১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আসবেন ক্যাম্পাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে। ডাকসু, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ক্যাম্পাস সাজানোয় ব্যস্ত। জাতির পিতা আসবেন ক্যাম্পাসে, যেনতেন কথা নয়। বঙ্গবন্ধু এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন রাজনীতির কারণে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রী নিয়ে ১৯৪৭ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল’তে পোস্ট গ্র্যাজয়েশনে ভর্তি হন। বঙ্গবন্ধু ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন প্রতিবাদী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেন। তাঁর নেতৃত্বে চলছে রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন। পাকিদের জন্য মোক্ষম সুযোগ। তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। শর্ত দেয়া হয় মুচলেকা দিলে কিছু জরিমানা (১৫ টাকা) করে মুক্তি দেয়া হবে এবং বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হবে। বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। তাঁর কুষ্ঠিতে মুচলেকা রাশি নেই। জেলে পাঠিয়ে দেয়া হলো এবং দুই বছরের অধিক সময় কারাগারে কাটাতে হলো তাঁকে। আর এলএলবি ডিগ্রী অর্জন হলো না। ঠিক একই ভাগ্য বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার। এমএ ফাইনাল পরীক্ষা ঠেকিয়ে দেয়া হলো ১৫ আগস্ট। তারপর ৬ বছর প্রবাস জীবন। পিতার মতোই কন্যারও এমএ ডিগ্রী নেয়া হলো না। দু’জনেই গ্র্যাজুয়েট- একজন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের, অপরজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।
তখন ইত্তেফাকের রিপোর্টার। আমার নিউজ এন্ড এক্সিকিউটিভ এডিটর আসফ উদ-দৌলা রেজা ভাই এসাইনমেন্ট দিলেন আগের দিন ক্যাম্পাস ঘুরে একটা রাউন্ড-আপ লিখতে হবে। ১৪ আগস্ট দুপুর থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে ছিলাম। ওটা তো আমারই ক্যাম্পাস। ২/৩ বছর আগে ছেড়েছি। তাই কখনও মধুর ক্যান্টিন কখনও শরীফের ক্যান্টিনে আড্ডা মারলাম। চেনা মুখ পেয়েছি একজন শেখ কামাল আরেকজন ম. হামিদ। রাত বারোটার দিকে ক্যাম্পাস থেকে অফিসে ফিরে লেটেস্ট ডেভেলপমেন্ট লিখে দিয়ে বাসায় চলে যাই।
আমার চাচা আব্দুর রশিদ সোনালী ব্যাংকের অফিসার। ফজরের নামাজ পড়ে তার প্রতিদিনের অভ্যাসমতো রেডিওর নব ঘুরাতেই খুনীদের কণ্ঠ- ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ শুনেই আমাকে জাগালেন। উঠে রেডিও শুনলাম। কয়েক জায়গায় টেলিফোন করলাম। শহরে কার্ফু। তার পরও প্যান্ট-শার্ট চাপিয়ে সরকারী মিডিয়া এক্রিডিটেশন কার্ড আর ইত্তেফাকের কার্ড নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তখন নারিন্দাতে থাকতাম। বেরিয়ে খ্রীস্টান কবরস্থানে এসে রিকশা পেলাম। বেলা তখন সকাল ৯টার মতো হবে। মানুষ যারা খবর পায়নি তারা রাস্তায় নেমেছে। তবে অনেক কম। কোথাও রাস্তায় রাস্তায় আর্মি গান ক্যারেজ। প্রেসক্লাবে গিয়ে দেখলাম কেউ নেই। রিক্সা ঘুরিয়ে প্রথমে ক্যাম্পাসের দিকে যেতে চাইলাম, যেতে দিল না। সেখান থেকে ফিরে শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে মিরপুর রোড হয়ে ৩২ নম্বরে যাব ভাবলাম। কলাবাগান থেকে ফেরত পাঠিয়ে দিল। আবার প্রেসক্লাবে ফিরে এলাম। বিকেলে আবার রিকশা নিয়ে বেরুলাম। লক্ষ্য করলাম, কিছু মানুষকে মনে হলো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আর কিছু মানুষের চোখেমুখে আতঙ্ক, এরা রাজাকার এবং খুনীদের পক্ষের।
১৫ আগস্ট কোন দিন নয়
মাস নয় ক্ষণ নয়
নয় কোন চন্দ্র সূর্য গ্রহণের অন্ধকার সময় ॥
হঠাৎ বাংলার বুক
চিরে বেরিয়ে আসা রক্তগঙ্গা ॥
হঠাৎ একটি তীর্থালয় স্তব্ধ করে যেন
২৫ মার্চের গুলির মহড়া চলেছিল
মনুষ্য সৃষ্ট ভয়ঙ্কর রক্তগঙ্গা
৩২-এর বাড়ি থেকে
গড়াতে গড়াতে
ধানমন্ডি লেক উপচে পড়েছিল
গোটা শহর তুরাগ বুড়িগঙ্গা রক্তগঙ্গায় ভাসিয়ে
মধুমতি বাইগারে সব পানির রং পাল্টে দিয়েছিল
অতঃপর গড়াতে
গড়াতে
গড়াতে
বাংলার গ্রাম নদী ফসলের মাঠ
কিষাণির আঙ্গিনা রক্তলাল
নদ-নদীর মাছ
রাস্তার লাওয়ারিশ কুকুর
ভবঘুরে
ভিক্ষুক
প্রতিবন্ধী
সব।।
অথচ ওরা বলে
রক্তগঙ্গায় নাকি বাংলার মাটি
উর্বর হবে
মাছে ভাতে জীবন ফিরে আসবে আবার
আবার নাকি দুধের নহর বয়ে যাবে
খাল-বিল সেচ প্রকল্প সব এক রকম দেখতে
মেঘনা ডাকাতিয়া পদ্মার স্রোত
পাল্টে দেবে রুপালি ইলিশ
আরও কত শত সুখবর ॥
তবুও কি সখিনা বিবির
কপাল জোড়া লাগল?
সিঁথিতে সিঁদুর উঠল
কি হরিদাসীর?
এখনও অপেক্ষা করছেন
কবি শামসুর রাহমান
কবে আসবে সখিনা হরীদাসীর দিন
তিন দিন ভাত মুখে ওঠেনি যে বুড়িমার
ওরা কতবার বলেছিল তার মুখে ভাত উঠবে
মাছ ভাত দুধ ভাত
ওঠেনি ॥
কবি মহাদেব সাহার
এমনি কত প্রশ্ন
মীমাংসা হয়নি একটিরও ॥
তবু কেন বঙ্গবন্ধুর বুকে
ম্যাগাজিনের পর ম্যাগাজিন গুলি খরচ করা হলো?
যার একেকটি গুলির দামে
বঙ্গবন্ধুর গরিব দুঃখী মানুষের
মুখে ভাত উঠত
বঙ্গমাতার বুকে বিদ্ধ একেকটি গুলির দামে
গোটা বাংলাদেশে মরা নদী
খনন করা যেত
অসহায় নারীদের মুখে
হাসি ফোটানো যেত
অসহায় মা বোনদের অন্নের
নিশ্চয়তা দেওয়া যেত
কন্যা দায়গ্রস্ত পিতার
চোখের জল মুছে দেয়া যেত
শেখ রাসেলের বুকের গুলির দামে
একেকটি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বানানো যেত
শিশু-কিশোরদের হাতে
বই খাতা কলম তুলে দেয়া যেত
দেয়া যেত ফুটবল ক্রিকেট ব্যাট
ঘরে ঘরে পথ শিশুদের হাতে ॥
সুলতানা কামাল রোজী জামালের
হাতের মেহেদির রং দিয়ে
সাজানো যেত হাজারো লাখো
বিয়ের পিঁড়িতে বসানো যেত
হাসি ফুটত কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার
মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল শেখ জামালের
বুকে বিদ্ধ একেকটি বুলেটের দামে
একেকটি ট্রেন লাইন চালু করা যেত
একেকটি যুদ্ধজাহাজ
সাবমেরিন মহাসুমদ্রে চলাচল করত
আকাশে উড়ত ঝাঁকে ঝাঁকে যুদ্ধবিমান
পতাকা উড়ত পত্ পত্ করে
এসব প্রশ্নের কি মীমাংসা হয়েছে?
না মহাদেব সাহা হয়নি ॥
রাজপথে লাওয়ারিশ কুকুর কাকের
খাবার নেই ডাস্টবিনে
খাল বিল নালায় মাছ নেই
চরাচরে উড়ে বেড়াচ্ছে সাদা বকের দল
গাংচিল পরিযায়ী হাঁস
ক্ষিদের জ্বালায় এখান থেকে ওখানে
পদ্মায় রুপালি ইলিশ নেই
জেলে নৌকা করোনাক্রান্ত
কে দেবে ব্যবস্থাপত্র ওষুধ
খোদ ডাক্তারই করোনাক্রান্ত
ডাক্তার মরে গেলে মানুষ কি বেঁচে থাকে
মানুষ মানুষকে কি বাঁচাতে পারে?
হ্যাঁ ওরা কিছুই পারে না
রক্তগঙ্গায় জন্ম দেয় অশিক্ষিত রাজনীতিক
নেতা-কর্মী দুর্নীতিবাজ আমলা কেরানী
গর্ত থেকে উঠে আসে বিষাক্ত সাপ
রাজাকার আলবদর আলশামস
নিজামী সাঈদী গোলাম আযমের দল
জিয়া মোশতাকের দল
রাতারাতি পাল্টে দেয় বইয়ের পাতা
শহীদদের সমাধিসৌধ
মানুষের বিশ্বাসগুলোকে
বুলেটে বুলেটে টুকরো টুকরো করে দেয়
জীবন আদর্শ নীতি
জাতীয় পতাকা শহীদ মিনার জাতীয় স্মৃতিসৌধ
হাজার বছরের আবহমান বাংলার স্নিগ্ধ মুখের ওপর
বসিয়ে দেয় কর্কশ
শিফন খাকি কালচার
বুদ্ধিজীবী কবরস্থান
দীর্ঘ ২১ বছর চলে খা-বদাহন
তবে ক্যানো জাতির পিতার বুকে গুলি
ক্যানো বঙ্গমাতার মাথায় গুলি
ক্যানো শিশু শেখ রাসেলের মাথায় গুলি
ক্যানো মুক্তিযোদ্ধা কামাল জামালের বুকে গুলি
সুলতানা কামাল রোজী জামালের হাতের
মেহেদি রং ক্যানো মুছে দেয়া হলো?
ফিরে দেখা
আমরা যারা বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ের কার্যালয়
ধানমন্ডি ৩ নম্বরে
লাল চা খেতে খেতে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলি
এক এম্বুসে পাকি আর্মি নিধনের গল্প বলি
যারা স্বৈরাচার পতনের গল্প বলি
রাজপথে পুলিশের লাঠি গুলিকে তোয়াক্কা করিনি
তারা কেউ ঘর থেকে বেরোলো না
সবাই হোম কোয়ারেন্টাইনে
এতদিন যে লোক
বাকশাল নিয়ে গর্ব করত
কত দাপট
সেই লোকই মুক্তিযুদ্ধে না গিয়ে
রাজাকারে আজম গোলাম আযমের
নাগরিকত্ব চেয়ে বিবৃতি দেয়
সেই একই লোক
১৫ আগস্ট প্রেসক্লাবে বলে
‘এমনটি যে হবে আগেই জানতাম
সবকিছুর একটা সীমা আছে’
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে না গিয়ে
বায়াত্তর থেকেই বলতে শুরু করে
আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি
এটা ছিল তার মিডিয়ায় রাজাকার আলবদর
পুনর্বাসন প্রকল্প
সরকারের ট্রান্সপোর্ট পুল থেকে জীপে
পতাকা লাগিয়ে
ঢাকার বাইরে নেতা-মন্ত্রী সেজে
আবার গার্ড অব অনার
রি-এ্যাক্ট করেছে, গোপালগঞ্জের একদল সাংবাদিক
সবকিছু জামায়াত-বিএনপি স্টাইল
মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত
প্রেসক্লাব থেকে জামায়াত তাড়াও
আন্দোলনে বিজয়ের মুহূর্তে নেতৃত্ব দখলের চেষ্টা
ফোরামে ক্লাবে উভয় ক্ষেত্রে ॥
অতঃপর
চোরের দশ দিন গেরস্তের একদিন
সেই ক্ষণটি এলো
পতাকা গেল
গাড়ি গেল
গার্ড অব অনার গেল
তবু শেষ হয়নি
ইবলিসি ক্ষমতা
এখনও একা একা ফাল পাড়ে
২১ বছর চলছে
খাকি শিপন কালচার
অতঃপর
রক্তগঙ্গা থেকে উঠে এলেন
মানবীরূপী সিপাহসালার
যার কাছে মানুষ বড়
আইনশৃঙ্খলায় উন্নয়নে অবকাঠামোয়
করোনায় বন্যায়
ক্লান্তিহীন একমাত্র তিনিই।
আর সব হোম কোয়ারেন্টাইনে ॥
ঢাকা- ১৪ আগস্ট ২০২০
লেখক : এমপি এবং সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব
[email protected]