ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দুই অংশের দুই মত

খালেদার চিকিৎসা দেশে না বিদেশে? দ্বিধাবিভক্ত বিএনপি

প্রকাশিত: ২৩:০৪, ১২ আগস্ট ২০২০

খালেদার চিকিৎসা দেশে না বিদেশে? দ্বিধাবিভক্ত বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো সম্ভব হলেও তাঁর চিকিৎসা বিদেশে হবে কি হবেনা এ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত বিএনপি। দলের একাংশ চাচ্ছে তাঁকে লন্ডনে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করাতে। আর অপর অংশ চাচ্ছে মুক্তির মেয়াদ বাড়লেও করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে তাঁকে দেশের কোন বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে। বিএনপি নেতাদের মধ্যে যারা খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নিয়ে চিকিৎসা করানোর পক্ষে তাদের মতে, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অসুস্থ খালেদা জিয়াকে বিদেশের কোন স্বনামধন্য হাসপাতালে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিয়ে তাঁকে দ্রুত সুস্থ করে তোলা। এ জন্য তাঁর মুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে দ্রুত লন্ডনে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। উন্নত চিকিৎসার পর বেঁচে থাকলে তিনি আবার দলের হাল ধরতে পারবেন। আর নেতাদের মধ্যে যারা খালেদা জিয়াকে দেশে চিকিৎসা করানোর পক্ষে তাদের যুক্তি হচ্ছে- খালেদা জিয়া বিদেশে চলে গেলে দল রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কারণ, দলের চেয়ারপার্সন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দু’জনই দেশের বাইরে থাকলে সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে দলের নেতাকর্মীরা হতাশায় ভুগবে। এ ছাড়া দলের অন্য যেসব সিনিয়র নেতারা আছেন তারা কেউ কাউকে মানতে চাইবেন না। এর ফলে দলে কোন্দল-বিদ্বেষ আরও বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে দলীয় রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে তাঁর স্বজন ও আইনজীবীরা। স্বজনরা তাঁর মুক্তির বিষয়ে আশাবাদী। মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের সহযোগিতার জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন স্বজনরা। কোন কারণে মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা সম্ভব না হলে সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখ আবার খালেদা জিয়াকে কারাগারে চলে যেতে হবে। তবে কোন কারণে মুক্তির মেয়াদ বেশি দিন বৃদ্ধি করা সম্ভব না হলেও অন্তত করোনা পরিস্থিতির পুরোপুরি উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে যেন ফের কারাগারে যেতে না হয় সে চেষ্টা চলছে জোরেশোরে। খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম ও ভাই শামীম ইস্কান্দারসহ বেশ ক’জন স্বজন তাঁর মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন মহলের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করছেন। দলীয় কিছু আইনজীবী আইনগতভাবেও মুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে আইনজীবীদের পাশাপাশি স্বজনরা বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কথা বলে কিভাবে মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা যায় সে চেষ্টা করছেন। আর সে চেষ্টায় কতটুকু অগ্রসর হলো তা সময় সময় লন্ডন প্রবাসী খালেদা জিয়ার ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জানাচ্ছেন। এ ছাড়া খালেদা জিয়াকেও সময় সময় এ বিষয়ে অবহিত করা হচ্ছে। বিএনপি সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করতে হলে আইনগতভাবে অগ্রসর হওয়ার পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে সমঝোতা হতে হবে। আর এ সমঝোতা হওয়ার আগে মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির পর তিনি দেশে থাকবেন না বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাবেন সে বিষয়টি স্পষ্ট করে সরকারকে জানাতে হবে। এ ছাড়া খালেদা জিয়া মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির পর রাজনীতি করতে পারবেন না এমন প্রতিশ্রুতিও দিতে হবে। আর এ কারণে বিএনপি নেতারা এ নিয়ে দুই রকম মত দিচ্ছেন। কেউ বলছেন মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি পেলেও তাঁকে দেশের কোন বড় হাসপাতালে চিকিৎসা করালে ভাল হবে। আবার কেউ বলছেন বিদেশে নিয়ে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে করোনা সংক্রমণের পর ২৫ মার্চ শর্ত সাপেক্ষে ৬ মাসের জন্য মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে প্রায় পৌনে ৫ মাস। খালেদা জিয়ার মুক্তির ২ শর্ত ছিল বাসায় অবস্থান করে চিকিৎসা নিতে হবে এবং বিদেশে যাওয়া যাবেনা। মুক্তির এই ২ শর্ত মেনে এখনও গুলশানের বাসা ফিরোজায় অবস্থান করছেন খালেদা জিয়া। মুক্তি পেয়ে ২৫ মার্চ বিকেলে বাসায় অবস্থান নেয়ার পর এখনও এক মুহূর্তের জন্যও তিনি বাসার বাইরে যাননি। রাজনীতি থেকেও রয়েছেন বিরত। ঘনিষ্ঠ ক’জন আত্মীয়স্বজন, চিকিৎসক ও দলের ক’জন নেতা ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে তিনি দেখাই দেননি। মুক্তির শর্ত অনুসারে এতদিন বিদেশ গিয়ে চিকিৎসার চেষ্টা করেননি খালেদা জিয়া। করোনা পরিস্থিতির কারণে ঢাকার কোন হাসপাতালে গিয়েও চিকিৎসা নেয়ার চেষ্টা করেননি তিনি। ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের পরামর্শে ও লন্ডনপ্রবাসী ছেলের বউ ডাঃ জোবায়দা রহমানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাসায় থেকেই তিনি চিকিৎসা নেন। তাঁকে চিকিৎসা সহায়তা দিতে বাসায় সার্বক্ষণিকভাবে রয়েছেন একজন নার্স। বাসায় বিভিন্ন যন্ত্রপাতির মাধ্যমে এই নার্সই খালেদা জিয়ার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। তবে এবার মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি পেলে স্বজন ও দলের একাংশ তাঁকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাতে চান। সূত্রমতে, খালেদা জিয়ার স্বজনরা চাচ্ছেন তাঁর মুক্তির মেয়াদ আরও অন্তত একবছর বৃদ্ধি করতে। একবছর না হলেও যেন অন্তত ৬ মাস বাড়ানো যায়। কিভাবে মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো যায় সে চেষ্টাই এখন চলছে। তবে বিশ্বব্যাপী বিরাজমান ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতিকে সামনে রেখে সরকারের কাছে আবারও মানবিক আবেদন করে মেয়াদ বাড়ানোর কৌশলকেই খালেদা জিয়ার স্বজনরা প্রাধান্য দিচ্ছেন। সম্প্রতি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, কারাবন্দী থাকাকালে খালেদা জিয়ার শারিরীক অবস্থা যেমন ছিল এখনও তেমনই আছে। তবে তিনি সবার সঙ্গে নিয়মিত কথা বলতে পারায় কিছুটা স্বস্তিতে আছেন। তিনি এখনও গুরুতর অসুস্থ। তাই তাঁর উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। কিন্তু তিনি জামিনে মুক্ত থাকলেও উন্নত চিকিৎসা পাচ্ছেন না। এ জন্য তাঁর মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির প্রয়োজন। সূত্র জানায়, শারীরিক অসুস্থতা ও মামলাজনিত কারণে আপাতত রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন না খালেদা জিয়া। তিনি চান মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো সম্ভব হলে দেশে হোক আর বিদেশেই হোক আরও উন্নত চিকিৎসা করে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করতে। স্বজনরা চাচ্ছেন তাকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাতে। এ জন্য সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে এমনটি মাথায় রেখেই খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক কর্মকা- থেকে বিরত থাকতে বলেছেন স্বজনরা। খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও বিএনপি নেতাদের দীর্ঘদিনের চেষ্টার পরও তাঁর জামিনে মুক্তি ছিল অনিশ্চিত। এ পরিস্থিতিতে স্বজনদের অনেক দৌড়ঝাপের পর ২৫ মার্চ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়ে সরাসরি গুলশানের বাসা ফিরোজায় অবস্থান নেন। ওই দিন রাতে ঘনিষ্ঠ ক’জন আত্মীয়, ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও কয়েকজন বিএনপি নেতা ছাড়া আর কেউ খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাননি। পরদিন ২৬ মার্চ থেকে তিনি নিজ বাসার দ্বিতীয় তলায় স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টাইন শুরু করেন। প্রায় দেড়মাস তিনি হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার পর বিএনপি নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। আর অনেকেই তাঁর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে না পেরে ২০ দলীয় জোটের নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। জানা যায়, খালেদা জিয়ার ডায়াবেটিস ও হাত পায়ের ব্যথাসহ শারীরিক অন্য সমস্যাগুলো আগের মতোই রয়েছে। তবে আগের চেয়ে সমস্যা না বাড়ায় তাঁর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে রিউমেটিক আথ্রারাইটিস ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছেন খালেদা জিয়া। সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে বাসায় ফেরার পর থেকে প্রতিদিনই লন্ডনপ্রবাসী ছেলে তারেক রহমান, ছেলের বউ ডাঃ জোবায়দা রহমান, তারেক রহমানের মেয়ে জায়মা রহমান, প্রয়াত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান, তার দুই মেয়ে জাসিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমানের সঙ্গে ফোনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কথা বলছেন খালেদা জিয়া। পরিবারের সদস্যরা খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর নিচ্ছেন।
×