবে ধ্বংস করে গিয়েছিল যাতে বাঙালী আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। এমনই অবস্থায় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু। পরে ১২ জানুয়ারি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ। এর আগে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ৪৬৯ জন সদস্যের মধ্যে ৪০৩ জনকে নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। ৭২ সালের ৪ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম বৈঠক বসে। বৈঠকে দেশের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় করণীয় নিয়ে দিকনির্দেশনা দেন বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের প্রাথমিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে ভারতের কাছ থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা পাওয়া যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্রও বাংলাদেশের জন্য সহায়তার হাত প্রশস্ত করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত রাস্তাঘাট মেরামত শুরু হয়, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা খুলে দেয়া হয়, স্বাভাবিক হতে শুরু করে পরিস্থিতি। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বে সঙ্কট কাটিয়ে ওঠে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার চার দশক পর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। আর এ স্বপ্ন পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে রফতানি খাত। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের রফতানি খাত কাঁচা চামড়া ও পাট নির্ভর হলেও সময়ের আবর্তনে সে তালিকায় যুক্ত হয়েছে তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, চামড়াজাত পণ্য, জাহাজ নির্মাণসহ হাল্কা ও মাঝারি শিল্পের নানা পণ্য। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের রফতানি আয় গত অর্থবছর শেষে প্রায় ৩ হাজার ৩৬৭শ’ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ মনে করেন, ‘মাাথাপিছু কম জমি নিয়ে আর কোন দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে এমন ইতিহাস করেনি। আমাদের বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে ক্রমাগতভাবে বেশি করে সংযুক্ত হতে হবে। যে শিল্প পণ্যগুলো বহুমুখী করে রফতানি করব, সেগুলোর কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমাদের আমদানি করতে হবে, এটাই এখন চ্যালেঞ্জ।’ অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার দৌড়ে নতুন বাজার বাড়ানোর পাশাপাশি আগামী দিনের রফতানি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশকে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ॥ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শুরু হয়েছিল ঋণাত্মক দিয়ে। ওই সময় দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাইনাস ১৩.৯৭ শতাংশ। মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২.১৭ ভাগ। আর ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ২.৭৫ ভাগ। সম্প্রতি করোনাভাইরাসের প্রকোপে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরেও ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরেছে সরকার। করোনাভাইরাস মহামারীকালের এই কঠিন সময়ে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ‘খুবই আনন্দের এবং আশাব্যঞ্জক’ বলে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, ‘গত অর্থবছরের এক তৃতীয়াংশ সময় আমরা কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে ছিলাম। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে চলতে হয়েছে আমাদের। মার্চ থেকে জুন এই চার মাস প্রায় সব কিছুই বন্ধ ছিল। তারপরও ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি খুবই ভাল বলে আমি মনে করি।’ তিনি বলেন, ‘আমি এজন্য দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানাই। এই দেশের মানুষ আবারও প্রমাণ করল, যত ঝড়-ঝাপটাই আসুক না কেন, তারা তাদের অন্তর্নিহিত শক্তি দিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখবেই।’ মাথাপিছু আয় ॥ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল মাত্র ১২৯ মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার। আর সে হিসাবে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় প্রায় ১৬ গুণ বেড়েছে। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। সেই পর্যায় থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা বাংলাদেশ অর্জন করেছে। ২০২৪ সালের মধ্যে এই উত্তরণপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। বলা হয়েছে, স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নীত হওয়ার মানে হলো দেশের মোট জাতীয় আয় যেমন বেড়েছে, তেমনই মানবসম্পদ, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা বেড়েছে। প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানের চেয়ে দ্রুতগতিতে বড় হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। রিজার্ভ ॥ ১৯৭৩ সালে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৭৩ মিলিয়ন ডলার বা ১৭ কোটি ৩ লাখ ডলার। গত বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৭ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার, যা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। প্রতি মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসেবে এই রিজার্ভ দিয়ে প্রায় সাড়ে নয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আগামী সপ্তাহের শুরুতেই রিজার্ভ ৩৮ বিলিয়ন (তিন হাজার ৮০০ কোটি) ডলার ছাড়াবে বলে প্রত্যাশা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, মহামারীর মধ্যেই বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ আরেকটি মাইলফলক অতিক্রম করতে চলেছে। বাজেট ॥ ১৯৭১ সালে মাত্র ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। এর পরের বছর প্রথম ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জন্য ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী প্রয়াত তাজউদ্দীন আহমদ। পরের দুটি বাজেটও দিয়েছিলেন তিনি। আর ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। সে হিসাবে দেশের ৪৯তম বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় ৭২৩ গুণের বেশি। রেমিটেন্স ॥ স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় ছিল ১৬.৩৫ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে দেশে রেমিটেন্স এসেছে ১ হাজার ৮২০ কোটি ৫০ লাখ (১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন) ডলার, টাকার অঙ্কে যা ১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। এই রেমিটেন্স ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। এর আগে এক অর্থবছরে এত রেমিটেন্স কখনই আসেনি। বিনিয়োগ ॥ স্বাধীনতার পর শুরুর দিকে বিদেশী বিনিয়োগ কেবল সরকারী খাতের জন্যই প্রযোজ্য ছিল। স্বাধীনতার পর পাট ও বস্ত্রকলের মতো বৃহৎ শিল্পগুলো ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা হয়। বিশ্বব্যাপী পাটের তৈরি দ্রব্যাদির বিকল্প সিনথেটিক ব্যবহার জনপ্রিয় হওয়ায় বড় বড় শিল্পগুলো অলাভজনক হয়ে পড়ে। এরপর বিকল্প হিসেবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। ক্রমান্বয়ে কৃষি যন্ত্রপাতি, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস তথা লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্যাদিও এসএমই’র মাধ্যমে উৎপাদিত হতে থাকে। এরপর যাত্র শুরু করে পোশাক শিল্পের। দেশী বিনিয়োগের পাশাপাশি বাড়তে থাকে বিদেশী বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরের ১১ মাসে বিভিন্ন খাতে সবমিলিয়ে ৩৭২ কোটি ৮০ লাখ ডলার বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে। রাজস্ব আয় ॥ স্বাধীনতার পর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৪২ কোটি টাকা। ৪৮ বছর পর সেই রাজস্ব আদায় বেড়েছে ১৩১২ গুণ। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। এছাড়া আয়কর ও ভ্রমণ কর থেকে ১ লাখ ৫ হাজার ৪৭৫ কোটি এবং আমদানি শুল্ক থেকে ৯৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
×