ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তারা পিটিয়ে খুন করে ৩ জনকে

প্রকাশিত: ২১:৫৫, ১৫ আগস্ট ২০২০

যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তারা পিটিয়ে খুন করে ৩ জনকে

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন কিশোর খুনের ঘটনায় নতুন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। দুই গ্রুপের সংঘাত নয়, কর্মকর্তারা পিটিয়ে হত্যা করেছে তাদের। আহতাবস্থায় অন্তত ১৪ কিশোর হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টির প্রাথমিক সত্যতা পেলেও এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে এই তথ্য স্বীকার করেনি। তবে পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা এ ঘটনাকে একপক্ষীয় বলে মন্তব্য করে গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। আর চিকিৎসাধীন কিশোররা ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে। এ ঘটনায় সমাজসেবা অধিদফতর ২ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। শুক্রবার বিকেলে লাশের ময়নাতদন্ত যশোর আড়াইশ’ শয্যা হাসপাতালে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হয়েছে। বৃহস্পতিবারের ঘটনার পর রাতে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে যান। গভীররাত পর্যন্ত তারা সেখানে থেকে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে খুলনা রেঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজিও আসেন। বৃহস্পতিবার রাত তিনটার দিকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বন্দি চুয়াডাঙ্গার পাভেল বলে, গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রের হেড গার্ড (আনসার সদস্য) নূর ইসলাম তার চুল কেটে দিতে বলে। সেদিন কেন্দ্রের প্রায় দুইশ জনের চুল কেটে দেয়ায় আমার হাত ব্যথা ছিল। সে কারণে তার চুল পরে কেটে দেয়া হবে জানালে সে ক্ষিপ্ত হয়ে গালিগালাজ করতে থাকে। একপর্যায়ে কয়েক কিশোর তাকে মারধর করে। বিষয়টি হেড গার্ড অফিসে জানায়। সেখানে নূর ইসলাম অভিযোগ করেন, কিশোররা মাদক সেবন করে তাকে মারধর করেছে। কিন্তু কিশোররা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে, তারা মাদক সেবন করেনি। পাভেলের ভাষ্য, ওই ঘটনার পর বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে আমাদের অফিসে ডাকা হয় এবং এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। আমরা ঘটনার আদ্যোপান্ত জানানোর এক পর্যায়ে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ, প্রবেশন অফিসার মুশফিকসহ অন্য স্যাররা আমাদের বেধড়ক পেটায়। আহত আরেক কিশোর নোয়াখালীর ‘বন্দী’ জাবেদ হোসেন জানায়, স্যাররা ও অন্য বন্দী কিশোররা আমাদের লোহার পাইপ, বাটাম দিয়ে কুকুরের মতো মেরেছে। তারা জানালার গ্রিলের ভেতর আমাদের হাত ঢুকিয়ে তা বেঁধে মুখের ভেতর কাপড় দিয়ে এবং পা বেঁধে মারধর করে। অচেতন হয়ে গেলে আমাদের কাউকে রুমের ভেতর আবার কাউকে বাইরে গাছতলায় ফেলে আসে। জ্ঞান ফিরলে ফের একই কায়দায় মারপিট করে। যশোরের বসুন্দিয়া এলাকার বন্দী ঈশান বলছে, নিহত রাসেল আর আমি একই রুমে থাকতাম। আগামী মাসেই তার (রাসেলের) জামিনে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। স্যারদের বেদম মারপিট আর চিকিৎসা না পেয়ে সে মারা গেছে। সে অভিযোগ করে বলে, প্রবেশন অফিসার মারধরের সময় বলে, তোদের বেশি বাড় বেড়েছে। জেল পলাতক হিসেবে তোদের বিরুদ্ধে মামলা করে ক্রসফায়ারে দেয়া হবে। আহতরা জানায়, মারধর করে তাদের এখানে-সেখানে ফেলে রাখা হয়। পরে একজন করে মারা গেলে তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর রাত আটটা থেকে ১১টার মধ্যে চার দফায় আহতদের হাসপাতালে আনা হয়। তবে উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রবেশন অফিসার মুশফিক আহমেদ দাবি করেন, সম্প্রতি কেন্দ্রে বন্দী কিশোরদের দুই গ্রুপের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। এরই জেরে বৃহস্পতিবার বিকেলে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। রড ও লাঠির আঘাতে মারাত্মক জখম হয় ১৭ কিশোর। প্রাথমিকভাবে উন্নয়ন কেন্দ্রে তাদের চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা চলে। তবে গুরুতর আহতদের উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। এর মধ্যে নাইম, পারভেজ ও রাসেলকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। প্রবেশন অফিসার ও নির্যাতিতদের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী। এই প্রসঙ্গে খুলনা রেঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি একে এম নাহিদুল ইসলাম বৃহস্পতিবার গভীর রাতে কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলেন, সরকারী প্রতিষ্ঠানে মর্মান্তিক ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। মত্যুপথযাত্রীরা কেউ মিথ্যা কথা বলে না। হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের কথার সত্যতা ও যৌক্তিকতা রয়েছে। তিনি এ ঘটনাকে একপক্ষীয় বলে উল্লেখ করে বলেন আমরা যারা অপরাধ নিয়ে কাজ করি, তারা ঘটনার প্রায় ছয় ঘণ্টা পরে বিষয়টি অবহিত হয়েছি। যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রায়ই অঘটন ঘটে। লাশ উদ্ধার, মারপিটের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা, দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে অনিয়ম জেঁকে বসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগে একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি এই তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য একগুচ্ছ সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি বরং অবনতি হয়েছে। বৃহস্পতিবার তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে মারপিটের ঘটনায় তিন ‘বন্দী’ কিশোর নিহত হয়। এসময় আহত হয়েছে অন্তত ১৭। আহতদের পুলিশ উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেছে। জেনারেল হাসপাতালের ডাঃ অমিয় দাশ বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই তিন কিশোর মারা যায়। কী কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ছাড়া বলা যাবে না। নিহতরা হলো, খুলনার দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়ার ছেলে পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮), বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার মহিপুর গ্রামের আলহাজ নুরুল ইসলাম নুরুর ছেলে রাসেল ওরফে সুজন (১৮) এবং একই জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার তালিপপুর পূর্বপাড়ার নানু প্রামাণিকের ছেলে নাঈম হোসেন (১৭)। নাঈম হোসেন ধর্ষণ এবং রাব্বি হত্যা মামলার আসামি ছিল। এদিকে এ ঘটনায় কেন্দ্রের দশজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য পুলিশ অফিসে আনা হয়েছে। যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ( বিশেষ) তৌহিদুল ইসলাম জানান, তিন কিশোর নিহত হওয়ার ঘটনায় কেন্দ্রের দশ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আনসার সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য পুলিশ অফিসে আনা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পরবর্তী কার্যক্রম নির্ধারণ করা হবে। তবে এখনও কাউকে আটক দেখানো হয়নি। ছেলেদের জন্য দেশে দুটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। যার একটি গাজীপুরের টঙ্গীতে, অন্যটি যশোর শহরতলির পুলেরহাটে। এ কেন্দ্র মোট বন্দীর সংখ্যা ২৮০ জন।
×