ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালীর সমাজ-দার্শনিক -দ্বিশততম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: ২২:৪২, ১৪ আগস্ট ২০২০

বাঙালীর সমাজ-দার্শনিক -দ্বিশততম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ অক্ষয় কুমার দত্ত (১৮২০-৮৬)। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-৯২) সমবয়স্ক শুধু নন, সম-মনস্কও ছিলেন। তবে বিজ্ঞান চর্চায় ও বিজ্ঞানমনস্কতায় এবং যুক্তিবাদিতায় তিনি বিদ্যাসাগরকেও ছাড়িয়ে গেছেন কোন কোন দিক থেকে। ‘বাহ্যবস্তুর সঙ্গে মানব-প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার’ (১৮৫২) বইয়ে তিনি ইংরেজের সাম্রাজ্যনীতির কঠোর সমালোচনা করেন। ভারতে ইংরেজ শাসন শুধু এ কারণেই তিনি প্রাসঙ্গিক মনে করতেন যে এর ফলে ভারতবাসী আধুনিক বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ইংরেজের সাম্রাজ্যিক মনোভাব এবং শাসন-শোষণকে তিনি বরাবরই ঘৃণা এবং পরিত্যাজ্য মনে করতেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন ইংরেজরা আমেরিকায় যে ধরনের অত্যাচার করেছিল তা ভারতেও লক্ষিত হচ্ছে। ফলে ইংরেজ এবং ভারতবাসীর মধ্যে সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে শোষক এবং শাসিতের। এ ধরনের সম্পর্কের পরিণাম ভয়াবহ হবে বলে তিনি মনে করতেন। লিখেছেন, ‘ইংরেজরা যে দুর্জয় নিকৃষ্ট প্রবৃত্তির অনুবর্তী হইয়া ভারতভূমি অধিকার করিতে আরম্ভ করেন, ইহাই জ্ঞাপন করিবার নিমিত্ত তাঁহাদিগের প্রথমবার ব্যবহারের বিষয় যৎকিঞ্চিত লিখিত হইল। তাহার সর্বশেষ বৃত্তান্ত লিখিত হইলে কত প্রকার ধ্বনির প্রতিধ্বনি হইত, কত আর্তনাদের প্রতিনাদ করিতে হইত, কত হৃতসর্বস্ব ব্যক্তির চিৎকার রব ব্যক্ত করিতে হইত, কত অস্ত্রাহত, শোণিতাক্ত শরীরের বর্ণনা করিতে হইত, কত স্তূপাকারের ভয়ঙ্কর শবসমূহের বিবরণ করিতে হইত’ (বাহ্যবস্তুর সহিত মানব-প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার)। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে অক্ষয় কুমারের এ আশঙ্কা অমূলক ছিল না। অক্ষয় কুমারকে আমরা বিশেষভাবে জানি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক (১৮৪৩-১৮৫৪) হিসেবে। কিন্তু সম্পাদনার বাইরেও তিনি বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বাংলা গদ্য সৃষ্টিতেও বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার জন্য প্রথম যে বইটি তিনি রচনা করেন তা কোন গল্পগ্রন্থ ছিল না, ছিল বিজ্ঞান বিষয়ে-ভূগোল গ্রন্থ। বাংলায় পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে প্রথম বই- পদার্থবিদ্যা (১৮৫৬) বইটিও তাঁর লেখা। এভাবে তিনি বাংলা গদ্য সৃষ্টিতে বিদ্যাসাগরের পাশাপাশি তার অবদান অনস্বীকার্য (বাংলা গদ্যে বিদ্যাসাগর সঙ্গে তার অনেক বিষয়ে মতদ্বৈততা ছিল। যেমন, বিদ্যাসাগর প্রবর্তিত সংস্কৃত ভাষার মতো তিনি বাংলা গদ্যে সম্বোধন পদ ব্যবহারের বিরুদ্ধে ছিলেন)। এ পত্রিকায় তিনি সাহিত্যের পাশাপাশি বিজ্ঞান, দর্শন, পুরাতত্ত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিভাগ রেখে বাঙালির যুক্তিবাদী মানস গঠনে অবদান রেখেছেন। তার যুক্তিবাদী মনও প্রতিনিয়ত ভাঙ্গা-গড়ার মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। হিন্দু ধর্ম ছেড়ে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কারণ তার মনে হয়েছে ব্রাহ্ম ধর্ম হিন্দু ধর্মের চেয়ে অনেক বেশি হইজাগতিক। কিন্তু সেখানেও স্থিত থাকেননি এবং শেষ পর্যস্ত তাঁঁর ঝোঁকটা ছিল অজ্ঞেয়বাদের দিকে। নিজেকে তিনি প্রতিনিয়ত ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) ধর্ম-সংস্কার ছিল তাঁর সমাজ-সংস্কারেরই পূর্বগামী। আবার সমাজ- সংস্কারের পূর্বশর্তই হচ্ছে- বুদ্ধির মুক্তি। এ মুক্তি না হলে সবকিছুই অনর্জিত থেকে যাবে বলে তিনি মনে করতেন। এ কারণে যুক্তি, বৈজ্ঞানিক সত্য এবং ‘বহিরিন্দ্রয়ি দ্বারা লব্ধ জ্ঞানের ওপর’ রামমোহন রায় জোর দিয়েছিলেন বেশি। অক্ষয় কুমার দত্তও রামমোহন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে তিনি রামমোহন রায়ের চেয়েও এগিয়ে ছিলেন। রামমোহনের মধ্যে যে দোদুল্যমানতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল তা অক্ষয় কুমারের মধ্যে মোটেই ছিল না। রামমোহন রায় সমাজ-সংস্কার চেয়েছেন। অক্ষয় দত্ত সংস্কার নয় শুধু, চেয়েছেন নতুন সমাজ সৃষ্টি করতে- যে সমাজ হবে বিজ্ঞান এবং যুক্তিনির্ভর। অন্যদিকে রামমোহন রায়ের শিষ্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজ নয়, চেয়েছেন সম্প্রদায় সৃষ্টি করতে। কিন্তু এ সৃষ্টি করতে তিনি এক সময় সমাজ ও রাজনীতি থেকেই (১৮৫৪) নিজেকে গুটিয়ে নেন। গুটিয়ে নিয়ে ধর্মসেবা ও ব্রহ্মচিন্তায় এবং ‘বিশুদ্ধ ব্রহ্মবাদ বিস্তারে’ আত্মনিয়োগ করেন। মূলত তখন থেকেই তার সঙ্গে বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত প্রমুখের দূরত্ব সৃষ্টি হয় এবং এক সময় হিমালয় ভ্রমণ করে সে দেবেন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর পরিচালিত তত্ত্ববোধিনী সভাটিই তুলে দেন। দেবেন্দ্রনাথ যখন ব্রহ্মবাদ প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন অক্ষয় দত্ত তখন বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ, ব্রিটিশ শাসন, জমিদারি ব্যবস্থা হেতু অত্যাচারের স্বরূপসহ সমসাময়িক রাজনীতি ও সমাজনীতি নিয়ে ভাবিত ছিলেন। এক সময় নিঃসঙ্গ দেবেন্দ্রনাথ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা বিলোপ (১৮৫৯) করে দিয়ে কেশবচন্দ্রের দিকে ঝুঁকলেন। এর আগে অবশ্য দেবেন্দ্রনাথ অক্ষয় দত্তকে এ পত্রিকা থেকে অব্যাহতি দেন (১৮৫৪)। কারণ দুজনের মধ্যে মত ও পথ বিষয়ে বিস্তর পার্থক্য দেখা দিয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ নিজেই ‘আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, ‘আমি অধিক বেতন দিয়া অক্ষয়বাবুকে ওই কার্যে নিযুক্তি করিলাম। তিনি যাহা লিখিতেন, তাহাতে আমার মতবিরুদ্ধ কথা কাটিয়া দিতাম এবং আমার মতে তাহাকে আনিবার জন্য চেষ্টা করিতাম; কিন্তু তাহা আমার পক্ষে বড় সহজ ব্যাপার ছিল না। আমি কোথায় আর তিনি কোথায়! আমি খুঁজিতেছি ঈশ্বরের সহিত আমার কি সম্বন্ধ; আর তিনি খুঁজিতেছেন, বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির কি সম্বন্ধ;-আকাশ পাতাল প্রভেদ!’ হ্যাঁ, প্রভেদ যে অনেক দূর তা দুজনেই বুঝতে পেরেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে সরিয়ে না দিলে যে তিনি যে সে কাজ অব্যাহত রাখতেন তা মনে হয় না। কারণ একটি বিষয় দেবেন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন- তাহাতে আমার মতবিরুদ্ধ কথা কাটিয়া দিতাম- অক্ষয় কুমার তা সহ্য করতে পারছিলেন না। আবার সম্পাদক হিসেবে তিনি নিজেও হাঁপিয়ে উঠছিলেন। কারণ এ পত্রিকা একসময় বেদের অভ্রান্ততা প্রচারপত্রে পরিণত হয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথ ধর্মভিত্তিক যে ধরনের সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন তা অক্ষয় দত্ত মেনে নিতে পারেননি। ঐদিকে কেশবচন্দ্রের সঙ্গেও দেবেন ঠাকুরের বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং এ বিরোধ একসময় প্রকাশ্য রূপ পায়। কেশবচন্দ্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একচেটিয়া কর্তৃত্ব মেনে নিতে পারছিলেন না এবং শেষ পর্যন্ত তাদের বিচ্ছেদও অনিবার্য হয়ে ওঠে। যদিও এ বিচ্ছেদ (১৮৬৫) দেবেন্দ্রনাথের জন্য বড় আঘাত ছিল তবুও তিনি তা মেনে না নিয়ে পারেননি। এরপর কেশবনন্দ্র সৃষ্টি করলেন ‘নববিধান ব্রাহ্মসমাজ’ (১৮৭৮)। ক্রমে কেশবচন্দ্রের চিন্তাধারায় সমাজ, মানুষ গৌণ হয়ে পড়ে এবং এক সময় তিনিও দেবেন্দ্রনাথের মতো সমাজ বিচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে অক্ষয় কুমারের বিরোধটা যদি হয় মতাদর্শিক তবে কেশবচন্দ্রের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরোধটা ছিল ক্ষমতাকেন্দ্রিক। তবে এ দুজনের সঙ্গে অক্ষয় কুমারের বিরোধটা স্পষ্ট- সেটা মতাদর্শিক। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তার কেন্দ্র যদি হয় ব্রহ্ম তবে কেশবচন্দ্র মেনে নিতেন ‘সব প্রভুর ইচ্ছা’ বলে। আর অক্ষয় দত্তের সে বিখ্যাত সমীকরণটি তো সবারই জানা। যেখানে তিনি প্রার্থনাকে শস্য উৎপাদনে নিষ্প্রয়োজন মনে করছেন। তাঁর কাছে কৃষকের শ্রমই নমস্য। দেবেন্দ্রনাথ ব্রহ্ম নিয়ে ভাবিত ছিলেন আর অক্ষয় দত্ত ভাবিত ছিলেন ব্রহ্মের স্বরূপ নিয়ে। অক্ষয় কুমারের এ স্বরূপ নির্ণয় দেবেন্দ্রনাথ সহ্য করতে পারেননি, তিনি বিরক্ত হয়েছিলেন; যেমন তিনি বিরক্ত হয়েছিলেন অক্ষয় কুমারের বাহ্যবস্তুর সঙ্গে মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধ সৃষ্টির চেষ্টাকে। অক্ষয় কুমার দত্ত দার্শনিকতায় বেকনের অনুরাগী। তাঁর চিন্তাধারা মানব এবং সমাজকেন্দ্রিক। এ মানব-ভাবনা দেবেন ঠাকুরের ব্রহ্ম-ভাবনার সঙ্গে যায় না। বিজ্ঞানে তিনি ছিলেন নিউটনের শিষ্য। তার ঘরে রামমোহনের পাশে নিউটনের ছবিও টাঙানো ছিল। বাল্য ি বয়ের বিরুদ্ধে তার যে অবস্থান তার মধ্যে শুধু সামাজিক কারণ নয়, বৈজ্ঞানিক কারণও রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘বালক বালিকা পরস্পর উদ্বাহ-সূত্রে সংযুক্ত হইলে, পরস্পরের মর্যাদা জানিতে পারে না... যদি দুর্ভাগ্যক্রমে পরস্পরবিরুদ্ধ স্বভাবাক্রান্ত হয়, তাহা হইলে তাহাদিগকে চিরজীবন দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করত বিবাদ কলহ করিয়া কালক্ষেপণ করিতে হয়। আর যদি অল্প বয়সে অর্থাৎ শরীরের পূর্ণাবস্থা প্রাপ্ত না হইতে হইতে সন্তান উৎপন্ন হয়, তবে সে সন্তান দুর্বল, জীর্ণ ও রোগার্থ হয় এবং অল্প বয়সে কালগ্রাসে প্রবিষ্ট হইয়া অত্যাচারী পিতামাতাকে শোকাকুল করিয়া যায়। তদ্ভিন্ন, যদি বিবাহিত পুত্র অল্পকাল ভারপ্রাপ্ত হইয়া রীতিমতো বিদ্যা ও বিষয়কর্ম শিক্ষার্থে অবসর না পায় এবং সেই কারণে সংসারযাত্রা নিব্বহার্থে উপার্জন করিতে সমর্থ না হয়, তাহা হইলে দারুণ দৈন্যদশায় পতিত হইয়া চিরজীবন যৎপরোনাস্তি ক্রেশ-রাশি ভোগ করিতে থাকে’ শুধু বাল্য বিয়ে নয়, নর-নারীর বিয়ে সম্পর্কে তাঁর যে অভিমত তা এ সময়ের জন্য ছিল বৈপ্লবিক। তার মতে বিয়ে হওয়া উচিত পূর্ব-প্রণয় সঞ্চারের মাধ্যমে। এর বিপরীত হওয়াটা তার মতে ‘যুক্তিবিরুদ্ধ’ এবং ‘অসঙ্গত’। কারণ তিনি বিয়েতে স্বামী-স্ত্রীর মানসিক পক্বতা এবং মানসিক মিলনের ওপরই বেশি জোর দিয়েছেন। এর ফলে বিভিন্ন কারণে যে বিয়ে বিচ্ছেদ হয় তা থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। বাল্য বিয়ে রোধ শুধু মেয়েদের জন্য নয়, ছেলেদের জন্যও প্রয়োজন বলে তিনি মনে করতেন। কারণ এর ফলে ছেলেরাও ‘কার্যক্ষম’ এবং ‘উপায়ক্ষম’ হওয়ার সুযোগ পাবে। বিয়ে পরবর্তী দাম্পত্য কলহের কারণ হিসেবেও তিনি অনেক বিষয়ের মধ্যে নারীর নিরক্ষতাকে দায়ী করেছেন। এ সময় মা-বাবারা ছেলেদের শিক্ষায় মন দিলেও মেয়ে শিক্ষার প্রতি ছিলেন অনাগ্রহী। এর ফলে স্ত্রীদের মানসিক অপরিপক্বতা লক্ষ্যণীয় ছিল। ফলে স্বামীর চিন্তা-ভাবনা প্রায় সময় স্ত্রীরা বুঝতে সক্ষম হতো না এবং তাদের মধ্যে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হতো। এ দূরত্ব দাম্পত্য সম্পর্ককে ক্ষতি করত। তাই তিনি স্বামী-স্ত্রীর মানসিক সাযুজ্যের জন্য নারী-শিক্ষা অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করেন। এর ব্যত্যয় হলে তার দায়ভার পরবর্তী প্রজন্মের ওপরই বর্তাবে। তিনি বলেন, ‘কেবল তাঁহারাই অসুখী থাকেন এমত নহে, তাহাদের সন্তানরাও দূষিতপ্রকৃতি প্রাপ্ত হইয়া অনেক প্রকার ক্লেশ ভোগ করে।’ বহুবিবাহের বিরদ্ধে তাঁর যে কারণে অবস্থান তা অনেক যৌক্তিক এবং বৈজ্ঞানিক। তিনি মনে করেন বহুবিবাহ অমানবিক বা অসামাজিক শুধু নয়, তা প্রকৃতিবিরুদ্ধও। তিনি বলেন প্রকৃতিগতভাবে সমাজে নারী-পুরুষের সংখ্যা-সাম্য থাকে। আর যদি পুরুষ একাধিক দার পরিগ্রহ করে তবে তা প্রকৃতিবিরুদ্ধ বলে পরিগণিত হবে এবং এতে প্রকৃতির স্বভাবিকতা ও সামাজিকতাও বিঘ্নিত হবে। তিনি এক পুরুষের এক স্ত্রী গ্রহণকে যৌক্তিক এবং স্বাভাবিক বলে মত দিয়েছেন। বলেছেন, ‘এক এক পুরুষের এক এক স্ত্রীর পাণিগ্রহণ করা কর্তব্য, অধিবেদন অর্থাৎ বহু বিবাহ কোন রূপেই কর্তব্য নহে।’ তার এ মত বস্তুত নারী-পুরুষের সমানাধিকারেরই নামান্তর। খেয়াল করলে দেখা যাবে এখানে নারীর অধিকারের বিষয়টিও স্পষ্ট হয়েছে। বিধবা বিবাহের প্রশ্নে তার যে অভিমত তাতে নারীর অধিকারের প্রশ্নটিও জড়িত। তিনি বিধবা-বিবাহের মধ্যে নারী অধিকাররের বিষয়টিও লক্ষ্য করেছেন। বিধবার যদি বিয়ে না হয় তবে তাতে নারী তার অধিকার বঞ্চিত হবে বলে তিনি মনে করতেন। তিনি বলেন, ‘যখন মৃত-দার পুরুষেরা পুনর্বার দার পরিগ্রহ করিয়া পাপগ্র্রস্ত হয় না, তখন পতি-হারা বিধবারা পুনর্বার বিবাহ করিলে কেন দূষিত হইবে?’ জন্ম নিয়ন্ত্রণের পক্ষে তার অভিমত-‘অবস্থানুসারে মনুষ্যের অপত্যোৎপাদিকা শক্তির সংযম করা কর্তব্য : এমনকি মৃত্যুদ-ের বিরুদ্ধেও তিনি অবস্থান নিয়েছিলেন। সমাজ চিন্তার সঙ্গে রাজনীতিও তীর ভাবনার বিষয় ছিল। নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি বরাবরই সরব ছিলেন। তীর বক্তব্যে কোন ধরনের রাখঢাক ছিল না। ‘পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদিগের দুরবস্থা’ নামক রচনায় তিনি সরাসরি নীলচাষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বলেছেন, ‘প্রজারা যে ভূমিতে ধান্য ও অন্যান্য শস্য বপন করিলে অনায়াসে সংবৎসর পরিবার প্রতিপালন করিতে পারে, তাহাতে নীলকর সাহেবের নীল বপন করিলে তাহাদিগকে দুñেদ্য ঋণ জালে বদ্ধ হইতে হয়।’ এক্ষেত্রেই তিনি সাধারণ কৃষকের পাশাপাশি ভূস্বামীদের অসহায়ত্বও তুলে ধরেন-‘যখন কোন কোন স্থলে ভূস্বামীরাও তাঁহার (নীলকরের) নিকট পরাভব মানেন, তখন অধীন দীন কৃষকেরা কোথায় আছে? অক্ষয় কুমার দত্ত মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে (১৮৫৫) ‘উৎকট’ রোগে আক্রান্ত হন কিন্তু নিষ্ক্রিয় থ##কেননি। দুখন্ডে সমাপ্ত ভারতবর্ধীয় উপাসক সম্প্রদায় (১৮৭৯)-এ সময়েই লিখিত। তিনি নিজে উপাসক ছিলেন না কিন্তু উপাসকদের নিয়ে তার আগ্রহ কম ছিল না। ব্রাহ্মদের উপাসনা সভায় তিনি যেতেন কিন্তু উপাসক হিসেবে নয়, যেতেন সামাজিক মানুষ হিসেবে। এ উপাসকদের দেশ পর-করতল হওয়াতে তিনি খেদ প্রকাশ করেছেন। ‘ইংল্যাংড! ইংল্যান্ড! তুমি অক্লেশে দুঃসাধ্য বিষয় সিদ্ধ করিয়াছ...বাল্মীকি, কালিদাস, কণাদ ও আর্যভট্টের স্বজাতিবর্গকে পদাবনত করিয়া নিজ সিংহাসন উজ্জ্বল ও উন্নত করিয়াছ। আমরা যন্ত্রণা বলে তোমাকে রাজসিংহাসনে অধিরূঢ় করিয়া রাজমুকুট প্রদান করিয়াছি।’ ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’-এ শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাই ধ্বনিত হয়েছে। ভারত স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়নি অক্ষয় কুমারের কাক্সিক্ষত বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদী সমাজ। এ ধরনের সমাজ বিনির্মাণে আমাদের তাঁর কাছে যেতেই হবে।
×