ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দূষণ কমায় ঝাঁকে ঝাঁকে মিলছে বড় আকারের ইলিশ

প্রকাশিত: ২২:৫১, ১৩ আগস্ট ২০২০

দূষণ কমায় ঝাঁকে ঝাঁকে মিলছে বড় আকারের ইলিশ

ওয়াজেদ হীরা ॥ চকচকে রুপালি ইলিশে ভরপুর বাজারসহ অলিগলি। ফেরি করেও বিক্রি হচ্ছে ইলিশ। অন্য বছরের চেয়ে ইলিশের আকারও বড়, দামও কম। সুস্বাদু এই মাছের দাম কমায় অন্য মাছের চাহিদাও কমেছে। সরকারের নানামুখী উদ্যোগের কারণে ইলিশের উৎপাদন প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এবার শুরু থেকেই বড় সাইজের ইলিশ মাছ জেলেদের জালে আটক হওয়ায় সম্ভাবনাময় হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনার সময় সবকিছু বন্ধ থাকায় কমেছিল পানিতে দূষণ। এ কারণে দ্রুত মাছের বৃদ্ধি হয়েছে এবং বড় আকৃতির ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে বলেও মত সংশ্লিষ্টদের। সেই সঙ্গে ধারণা করা হচ্ছে সামনের দিনগুলোতে ইলিশ উৎপাদন ও আহরণে নতুন রেকর্ড হবে। দীর্ঘ ৬৫ দিন সমুদ্রে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ থাকার পর গত ২৩ জুলাই উঠে জেলেরা সাগরে ছুটে যান। তখন থেকেই জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ছে। এ বছর গত বছরের চেয়েও বড় আকৃতির ইলিশ ধরা পড়ছে। বাজারে ইলিশের সরবরাহ বেড়েছে, দামও আগের চেয়ে কমেছে। বিক্রেতারা বলছেন, ঈদের পর মাছের বাজারে এখন ইলিশের ক্রেতা বেশি। বড় আকৃতির ইলিশ নিয়ে মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার জেলেদের জালে বেশি এবং বড় আকারের ইলিশ ধরার কয়েকটি কারণ আছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশে লকডাউনের কারণে প্রকৃতিতে দূষণ হ্রাস পেয়েছে অনেকাংশে। কল-কারখানা বন্ধ থাকায় কার্বন নিঃসরণ হ্রাস পেয়ে কমেছে বায়ুদূষণ; খাল-বিল, নদী-নালা এমনকি সমুদ্রেও কমেছে দূষণ। এ বছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে টানা ৬৬ দিন বরিশাল-ঢাকা নৌপথে বন্ধ ছিল লঞ্চ চলাচল। নদীর তীরবর্তী অনেক শিল্পকারখানাও বন্ধ ছিল এ সময়। ফলে বাতাসে দূষণের মাত্রা কমে যায়। যান্ত্রিক নৌযান চলাচল এবং বেশিরভাগ শিল্পকারখানা বন্ধ থাকায় বরিশাল বিভাগের নদ-নদীর পানিও অনেক কম দূষণ হয়। এসব কারণে সাগরেও দূষণ কমে। অনেকটা অবাধে নদ-নদী ও সমুদ্রে বিচরণ করতে পারে ইলিশ। পাশাপাশি বেড়ে ওঠার পর্যাপ্ত সময়ও পায়। তাই এবার ইলিশের বংশবৃদ্ধি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়াবে এমনটি মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, করোনার কারণে এবার অবৈধ মাছ শিকার ছিল প্রায় বন্ধই ছিল। সমুদ্র দূষণমুক্ত থাকা, নদ-নদীতে ৬৬ দিন লঞ্চ বন্ধ থাকা ও অবৈধ মাছ শিকার নিয়ন্ত্রণে থাকায় ইলিশ উৎপাদনের রেকর্ড ভেঙে এবার নতুন রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে। পানিতে দূষণ কম থাকার কারণে মাছের বংশবৃদ্ধি এবং আকৃতি বড় হওয়ার অন্যতম কারণ উল্লেখ করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। জনকণ্ঠকে শ ম রেজাউল করিম বলেন, ইলিশ যে অঞ্চলে অভয়আশ্রমের মতো থাকে, যে অঞ্চলে ইশিলের পোনা ছাড়া হয় সেসব অঞ্চলে করোনাকালীন সময়ে যন্ত্রচালিত নৌযানের প্রভাব কম ছিল। দূষণযুক্ত বিভিন্ন ক্যমিক্যাল সরবরাহ কম ছিল এ কারণে এবার বড় আকৃতির মাছ এবং বেশি ইলিশ পাওয়ার একটি অন্যতম কারণ। এছাড়াও অধিক মাছ পাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি কারণ হলো আমরা এবার জাটকা নিধনে কঠোর অবস্থানে ছিলাম। আমাদের কারেন্ট জাল, বেহুন্দি জাল অনেক ধরেছি। আমাদের অফিসার, নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ড এ নিয়ে কাজ করেছে। অনেক স্থানে বরফকল পর্যন্ত বন্ধ করেছি। কেননা ঝাটকা এনে রাখবে কোথায়। এসব বিষয়ে কড়াকড়ি থাকায় আমাদের ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আরও বলেন, দূর্ষণযুক্ত ক্যমিক্যাল নদীতে চলে যাওয়ায়, যান্ত্রিক নৌযান চলাচলে অনেক সময় নদীতে তেল পরে যে ক্ষতি হতো এবার কিন্তু তা হয়নি। ইলিশ পাচার নিয়ে এক প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, বর্ডার এলাকায় ইলিশ পাচার নিয়ে সবসময় কঠোর আমরা। এছাড়াও এবার নীতিমালাই গ্রহণ করেছি বিদেশে কোন ইলিশ রফতানি হবে না। এমনও হয়েছে কেউ কেউ বর্ডারে ইলিশ নিয়ে গিয়েও পাচার করতে পারেনাই আবারও ফিরে আসতে হয়েছে। ফলে এই যে বর্ডারে গিয়েও ফিরে আসতে হচ্ছে, নেয়া যাচ্ছে না খবরটা অন্যরা যেনে যাচ্ছে এবং আর নিয়ে যাচ্ছে না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯০ হাজার টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ৫ লাখ ৩৩ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ গত ১১ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৮৪ শতাংশ। সদ্য শেষ হওয়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে আবার ইলিশ উৎপাদনে নতুন রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে কাজ হচ্ছে। তবে গত বছর উৎপাদিত মাছের হিসাব এখনও চূড়ান্ত হয়নি বলে জানা গেছে। তথ্য অনুযায়ী, ১০ বছর আগে দেশের ২১ উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫ থেকে ১৩০ উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। দেশে প্রায় ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে ইলিশের অভয়াশ্রম। ইলিশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তা মাসুদ আরা মমি। এই কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের গত বছরের উৎপাদিত ইলিশের হিসাব চলছে। সারাদেশ থেকে তথ্য আসছে। আমরা আশা করি গত বছর যে উৎপাদন ছিল তার চেয়ে বেশি উৎপাদন হবে। প্রতিবছরই আমাদের উৎপাদন বাড়বে বলে আশা করছি। ইলিশ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, সাগরে ৬৫ দিনের মৎস্য আহরণে যে নিষেধাজ্ঞা এটি ইলিশ উৎপাদনে বেশ ইতিবাচক হচ্ছে এবং উৎপাদন বাড়ছে। বাংলাদেশ মৎস্য অধিদফতর, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সাগরের আবহাওয়া এ বছর বেশ ভাল রয়েছে। বৃষ্টি হওয়া এবং তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রীর আশপাশে থাকার মানে হলো, জালে ইলিশ ধরা পড়ার আদর্শ আবহাওয়া। এসব দিক বিবেচনা করে ইলিশ উৎপাদনে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই বাজারে আসা বড় সাইজের ইলিশ সম্ভাবনার জানান দিচ্ছে। মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, ইলিশ উৎপাদনে সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলো খুবই কার্যকর যার ফলে দিন দিন ইলিশ উৎপাদন যেমন বাড়ছে তেমনি বড় সাইজের ইলিশ পাচ্ছে মানুষ। সাধ্যের মধ্যে সব শ্রেণীর মানুষ ইলিশ কিনতে পারছে। উৎপাদনের অন্যতম কারণ উল্লেখ করে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৫ সালে সমুদ্রে ৬৫ দিনের মৎস্য আহরণ নিষেধাজ্ঞা আইন করা হলেও মূলত গত দুই বছর ধরে এটি বেশ কার্যকর করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় গতবছর থেকেই বড় আকৃতির বেশি ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। কেননা নিষেধাজ্ঞার কারণে কেউ মাছ শিকারে যেতে পারছেন না ফলে অবাধে মাছ বিচরণ করতে পাচ্ছে একই সঙ্গে মাছের বংশবৃদ্ধি বাড়ছে। চলতি বছরের জুনে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বৈশ্বিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে মিঠাপানির মাছে বাংলাদেশ তার তৃতীয় স্থান ধরে রেখেছে। তবে, বিশ্বে মাছ উৎপাদন বাড়ানোর দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। এ বছর দেশে মাছ উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। আগস্টের শুরুতে এত ইলিশ পাওয়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিছুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ইলিশের মূল মৌসুম সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস। তবে অনেক সময় নদীতে পানিপ্রবাহ ভাল হলে আগেই ইলিশের মৌসুম শুরু হয়ে হয়। এবারও তাই হচ্ছে। তিনি জানান, আগামী অক্টোবরে ২২ দিন মা ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। আগস্ট থেকেই ইলিশ বেশি পরিমাণে পাওয়া ভাল লক্ষণ। ড. আনিছুর রহমান আরও বলেন, এ রকম দূষণমুক্ত পরিবেশ বহু বছর পরে লক্ষ করা গেছে। এ বছর নদীতে মাছের খাবার ভাল রয়েছে। ইলিশসহ সব মাছ দ্রুততার সঙ্গে বাড়ছে। ইলিশ উৎপাদনে এ বছর পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, জাটকা ধরা নিষিদ্ধ সময় শেষে সমুদ্র ৬৫ দিন সব ধরনের মাছ ধরা নিষেধ থাক এই সময়ে মাছ অবাধে চলাচল করতে পারে এতে করে মাছের আকার বড় হচ্ছে। এছাড়াও মা ইলিশ রক্ষায় সরকারের পদক্ষেপ এবং সব মিলে জেলেরাও বুঝতে পেরেছে সরকারের এই উদ্যোগগুলোর জন্য তারা বড় আকৃতির বেশি মাছ পাচ্ছে। এদিকে, দেশের ইলিশ উৎপাদিত জেলা ও ফিশারিঘাটগুলাতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে প্রতিদিন ট্রলারে ইলিশ নিয়ে ফিরছেন জেলেরা। অধিক মাছ জেলেদের জালে উঠায় জেলেরাও খুশি। আবার সেই মাছ রাজধানীসহ সারাদেশেই চলে যাচ্ছে। অধিক মাছ ধরা পরায় দামও কমেছে। কারওয়ান বাজারে ভোর থেকেই শুরু হয় পাইকারি বাজার। বিভিন্ন আকৃতি হিসেবে দাম লক্ষ্য করা গেছে। মাঝারি আকারের ৮০০ গ্রাম ওজনের একেকটি ইলিশের দাম ছিল ৫০০ টাকা। ছোট ইলিশ (২টা এককেজি) বিক্রি হচ্ছিল প্রতিকেজি ৩০০-৩৫০ টাকায়। পাইকারি আরও দাম কম। মাছ ব্যবসায়ী হোসেন মিয়া জানান, বাজারে প্রচুর ইলিশ আসছে। দাম কমেছে। ইলিশের কারণে অন্য মাছের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ কম বলেও জানা গেছে। এদিকে, রাজধানীর অলিগলি, বিভিন্ন মহল্লায় ফেরি করে ইলিশ বিক্রি করতে দেখা গেছে। গত দুই বছর ধরে বাজারে এক থেকে দের কেজির ওজনের ইলিশ হরহামেশাই মিলছে। আড়ৎতে যোগাযোগ করলে বা বেশি ওজনের ইলিশও বের করেন দেন কখনও কখনও। এর আগে এককেজির উপরে ইলিশ পাওয়া যেন স্বপ্নের মতোই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ১ কেজি বা তার ওপরে ইলিশ পাওয়া যেত মাত্র তিন শতাংশ, ২০১৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় পাঁচ শতাংশে। ২০১৯ সালে তা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১০ শতাংশ। ইলিশের সঙ্কটকালে এককেজি ওজনের ইলিশ দেড় হাজার বা আরও বেশি দামে বিক্রি হয়। অথচ এখন ৭৫০-৮৫০ টাকায় মিলছে। ঈদের পর মাছের চাহিদা একটা বেড়েছে বলে দাম একটু বেশি যা ঈদের আগে আরও কম ছিল। পাইকারি বাজারে এক কেজি ওজনের ইলিশের ডাক উঠছে ৬০০ থেকে ৭০০ বা কখনও একটু বেশি। এককেজি এক শ’ দুই শ’ তিন শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ পাইকারি বাজারে ৮০০-১০০০ মধ্যে যা খুচরায় এগারো বা বারো শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
×