ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুরের জাদুকর

প্রকাশিত: ২৩:৫৭, ১৩ আগস্ট ২০২০

সুরের জাদুকর

গত মাসের প্রথম সপ্তাহে গত হন নন্দিত কণ্ঠ শিল্পী এন্ড্রু কিশোর। তার মৃত্যুতে দেশের কোটি শ্রোতার হৃদয় ভেঙ্গেছে। মাস পেরুতেই চলে গেলেন সুরের জাদুকর আলাউদ্দিন আলী। যদিও গীতিকবি, সুরকার, কিংবা সঙ্গীত পরিচালকদের নাম বা যশ শ্রোতাদের কাছে খুব একটা না থাকলেও কারও কারও কাছে এরাই মূলত প্রধান। তেমনি, একজন আলাউদ্দিন আলী। গত ৯ আগস্ট বড় অসময়ে পৃথিবী ছাড়লেন সুরের এই বরপুত্র। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর আজ পর্যন্ত যত নন্দিত গান শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরে তার বেশিরভাগ গানের সুরকার তিনি। গত কয়েক বছর ধরে আমাদের সঙ্গীত অঙ্গনে যে নিদারুণ খরা চলছে তাতে করে তার মৃত্যু আমাদের নিঃশেষের পথে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। বলতে অসুবিধা নেই, এখন আর আমাদের দেশে গান হয় না। কেউ কেউ হয়তো বলবে- না হয়তো! কিন্তু সম্প্রতি গানের যে মানুষটি গত হয়েছেন তার কয়েকটি গানের লাইন যদি মনে করেন তাহলে হয়তো একমত হবেন। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, নতুন শতাব্দীর দুই দশক পার হতে চললেও সেই অর্থে বিশটি গান আমরা খুঁজে পাব না। যা সামনের দশকে শ্রোতারা মনে রাখবে। সৃজনশীল কাজ বা সংস্কৃতি চর্চা এতটাই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে যে এসব এখন আর আলোচনায় আসে না। তাইতো আলাউদ্দিন আলীর মতো কিংবদন্তীর বিদায় আমাদের ভীষণ বিষণœœ করে। উপমহাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে আলাউদ্দিন আলী উল্লেখযোগ্য নাম। তার নামের পাশে বাংলাদেশ-ভারতের অসংখ্য আলোড়িত গানের কথা শোভা পায়। নিজের শিল্প জীবন এবং বর্তমান অবস্থা নিয়ে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন- আসলেই আমার মতো ভাগ্যবান সুরকার কিন্তু খুব কম আছে। কেন, বলব? এত শিক্ষিত লোক আমার জন্য গান লিখেছেন, তা ভোলার নয়। এখন তো দুই পাতা লিখলেই গীতিকার। কোনদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ দেখেননি কিন্তু গান লিখে সয়লাব করে ফেলছেন। পারলে আমার ড্রাইভারও গান লিখে আজকাল। এমনকি স্টুডিওতে আমার জন্য ভাত রান্না করত যে ছেলেটা সেও এখন সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক। তাল, লয় বুঝে না, সুরও বুঝে না। কিন্তু বড় বড় শিল্পীও এখন তার গান করে। ভারতের কোন হিন্দী গানকে হয়তো বাংলা করে সুর করে ফেলল এ রকমই। এই হলো সঙ্গীতের অবস্থা। আমি একটু বেশি খুঁতখুঁতে কিন্তু আমি শিল্পীদের বেশি কষ্ট দেই না। আমি একটু ফোক, ক্লাসিক্যাল মিলিয়ে অন্যরকম একটা কিছু সুর করার চেষ্টা করি। তাই শিল্পীরা কিছুটা তটস্থ থাকে। আমি মনে করি অনেক কিছু গান, শিল্প-সাহিত্যে আনা উচিত না। আনলে সাময়িক হৈচৈয়ে সস্তা জনপ্রিয় হয় ঠিকই কিন্তু তার স্থায়িত্ব থাকে না। এটা এক ধরনের বিকৃত মজা, অসুস্থতা। আমি গৈরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারপর ঢাকায় আবু হেনা মোস্তফা কামাল সাহেব, গাজী মাজহারুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম বাবু, মাসুদ করিম, কেজি মোস্তফা, মো. রফিকুজ্জামান, মো. মনিরুজ্জামান সাহেবদের গীতি কবিতায় সুর করেছি। এই প্রজন্মের সুরকাররা কোথায় পাবেন এ রকম গুণী গীতিকারকে? ধরেন গাজী মাজহার ভাইকে যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মাঝখান থেকে দুই লাইন পড়ে শোনান, তাহলে এর আগে পিছে ১০ লাইনও বলতে পারবেন। কিন্তু এই প্রজন্মের অনেক গীতিকার তো এক লাইন ছড়াও বলতে পারবে না। আমি বাংলাদেশ, করাচি, লাহোর, কলকাতা, মুম্বাই একসঙ্গে একই দিনে কাজ করেছি। ১৯৮৭ সালের ২৬ জুলাই একদিনের ঘটনা বলি। আমি সেদিন মুম্বাইয়ে রেকর্ড করছি। প্রতি ঘণ্টায় শিল্পীরা আসছেন, কখনও উদিত নারায়ণ, সাধনা সারগাম, বিনোদ রাঠোর, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি একেকজন, এক ঘণ্টা পরপর আসছেন, গান করছেন। আবার কলকাতায় আমার আরেকজন সহকারী স্বপন সেন এবং একই দিনে ফুয়াদ নাসের বাবু ঢাকায় মিউজিক রেকর্ডিং করছে। আমি সেদিন মুম্বাই, কলকাতা এবং ঢাকায় একই দিনে ৩০টা গান রেকর্ড করি। আমি মিউজিক এবং সুর করে একসঙ্গে তিন জায়গায় শিল্পীদের ভয়েজ নেওয়ার ব্যবস্থা করি। নিজের কথার মতো এমনই সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন আলাউদ্দিন আলী। আফসোস সময় তাকে সময় দিল না।
×