ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশের নজরদারিতে নীলনক্সা ব্যর্থ

শাহজালালের মাজারে হামলার পরিকল্পনা ছিল নব্য জেএমবির

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ১৩ আগস্ট ২০২০

শাহজালালের মাজারে হামলার পরিকল্পনা ছিল নব্য জেএমবির

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ঈদের সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা ছিল নব্য জেএমবির। সে মোতাবেক জঙ্গী সংগঠনটি তাদের সামরিক শাখার সদস্যদের প্রস্তুতও করেছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা কারণে সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। দীর্ঘ সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা ঢাকায় পাঁচটি বোমা হামলার ঘটনা ঘটিয়েছিল। বুধবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোঃ মনিরুল ইসলাম এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, চলতি বছরের ২৪ জুলাই ঢাকার পল্টনে পুলিশের চেকপোস্ট লক্ষ্য করে বোমা হামলার ঘটনায় নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবির পাঁচ জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়। মঙ্গলবার অপারেশন এলিগ্যান্ট বাইট চালিয়ে সিলেটের মিরাবাজার, টুকের বাজার, দক্ষিণ সুরমার বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছে বোমা তৈরির সরঞ্জাম, ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন পাওয়া গেছে। মোবাইলে ও ল্যাপটপে জঙ্গীবাদের পর্যাপ্ত আলামত আছে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, শেখ সুলতান মোহাম্মদ নাইমুজ্জামান (২৬), সানাউল ইসলাম সাদি (২৮), রুবেল আহমেদ (২৮), আব্দুর রহিম জুয়েল (৩০) ও সায়েম মির্জা (২৪)। মনিরুল ইসলাম আরও জানান, জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গত ঈদুল আজহার পূর্বে জিলহজ মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার পরিকল্পনা নিয়েছিল নব্য জামা’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সামরিক শাখার সদস্যরা। এরই অংশ হিসেবে তারা কয়েকটি হামলা চালিয়েছিল। পরিকল্পনা মোতাবেক তাদের গত ২৩ জুলাই হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার শরিফে আরেকটি হামলার পরিকল্পনা নিয়েছিল। এর মধ্যে তারা পল্টন ও নওগাঁর সাপাহারে বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম হয়। কিন্তু সিলেটে পুলিশের কড়া নজরদারির কারণে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। তিনি বলছেন, বাংলাদেশে আমরা কার্যকরভাবে জঙ্গীবাদকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। যদিও এটা শেষ হয়ে যায়নি। বৈশ্বিক প্রভাব ও জাতীয় ঘটনা প্রবাহের কারণে। এটা বড় হুমকি ছিল বড় বড় যে জাতীয় অনুষ্ঠানগুলো হয় তার আগে। গত ঈদের আগেও এ ধরনের সতর্ক বার্তা ছিল। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএস প্রচার করে, জিলহজ মাসের ১০ তারিখের মধ্যে হামলা করলে কথিত পুণ্যের অধিকারী হবে। এতে আইএস মতাদর্শী বিভিন্ন দেশের উগ্রবাদী গোষ্ঠী চেষ্টা চালায়। বাংলাদেশে আইএস মতাদর্শী নব্য জেএমবি ও আনসার আল ইসলাম উভয়েই চেষ্টা চালিয়েছে। আনসার আল ইসলাম ব্যর্থ হলেও সফল হয়েছে নব্য জেএমবি। তবে অন্যদের প্রচেষ্টা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্কতার কারণে ব্যর্থ হয়েছে। গ্রেফতাররা সবাই নব্য জেএমবির সামরিক শাখার সদস্য। তারা কথিত আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ঈদ-উল-আজহার আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার পরিকল্পনা নিয়েছিল। তারই অংশ হিসেবে গত ২৩ জুলাই রাজধানীর পল্টনে পুলিশ চেকপোস্টের পাশে, ৩১ জুলাই নওগাঁ জেলার সাপাহার এলাকায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরে বোমা হামলা করে। নব্য জেএমবির সদস্যরা পল্টন ও সাপাহারে বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম হলেও পুলিশের কড়া নজরদারির কারণে হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার শরিফে হামলার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে নব্য জেএমবির শূরা সদস্য শেখ সুলতান মোহাম্মদ নাইমুজ্জামানের নেতৃত্বে তারা সিলেটের শাপলাবাগের একটি বাসায় কম্পিউটার প্রশিক্ষণের আড়ালে সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছিল। শেখ সুলতান মোহাম্মদ নাইমুজ্জামান ২০১৯ সালে সিলেটের হযরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স সম্পন্ন করেন। ছাত্রজীবনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সামরিক শাখার প্রধান প্রশিক্ষক এবং সামরিক প্রশিক্ষণের উদ্দেশে সিলেটের শাপলাবাগের বাসাটি ভাড়া নেন। বারিস্তা নামের একটি কফি শপে কফি মেকার হিসেবে কাজ করেন। সানাউল ইসলাম শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র। রুবেল আহমেদ ২০১৬ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ব্লু বার্ড সিলেট শাখা থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেন। সে সিলেটে টুকেরবাজারে সার, বীজ ও কীটনাশকের ব্যবসা করেন। আব্দুর রহিম জুয়েল রেন্ট এ কারের ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতেন। তার গাড়ি ব্যবহার করে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন। সায়েম মির্জা সিলেটের মদন মোহন কলেজের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। এর আগে গত বছরের ২৯ এপ্রিল গুলিস্তানে পুলিশের ওপর প্রথম বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় এক পুলিশ সদস্য মারাত্মক আহত হন। প্রায় এক মাস পরই গত বছরের ২৬ মে মালিবাগে পুলিশের ওপর বোমা হামলা হয়। হামলায় এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ দুই জন মারাত্মক আহত হন। এর প্রায় দুই মাস পর গত বছরের ২৩ জুলাই পল্টন মোড় ও খামারবাড়িতে একযোগে পুলিশের ওপর বোমা হামলা হয়। এর প্রায় এক মাস পর গত বছরের ৩১ আগস্ট সাইন্সল্যাব মোড়ে পুলিশের ওপর মারাত্মক ধরনের বোমা হামলা হয়। গত বছর ঢাকার পাঁচটি স্থানে পুলিশের ওপর বোমা হামলার ঘটনায় জড়িত নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবি। চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি পুলিশের ওপর বোমা হামলায় জড়িত জামাল উদ্দিন রফিককে যাত্রাবাড়ীর শনিরআখড়া থেকে গ্রেফতার করা হয়। হামলায় ব্যবহৃত বোমাগুলো তৈরি করা হয়েছিল রফিকের বাড়িতেই। পরে তার অপর সহযোগী মোঃ আনোয়ার হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ৪টি মোবাইল ফোন ও একটি ল্যাপটপ জব্দ করা হয়। জব্দকৃত ল্যাপটপে বোমা হামলা সংক্রান্ত তথ্য আছে। যেটি মামলার আলামত হিসেবে ধরা হয়েছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ডিআইজি মোঃ মনিরুল ইসলাম জানান, পুলিশের ওপর বোমা হামলার নেতৃত্বে ছিল মোঃ জামাল উদ্দিন রফিক নামের একজন। তিনিও নব্য জেএমবির সদস্য। জামাল উদ্দিন রফিক খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছে। অপরজন আনোয়ার পেশায় ড্রাইভার। আনোয়ার পোড়া মবিলের ব্যবসা করত। রফিকের নেতৃত্বে পুলিশের ওপর পাঁচটি বোমা হামলার ঘটনাই ঘটে। যার মধ্যে চারটি হামলায় রফিক সরাসরি উপস্থিত ছিল। এর আগে পুলিশের ওপর বোমা হামলায় জড়িত ফরিদ উদ্দিন রুমি, আব্দুল্লাহ আজমীর, মেহেদী হাসান তামিম, মিশুক খানকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা কালো পোশাক পরিধান করে খেলনা অস্ত্র, বোমাসহ সুইসাইডাল ভেস্ট পরিধান করে বিভিন্ন উগ্রবাদী কথাবার্তা সম্বলিত একটি ভিডিও ক্লিপ অনলাইনে প্রচার করেছিল। ভিডিওতে জামাল উদ্দিন রফিক, ফরিদ উদ্দিন রুমি, আব্দুল্লাহ আজমীর ও গ্রেফতারকৃত আনোয়ার অংশ নিয়েছিল।
×